Samakal:
2025-06-15@21:02:35 GMT

­গভীর রাতে ছাদে উঠে দেখি আগুন

Published: 25th, March 2025 GMT

­গভীর রাতে ছাদে উঠে দেখি আগুন

একাত্তরের ২৫ মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার। আমি তখন রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে (বর্তমানে সড়ক ও জনপথ) চাকরি করি। আমার বাবাও সরকারি চাকরিজীবী। আমার বয়স তখন সাড়ে ২২ বছর। আমাদের বাসা ছিল আম্বরখানা সরকারি কোয়ার্টারে। প্রায় ৩৬৪টি পরিবারের বাস ছিল ওই কলোনিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই যেন শুরু হয় যুদ্ধের দামামা। আমি নিজেও অফিসে যাইনি ৭ মার্চের ভাষণের পর।
চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ওই দিন বেলা ১১টা। সিলেটের ইতিহাসের সেরা একটি মিছিল প্রত্যক্ষ করি। মিছিলে ছিল সবার হাতে লাঠি। কারও কারও হাতে দেখলাম দেশীয় অস্ত্র। এই মিছিল দেখে আমি নিজে পুলকিত হয়ে পড়ি। এটি ছিল আমার জীবনের সেরা মিছিল। মিছিলটি রেজিস্টারি মাঠ থেকে শুরু হয়ে আম্বরখানা পয়েন্টে এসে জড়ো হয়। সেখানেই সমাপনী বক্তব্য দেন ’৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা.

আব্দুল মালেক। 
মিছিলে থাকা হাজার হাজার জনতা স্লোগান দিতে থাকে– জয় বাংলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। স্লোগানে স্লোগানে মুখর আম্বরখানা পয়েন্ট। মিছিলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতা ছিলেন। বলতে গেলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে মিছিলটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ। আমি তখন আম্বরখানা কোয়ার্টারের বাসা থেকে বের হয়ে পাশে থেকেই মিছিলটি প্রত্যক্ষ করি। যেহেতু সরকারি চাকরি করি, তাই কিছু বিধিনিষেধ ছিল। এ ছাড়া পরিবার থেকেও ছিল কোনোভাবেই এসবে না জড়ানোর কঠোর নির্দেশ।
তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা কিংবা ৮টা। কোয়ার্টারে থাকা আমার অনেক সহপাঠী ও বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিই সড়কে ব্যারিকেড দেওয়ার। এর আগে থেকেই খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশে অরাজকতা চালাতে পারে। আমরা কয়েকজন মিলে আম্বরখানা থেকে মজুমদারি হয়ে ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, শত শত লোক সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে পুরোনো রিকশা পুড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। আমরা কয়েকজন সেখানে হাজির হই। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন আখলাকুল আম্বিয়া শাইস্তা, ফয়েজ আহমদ চৌধুরী, সাঈদ উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকে। আমরা সবাই ছিলাম কোয়ার্টারের বাসিন্দা।
এরপর দেখি, বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহর দেখে আমরা বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করি। রাত গভীর হতে শুরু করেছে। তখন ঘড়িতে রাত ১টা। পুরো সিলেট ঘুমিয়ে। অকস্মাৎ যেন খুলে গেল নরকের সব দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সিলেট। 
আমরা ভয়ে সবাই ঘরের ভেতরে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকি, যাতে কারও গায়ে যেন গুলি না লাগে। রাত গভীর হওয়ার পর খাটের 

নিচ থেকে বের হই। কোয়ার্টারের তিনতলার ছাদে গিয়ে দেখি, পুরো সিলেট যেন আগুনে পুড়ছে। ২৫ মার্চ সারারাত সজাগ থাকি। ২৫ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত আমরা অবরুদ্ধ ছিলাম। ঘরের খাবারও শেষ। এ ছাড়া চুলায় আগুন দেওয়ার লাকড়িও ফুরিয়ে গেছে অনেক পরিবারের। ২৮ মার্চ খাবারের সন্ধানে বের হই আমরা। আম্বরখানা পয়েন্টে এসে দেখি বীভৎস অবস্থা। 
পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা এমএলএ ডা. আব্দুল মালেকের বাসার ছাদের ওপর নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে সেখানে লোকজনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। লোকজনকে দেখামাত্রই গুলি করছে। এমনকি বাসাবাড়ির জানালা খোলা দেখলে সেখানেও তারা গুলি ছুড়ছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ডা. মালেকের বাড়ির ছাদে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করে। তারা চলে যাওয়ার পর লোকজন ঘর থেকে বের হতে থাকে। তখন পুরো সিলেটে ছিল পিনপতন নীরবতা। পাকিস্তানি বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের কোয়ার্টারে ৩৬৪ পরিবারে থাকা ১৫/২০টি শিশু ছিল অনেকটা নির্বাক। তারাও যেন বন্ধ করে দিয়েছিল কান্না। ক্ষুধায় কাতর অনেক শিশুও যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি পাখিদের কোলাহলও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 
২৮ মার্চের পর খাবারের সন্ধানে গিয়ে কোনো রকমে অল্প খাবার পাই আমরা। সেটি দিয়ে এক দিন পার করি। এরপর খাবার ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। একদিকে মা, অন্যদিকে বাবা। সবার একটাই নির্দেশ, যেন কোনোভাবে ঘর থেকে বের না হই। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। বাসার ছাদের ওপর উঠে দেখি, পাশের বাগানে কয়েকটি পেঁপে পেকে আছে। এরপর গভীর রাতে বিড়ালের মতো চুপি চুপি গিয়ে বাগান থেকে পেঁপেগুলো পেড়ে নিয়ে আসি। ওই পেঁপে খেয়ে আমরা কয়েক দিন কাটিয়ে দিই।  
৪ এপ্রিল সিলেটের জিন্দাবাজারে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে হামলা চালায় বর্বর পাকিস্তানিরা। তারা ব্যাংকে লুটপাট চালায়। তখন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তা আট পুলিশ সদস্যকে লাইন ধরে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ৫ এপ্রিল গিয়ে এ অবস্থা দেখে নিজেও অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়ি। 
২৫ মার্চ থেকে সিলেটের প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ২৬ মার্চ মিরাবাজারে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারান আবদুস সামাদ ফকির নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। আমার জানামতে, তিনিই ছিলেন সিলেটের প্রথম কোনো শহীদ। এ ছাড়া সম্ভবত শুক্কুর নামে এক রিকশাচালক শহীদ হন আম্বরখানা এলাকায়। তিনি রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন রুটি-রুজির আশায়। 
জামালগঞ্জ থেকে বালাট সীমান্ত দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিই ।  এক পর্যায়ে সেখানে ক্যাম্পে নাম লেখাই  মুক্তিবাহিনীর খাতায়। ৩৫ দিনের ট্রেনিং শেষে ক্যাপ্টেন রাওয়ের নেতৃত্বে ৩৫ জনের একটি দল তামাবিল আসে। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিল্লুর রহমান। 
সহযোদ্ধা আবদুল মান্নানকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। যে আমাকে ভাত এনে খাওয়াত। সেই মানুষটির রক্তে আমার কোল ভিজেছে। এখনও মনে হলে আঁতকে উঠি। চুয়ান্ন বছরে ভুলতে পারিনি আবদুল মান্নানের স্মৃতি। পাইনি তার পরিবারের সন্ধান। এ ঘটনা আমাকে বড় বেশি কষ্ট দেয়। 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঘটে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। এই দিন ভয়ংকর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় কালরাত এসেছিল বাঙালির জীবনে। এই রাতেই সূচিত হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। যে গণহত্যার নৃশংসতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখেনি বিশ্ব। 

অনুলিখন
ফয়সল আহমদ বাবলু
সিলেট ব্যুরো

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২৫ ম র চ ২৮ ম র চ পর ব র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

কমিটি নেই, সবাই নেতা

কয়রা উপজেলা বিএনপির কমিটি নেই একযুগ। দীর্ঘদিন ধরে চলেছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। সেটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে ৪ মাস আগে। কমিটি না থাকায় দলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। ভেঙে পড়ছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাও। কেউ কারও কথা শুনছেন না। অবস্থা এমন, যেন সবাই নেতা– অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীর। 
কমিটি না থাকলেও উপজেলার একশ মিটারের মধ্যে পৃথক দুটি কার্যালয় রয়েছে। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে বহিষ্কৃত) নুরুল আমিন বাবুল। আরেকটি কার্যালয় চলছে খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য এম এ হাসানের নেতৃত্বে। নেতৃত্বের এ দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি নেই। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছাড়া অন্যান্য কর্মসূচিতে কার্যক্রমও সীমিত। এ অবস্থায় দ্রুত কমিটি দেওয়ার দাবি দলীয় নেতাকর্মীর।
পৃথক কার্যালয়ের বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য এম এ হাসান বলেন, উপজেলায় একটি দলীয় কার্যালয় ছিল। পরে স্থানীয় একজন নেতা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে আরেকটি কার্যালয় খুলেছেন; যা সংগঠনবিরোধী কাজ। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই নেতাকে বহিষ্কার করা হলেও এখন পর্যন্ত তিনি কার্যালয়টি বন্ধ করেননি। 
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি মনজুর আলম বলেন, ৫ আগস্টের পর দুই নেতার বিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। আগে দলে বিভক্তি থাকলেও আলাদা কার্যালয় ছিল না। এখন দুটি কার্যালয় থাকায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন কর্মী-সমর্থকরা। 
২০১৩ সাল পর্যন্ত উপজেলায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল। এরপর দুই দফায় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ মোমরেজুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও নুরুল আমিন বাবুলকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় জেলা বিএনপি। এরপর থেকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে নুরুল আমিনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এ অবস্থায় চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু। 
এদিকে কমিটি না থাকায় বেশির ভাগ নেতা স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েকজনের বিরুদ্ধে হাট, ঘাট, খাল দখলের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি সুবিধায় হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ আছে। এতে দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ অবস্থায় দ্রুত কমিটি গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন বিএনপির সাবেক নেতা আব্দুস সামাদ। 
সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আমিন বলেন, ভিত্তিহীন অভিযোগে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে দলীয় কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না। আশা করছি খুব দ্রুতই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে। তখন গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠনের চেষ্টা করব। 
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোমরেজুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে কয়রায় বিএনপির কোনো কমিটি নেই। কমিটি হলে দলীয় সব বিরোধ মিটে যাবে বলে আশা করছি। 
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু বলেন, কয়রায় কমিটি গঠনের জন্য জেলা বিএনপি থেকে ৫ সদস্যের সার্চ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি নেতাকর্মীর বিরোধও নিষ্পত্তি করবে। দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ একটি কমিটি উপহার দেওয়া হবে।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অ্যান্টার্কটিকায় বিরল স্কুইডের সন্ধান
  • পানিতে ভাসছিল ২২ দিনের শিশুর মৃতদেহ, ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন মা
  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • বাঁধন কাঁদলেন, কিন্তু কেন...
  • মামাত বোনকে ধর্ষণ-হত্যা করে নিখোঁজের গল্প সাজায় নয়ন: পুলিশ
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • আমাদের যত ঘুঘু 
  • বাউন্ডারি সীমানায় ক্যাচের নিয়ম পাল্টাচ্ছে এমসিসি
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
  • কমিটি নেই, সবাই নেতা