প্রতিবারের মতো এবারও নির্ধারিত সময়, অর্থাৎ ২০ রমজানের মধ্যে রপ্তানিমুখী সব তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ঈদ বোনাস পাননি। সময়সীমা না থাকায় চলতি মাসের অর্ধেক বেতন এখনো দেয়নি অধিকাংশ কারখানা। শুধু তা–ই নয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনও বাকি কিছু কারখানায়।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ঈদ বোনাস গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেয়নি। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক কারখানা শ্রমিকদের ঈদ বোনাস এখনো দিতে পারেনি।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন–বোনাস ও ছুটিসংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য গত ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি) সভা হয়। শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন–বোনাসসহ সব পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া মালিকপক্ষকে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনও দিতে হবে।

বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, সংগঠনের সচল তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৬৩টি বা ৮৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিয়েছে। চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকা অঞ্চলের কারখানার বোনাস পরিশোধের হার বেশি। ঢাকার ১ হাজার ৭৬৯টি সচল কারখানার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বোনাস দিয়েছে। তার বিপরীতে চট্টগ্রামের সচল ৩৩৮টি কারখানার মধ্যে বোনাস দিয়েছে ৬৫ শতাংশ।

এদিকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ শতাংশ বা ৮৪টি তৈরি পোশাক কারখানা চলতি মাসের বেতন দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ৪১ ও চট্টগ্রামের ৪৩টি কারখানা রয়েছে। আর গত ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন এখনো পরিশোধ করেনি ৩১টি কারখানা। এর মধ্যে ঢাকার ২২টি ও চট্টগ্রামের ৯টি কারখানা রয়েছে।

এদিকে ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, বেতন–ভাতার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনাও বাড়ছে। বকেয়া বেতন–ভাতার দাবিতে দুই দিন ধরে ঢাকার উত্তরায় বিজিএমইএর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন ভালুকার রোর ফ্যাশনের শ্রমিকেরা। গতকাল শ্রমিকেরা ভবনটির ফটক অবরুদ্ধ করলে বিজিএমইএ কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তাই কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। সে কারণে সংগঠনের দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ঈদে অতিরিক্ত ছুটি দাবি করে আশুলিয়ার চান্তিক গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা গতকাল কাজ বন্ধ করে দেন। শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে একই এলাকার জন রন সোয়েটার্স কারখানার শ্রমিকেরা গতকাল সড়ক অবরোধ করেন।

পাঁচ মাসের বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাস, ছুটির টাকাসহ অন্যান্য পাওনার দাবিতে গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকেরা গতকাল বিজয়নগর এলাকায় সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগের দিন অর্থাৎ রোববার বকেয়া বেতন–ভাতার দাবিতে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান স্টাইল ক্রাফট ও ইয়াং ওয়ানসের কর্মী রাম প্রসাদ সিং। গত মঙ্গলবার থেকে গাজীপুরের কারখানা দুটির শ্রমিক–কর্মচারীরা আন্দোলনে ছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর সাবেক এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, টিএনজেড গ্রুপ, রোর ফ্যাশনসহ সাত–আটটি কারখানার বেতন–ভাতা নিয়ে সমস্যা আছে। সংগঠনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় এসব কারখানার সমস্যা দ্রুত শেষ করা যাচ্ছে না।

প্রতিবছরই ঈদের আগে শ্রম মন্ত্রণালয় সভা করে বেতন–বোনাস দেওয়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। তবে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, তদারক করতে হয়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে কারখানামালিকেরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না সালাউদ্দিন স্বপন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সচল কারখানার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭৫০। গতকাল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে। এমন তথ্য দিয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত বেতন–ভাতা নিয়ে সমস্যা নেই। কিছু কারখানার শ্রমিকেরা অযৌক্তিকভাবে মূল বেতনের শতভাগ বোনাস, সরকারি ছুটির মতো ৯–১০ দিন ছুটি চাচ্ছেন। তিনি বলেন, ছুটির আগেই সব কারখানা বেতন–ভাতা পরিশোধ করে দেবে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ঈদের ছুটি দিতে শুরু করবে কারখানাগুলো।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে ঈদুল ফিতরের আগে বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ নিয়ে প্রায় ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতার কথা জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ৩৬টি কারখানাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ছুটির আগে সময়মতো অর্থ প্রদান নিশ্চিত করতে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে—এমনটাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

নির্ধারিত সময়ে ঈদ বোনাস না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই ঈদের আগে শ্রম মন্ত্রণালয় সভা করে বেতন–বোনাস দেওয়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। তবে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, তদারক করতে হয়। অথচ কেন দেওয়া হচ্ছে না, সেটি জবাবদিহির আওতায় আনার দায়িত্বটা সরকার ভুলে যায়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে কারখানামালিকেরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, ইতিমধ্যে বেতন–ভাতা নিয়ে শ্রম অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। এখনই দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব জ এমইএর এমইএর স ঈদ ব ন স গতক ল স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক কমাতে হলে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর পাশাপাশি শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলেছে ঢাকা সফররত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে আজ সোমবার সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক করে এমনটাই বলেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে সংগঠনটির সহসভাপতি মো. রেজওয়ান সেলিম, পরিচালক ফয়সাল সামাদ, মোহাম্মদ আবদুস সালাম প্রমুখ মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে আরও ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ব্রেন্ডেন লিঞ্চ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন বাণিজ্যনীতি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কিন প্রতিনিধিদল বিজিএমইএর নেতাদের স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে পাল্টা শুল্ক নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। ফলে পাল্টা শুল্কের হার সেটি আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি এবং শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যঘাটতি কমানোর বিষয়ে আমরা প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গম, এলএনজিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির প্রক্রিয়াও চলছে। এসব পণ্য আমদানি হলে বাণিজ্যঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে। এ ছাড়া শ্রম আইন সংশোধনের ১২৪টির মধ্যে ১২২টির বিষয়ে আমরা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়েও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যাবে। তা ছাড়া আইএলওর কনভেনশন অনুসমর্থন নিয়েও আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা কোনো পণ্য উৎপাদনে ওই পণ্যের মোট মূল্যের কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি দেশটির উপকরণ বা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তাহলে ওই ২০ শতাংশের ওপর পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য না হওয়ার একটি বিষয় আমরা জেনেছি। সেটি পরিষ্কার করার বিষয়ে আমরা মার্কিন প্রতিনিধিদলকে অনুরোধ করেছি। তাঁরা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা দ্রুতই জানাবেন।’

পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলটি। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে গতকাল রোববার সচিবালয়ে বৈঠক করে প্রতিনিধিদল। এতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নাজনীন কাউসার চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সফররত মার্কিন দল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গেও বৈঠক করবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল
  • জামায়াত আমিরের সঙ্গে শিল্প মালিক‌দের সৌজন্য সাক্ষাৎ