বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে শ্রদ্ধা ও সমীহের সাথে উচ্চারিত একটি নাম সনজীদা খাতুন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশত বছরে শান্তিনিকেতন থেকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতির জন্যে বাংলাদেশে তিনিই যোগ্যজন। সাধনা ও সংগ্রামের মিশ্রণে এ এক অনন্য জীবন। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও পথচলার সুদীর্ঘ এই ধারায় কখনও ছেদ পড়েনি, বরং উত্তরোত্তর নতুন নতুন দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।

সাহিত্য ও সংগীত সনজীদাআপার মূল দুই সঞ্জীবনী, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রেরণার প্রধান উৎস, পথ চলার সহায় ও সঙ্গী।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির পাশাপাশি ভাবনা ও কর্মে বাঙালিকে গ্রাম্যতার গণ্ডি কাটিয়ে নাগরিক বিশ্বপরিসরে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। কবির মূল এই অভিপ্রায়ের সাথে আমাদের কৃষি-নির্ভর রক্ষণশীল সমাজের পরিচয়সাধন এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে তার উত্তরণের পথে অচলায়তন অন্তরে-বাহিরে, এবং তা দুস্তর ও বিস্তর। রবীন্দ্র-ভাবশিষ্যা সনজীদা খাতুন আজীবন সেই বাধাসংকুল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চলেছেন। অন্তর্নিহিত সাধকসত্তা তাঁকে সকল বাধা তুচ্ছ করে প্রয়োজনে একাই এগিয়ে চলার শক্তি দেয়। আর তাঁর স্বোপার্জিত সংগ্রামী সত্তা দিয়েছে সমমানাদের সংঘবদ্ধ করার প্রেরণা।

তাঁর সেই শক্তি ও প্রেরণার সার্থক প্রকাশ ছায়ানট-মহীরুহ। গত শতকের ষাট দশকে জাতির জাগরণের উত্তাল সময়ে ছায়ানট হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক যাত্রার দিশারী সংগঠন। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রত্যাঘাতের সময় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামেও ছায়ানট থাকল একই অবস্থানে অবিচল প্রত্যয়ে। গোড়ায় ছিলেন অনেকের একজন, ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর বাস্তবতায় যখন ছায়ানটের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে, এবং যখন জাগরণে ও প্রতিরোধে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুঘটকের ভূমিকায় ছায়ানট তখন বা ততদিনে এ প্রতিষ্ঠানের কাণ্ডারী সনজীদা খাতুন। প্রতিষ্ঠান অনেকের ভূমিকা ও অবদানেই রূপ পায়, তবে তখনই পায় যখন নেতৃত্ব থাকে সঠিক। 

বাঙালি মুসলিম সমাজের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের প্রথম প্রজন্মের একজন তিনি, তবে তিনি কেবল সেই ভূমিকায় আবদ্ধ থাকলেন না, নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন এবং ছাড়িয়ে উঠলেন সংগীত শিক্ষকের ও সংগঠকের দায় কাঁধে নিয়ে। সাহিত্যই তাঁর আগ্রহ ও চর্চার আদি বিষয় হওয়ায় তাঁর শিক্ষা সাঙ্গীতিক ব্যাকরণের পাঠ ছাপিয়ে জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতি অবধি পরিব্যাপ্ত।

ছায়ানট জন্মাবধি ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের হুমকির মুখেই ছিল। কিন্তু ২০০৩-এ সেটা আড়াল সরিয়ে সরাসরি যখন আঘাত হানল নববর্ষের অনুষ্ঠানে তখন অনেকেরই মনে হল শুধু সঙ্গীত ও সংস্কৃতির কাজে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, হাত দিতে হবে মানুষ গড়ার আরও মৌলিক ক্ষেত্রে—শিক্ষায়। সেই ভাবনায় ও কাজে  এদেশে রবীন্দ্রসংস্কৃতি বিকাশের প্রাণপুরুষ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক ছিলেন অগ্রণী। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানেরও ধাত্রী এবং ওয়াহিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর, এর অভিভাবক, সনজীদাআপাই।

আজ বিশ্বায়ন ও বাণিজ্যায়ন যেন পরিপূরক ভূমিকায় মানুষের সামনে সম্পূর্ণ জগত খুলে ধরে ক্ষান্ত নয়, মেলে ধরেছে ভোগের সীমাহীন সম্ভার এবং তা স্বভাবতই মানুষকে, বিশেষত তরুণদের, ঠেলে দিয়েছে ব্যস্ততা-অস্থিরতার এক কোলাহলময় জঙ্গম জীবনে। তোড়ের মুখে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেসে যাচ্ছে অনেকে, কেউ পথ হাতড়ে মরছে, কেউবা ধর্মান্ধতার বিবরে আশ্রয় নিচ্ছে।

কিন্তু কবির জীবনসায়াহ্নের সাবধানবাণী শোনে নি কেউ। প্রাচ্যও, পশ্চিমেরই মত, এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি আজ। ব্যবহারিক সংস্কৃতিতে এত বিপুল পরিবর্তন ঘটে চলেছে যে তার প্রভাব মানুষের চিন্তার জগৎকেও কেবল আলোড়িত করছে না, নতুন বা ভিন্ন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে সকলকে। তবে দেশে ও বিশ্বে অনেকেরই বিশ্বাস—এবং তা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে—এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়ার প্রয়োজন ও সুযোগ উভয়ই বাড়ছে।

আশি বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে নতুন কালের সামনে দাঁড়িয়ে আজ সনজীদা আপা; তবে তাঁর হৃদয় মাঝে অভয় বাজে নিশ্চয়—কারণ চিরনূতনেরে ডাক দিয়ে যান যে কবি তিনিই তো তাঁর সহায় ও সাথী। 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রব ন দ র অন ক র

এছাড়াও পড়ুন:

সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি

শোবিজের একঝাঁক একঝাঁক অভিনয়শিল্পীকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে। প্রথমে ইরেশ যাকের, তারপর সুবর্ণা মুস্তাফা, অপু বিশ্বাস, নুসরাত ফারিয়া, নিপুণসহ ১৭ অভিনয়শিল্পীর নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এরই মধ্যে গতকাল অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর ও লাঞ্ছিত করে রাজধানীর রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চা চলছে। এ নিয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

সিদ্দিকের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনা ঘটনা নিয়ে আজাদ আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, “সিদ্দিকের সঙ্গে যা ঘটেছে, এটা তো মব। এই মব ভায়োলেন্সকে তো ঠেকাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, মব ভায়োলেন্সকে নীরবে বলা হচ্ছে, করে যাও। আমাদের কিছুই করার নেই। একজনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা থাকতে পারে। অভিনেতা হিসেবে সিদ্দিক সবার কাছে পরিচিত। কিছু লোক তাকে এভাবে রাস্তায় ধরে মেরে দেবে!”

প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আজাদ আবুল কালাম বলেন, “দলবদ্ধভাবে সিদ্দিককে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে, আক্রমণ করেছে, গায়ে থেকে জামাকাপড় খুলে ফেলেছে, এরপর থানায় সোপর্দ করেছে। থানায় যদি সোপর্দ করতেই হয়, তাহলে প্রথমে কেন আইন হাতে তুলে নিল? তাকে হেনস্তা করে আইনের হাতে তুলে দেবে— এই মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এটা তো একটা সময় নানা স্তরে হবে। এসব কর্মকাণ্ড সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে মব ভায়োলেন্স, সেখানে কঠোর হস্তে দমন করবে।”

ঢালাওভাবে অভিনয়শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে বিস্মিত আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, “ঢালাওভাবে হত্যা মামলা হচ্ছে! দেখে মনে হচ্ছে, সবাইকে মামলার মধ্যে ফেলতে হবে। ৩০০-৪০০ জন মামলার আসামি, এটা অবাস্তব একটা অবস্থা। একজন সুবর্ণা মুস্তাফার মতো শিল্পী রাস্তায় গিয়ে মানুষকে গুলি করবে? যে মানুষটি মামলা করেছেন, তিনি আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন; তিনি মামলা করেছিলেন অনেক লোকের নামে। মামলার নথিতে শিল্পীদের অনেকের নাম দেখলাম, তারা রাস্তায় নেমে মানুষকে গুলি করবে!”

সরকারিভাবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা উচিত বলে মনে করেন আজাদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, “সরকারিভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিত হবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা। নিরুৎসাহিত করা। যে ব্যক্তি মামলা করছেন, যদি প্রমাণিত হয়, শিল্পীরা কেউই গুলি করেনি, তখন তো এটা মিথ্যা মামলা হবে। এ রকম মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে, যে ব্যক্তি শিল্পীদের নামে মামলা করেছেন, তার কী শাস্তি হবে, তারও বিধান থাকতে হবে।”

“কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, তা জানানোর একটা প্রক্রিয়া আছে। শুধু শিল্পী না, একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে আপনি তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে অপরাধী বলতে পারেন না। তাকে সামাজিকভাবে হেয় করতে পারেন না। মামলা করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা শুরু করলেন, এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে, এটাই যদি আমাদের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বিভক্তি আরো বাড়বে।” বলেন আবুল কালাম আজাদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাটোরে ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল একজনের
  • ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতির মেয়ে
  • ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতি মেয়ে
  • ৫০ পেরোনো নারীর খাদ্যাভ্যাস যেমন হতে হবে
  • যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করছে চীন
  • সেলফি’র ধাক্কায় গণস্বাস্থ্যের কর্মীর মৃত্যু, ৬ বাস আটক
  • পেহেলগামে হামলার পর প্রতিশোধের আশঙ্কায় দিন কাটছে ভারতীয় মুসলিমদের
  • প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
  • গাজীপুরে জমি নিয়ে বিরোধে সংঘর্ষ, হাতুড়িপেটায় একজন নিহত
  • সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি