নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব পোশাকশ্রমিক ঈদ বোনাস পাননি
Published: 25th, March 2025 GMT
প্রতিবারের মতো এবারও নির্ধারিত সময়, অর্থাৎ ২০ রমজানের মধ্যে রপ্তানিমুখী সব তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ঈদ বোনাস পাননি। সময়সীমা না থাকায় চলতি মাসের অর্ধেক বেতন এখনো দেয়নি অধিকাংশ কারখানা। শুধু তা–ই নয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনও বাকি কিছু কারখানায়।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ঈদ বোনাস গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেয়নি। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক কারখানা শ্রমিকদের ঈদ বোনাস এখনো দিতে পারেনি।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন–বোনাস ও ছুটিসংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য গত ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি) সভা হয়। শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন–বোনাসসহ সব পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া মালিকপক্ষকে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনও দিতে হবে।
বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, সংগঠনের সচল তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৬৩টি বা ৮৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিয়েছে। চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকা অঞ্চলের কারখানার বোনাস পরিশোধের হার বেশি। ঢাকার ১ হাজার ৭৬৯টি সচল কারখানার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বোনাস দিয়েছে। তার বিপরীতে চট্টগ্রামের সচল ৩৩৮টি কারখানার মধ্যে বোনাস দিয়েছে ৬৫ শতাংশ।
এদিকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ শতাংশ বা ৮৪টি তৈরি পোশাক কারখানা চলতি মাসের বেতন দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ৪১ ও চট্টগ্রামের ৪৩টি কারখানা রয়েছে। আর গত ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন এখনো পরিশোধ করেনি ৩১টি কারখানা। এর মধ্যে ঢাকার ২২টি ও চট্টগ্রামের ৯টি কারখানা রয়েছে।
এদিকে ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, বেতন–ভাতার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনাও বাড়ছে। বকেয়া বেতন–ভাতার দাবিতে দুই দিন ধরে ঢাকার উত্তরায় বিজিএমইএর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন ভালুকার রোর ফ্যাশনের শ্রমিকেরা। গতকাল শ্রমিকেরা ভবনটির ফটক অবরুদ্ধ করলে বিজিএমইএ কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তাই কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। সে কারণে সংগঠনের দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ঈদে অতিরিক্ত ছুটি দাবি করে আশুলিয়ার চান্তিক গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা গতকাল কাজ বন্ধ করে দেন। শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে একই এলাকার জন রন সোয়েটার্স কারখানার শ্রমিকেরা গতকাল সড়ক অবরোধ করেন।
পাঁচ মাসের বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাস, ছুটির টাকাসহ অন্যান্য পাওনার দাবিতে গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকেরা গতকাল বিজয়নগর এলাকায় সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগের দিন অর্থাৎ রোববার বকেয়া বেতন–ভাতার দাবিতে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান স্টাইল ক্রাফট ও ইয়াং ওয়ানসের কর্মী রাম প্রসাদ সিং। গত মঙ্গলবার থেকে গাজীপুরের কারখানা দুটির শ্রমিক–কর্মচারীরা আন্দোলনে ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর সাবেক এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, টিএনজেড গ্রুপ, রোর ফ্যাশনসহ সাত–আটটি কারখানার বেতন–ভাতা নিয়ে সমস্যা আছে। সংগঠনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় এসব কারখানার সমস্যা দ্রুত শেষ করা যাচ্ছে না।
প্রতিবছরই ঈদের আগে শ্রম মন্ত্রণালয় সভা করে বেতন–বোনাস দেওয়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। তবে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, তদারক করতে হয়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে কারখানামালিকেরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না সালাউদ্দিন স্বপন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলনিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সচল কারখানার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭৫০। গতকাল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে। এমন তথ্য দিয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত বেতন–ভাতা নিয়ে সমস্যা নেই। কিছু কারখানার শ্রমিকেরা অযৌক্তিকভাবে মূল বেতনের শতভাগ বোনাস, সরকারি ছুটির মতো ৯–১০ দিন ছুটি চাচ্ছেন। তিনি বলেন, ছুটির আগেই সব কারখানা বেতন–ভাতা পরিশোধ করে দেবে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ঈদের ছুটি দিতে শুরু করবে কারখানাগুলো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে ঈদুল ফিতরের আগে বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ নিয়ে প্রায় ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতার কথা জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ৩৬টি কারখানাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ছুটির আগে সময়মতো অর্থ প্রদান নিশ্চিত করতে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে—এমনটাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
নির্ধারিত সময়ে ঈদ বোনাস না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই ঈদের আগে শ্রম মন্ত্রণালয় সভা করে বেতন–বোনাস দেওয়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। তবে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, তদারক করতে হয়। অথচ কেন দেওয়া হচ্ছে না, সেটি জবাবদিহির আওতায় আনার দায়িত্বটা সরকার ভুলে যায়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে কারখানামালিকেরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, ইতিমধ্যে বেতন–ভাতা নিয়ে শ্রম অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। এখনই দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা আছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব জ এমইএর এমইএর স ঈদ ব ন স গতক ল স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’