একাত্তরের ২৫ মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার। আমি তখন রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে (বর্তমানে সড়ক ও জনপথ) চাকরি করি। আমার বাবাও সরকারি চাকরিজীবী। আমার বয়স তখন সাড়ে ২২ বছর। আমাদের বাসা ছিল আম্বরখানা সরকারি কোয়ার্টারে। প্রায় ৩৬৪টি পরিবারের বাস ছিল ওই কলোনিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই যেন শুরু হয় যুদ্ধের দামামা। আমি নিজেও অফিসে যাইনি ৭ মার্চের ভাষণের পর।
চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ওই দিন বেলা ১১টা। সিলেটের ইতিহাসের সেরা একটি মিছিল প্রত্যক্ষ করি। মিছিলে ছিল সবার হাতে লাঠি। কারও কারও হাতে দেখলাম দেশীয় অস্ত্র। এই মিছিল দেখে আমি নিজে পুলকিত হয়ে পড়ি। এটি ছিল আমার জীবনের সেরা মিছিল। মিছিলটি রেজিস্টারি মাঠ থেকে শুরু হয়ে আম্বরখানা পয়েন্টে এসে জড়ো হয়। সেখানেই সমাপনী বক্তব্য দেন ’৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা.
মিছিলে থাকা হাজার হাজার জনতা স্লোগান দিতে থাকে– জয় বাংলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। স্লোগানে স্লোগানে মুখর আম্বরখানা পয়েন্ট। মিছিলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতা ছিলেন। বলতে গেলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে মিছিলটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ। আমি তখন আম্বরখানা কোয়ার্টারের বাসা থেকে বের হয়ে পাশে থেকেই মিছিলটি প্রত্যক্ষ করি। যেহেতু সরকারি চাকরি করি, তাই কিছু বিধিনিষেধ ছিল। এ ছাড়া পরিবার থেকেও ছিল কোনোভাবেই এসবে না জড়ানোর কঠোর নির্দেশ।
তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা কিংবা ৮টা। কোয়ার্টারে থাকা আমার অনেক সহপাঠী ও বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিই সড়কে ব্যারিকেড দেওয়ার। এর আগে থেকেই খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশে অরাজকতা চালাতে পারে। আমরা কয়েকজন মিলে আম্বরখানা থেকে মজুমদারি হয়ে ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, শত শত লোক সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে পুরোনো রিকশা পুড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। আমরা কয়েকজন সেখানে হাজির হই। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন আখলাকুল আম্বিয়া শাইস্তা, ফয়েজ আহমদ চৌধুরী, সাঈদ উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকে। আমরা সবাই ছিলাম কোয়ার্টারের বাসিন্দা।
এরপর দেখি, বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহর দেখে আমরা বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করি। রাত গভীর হতে শুরু করেছে। তখন ঘড়িতে রাত ১টা। পুরো সিলেট ঘুমিয়ে। অকস্মাৎ যেন খুলে গেল নরকের সব দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সিলেট।
আমরা ভয়ে সবাই ঘরের ভেতরে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকি, যাতে কারও গায়ে যেন গুলি না লাগে। রাত গভীর হওয়ার পর খাটের
নিচ থেকে বের হই। কোয়ার্টারের তিনতলার ছাদে গিয়ে দেখি, পুরো সিলেট যেন আগুনে পুড়ছে। ২৫ মার্চ সারারাত সজাগ থাকি। ২৫ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত আমরা অবরুদ্ধ ছিলাম। ঘরের খাবারও শেষ। এ ছাড়া চুলায় আগুন দেওয়ার লাকড়িও ফুরিয়ে গেছে অনেক পরিবারের। ২৮ মার্চ খাবারের সন্ধানে বের হই আমরা। আম্বরখানা পয়েন্টে এসে দেখি বীভৎস অবস্থা।
পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা এমএলএ ডা. আব্দুল মালেকের বাসার ছাদের ওপর নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে সেখানে লোকজনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। লোকজনকে দেখামাত্রই গুলি করছে। এমনকি বাসাবাড়ির জানালা খোলা দেখলে সেখানেও তারা গুলি ছুড়ছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ডা. মালেকের বাড়ির ছাদে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করে। তারা চলে যাওয়ার পর লোকজন ঘর থেকে বের হতে থাকে। তখন পুরো সিলেটে ছিল পিনপতন নীরবতা। পাকিস্তানি বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের কোয়ার্টারে ৩৬৪ পরিবারে থাকা ১৫/২০টি শিশু ছিল অনেকটা নির্বাক। তারাও যেন বন্ধ করে দিয়েছিল কান্না। ক্ষুধায় কাতর অনেক শিশুও যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি পাখিদের কোলাহলও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
২৮ মার্চের পর খাবারের সন্ধানে গিয়ে কোনো রকমে অল্প খাবার পাই আমরা। সেটি দিয়ে এক দিন পার করি। এরপর খাবার ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। একদিকে মা, অন্যদিকে বাবা। সবার একটাই নির্দেশ, যেন কোনোভাবে ঘর থেকে বের না হই। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। বাসার ছাদের ওপর উঠে দেখি, পাশের বাগানে কয়েকটি পেঁপে পেকে আছে। এরপর গভীর রাতে বিড়ালের মতো চুপি চুপি গিয়ে বাগান থেকে পেঁপেগুলো পেড়ে নিয়ে আসি। ওই পেঁপে খেয়ে আমরা কয়েক দিন কাটিয়ে দিই।
৪ এপ্রিল সিলেটের জিন্দাবাজারে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে হামলা চালায় বর্বর পাকিস্তানিরা। তারা ব্যাংকে লুটপাট চালায়। তখন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তা আট পুলিশ সদস্যকে লাইন ধরে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ৫ এপ্রিল গিয়ে এ অবস্থা দেখে নিজেও অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়ি।
২৫ মার্চ থেকে সিলেটের প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ২৬ মার্চ মিরাবাজারে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারান আবদুস সামাদ ফকির নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। আমার জানামতে, তিনিই ছিলেন সিলেটের প্রথম কোনো শহীদ। এ ছাড়া সম্ভবত শুক্কুর নামে এক রিকশাচালক শহীদ হন আম্বরখানা এলাকায়। তিনি রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন রুটি-রুজির আশায়।
জামালগঞ্জ থেকে বালাট সীমান্ত দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিই । এক পর্যায়ে সেখানে ক্যাম্পে নাম লেখাই মুক্তিবাহিনীর খাতায়। ৩৫ দিনের ট্রেনিং শেষে ক্যাপ্টেন রাওয়ের নেতৃত্বে ৩৫ জনের একটি দল তামাবিল আসে। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিল্লুর রহমান।
সহযোদ্ধা আবদুল মান্নানকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। যে আমাকে ভাত এনে খাওয়াত। সেই মানুষটির রক্তে আমার কোল ভিজেছে। এখনও মনে হলে আঁতকে উঠি। চুয়ান্ন বছরে ভুলতে পারিনি আবদুল মান্নানের স্মৃতি। পাইনি তার পরিবারের সন্ধান। এ ঘটনা আমাকে বড় বেশি কষ্ট দেয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঘটে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। এই দিন ভয়ংকর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় কালরাত এসেছিল বাঙালির জীবনে। এই রাতেই সূচিত হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। যে গণহত্যার নৃশংসতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখেনি বিশ্ব।
অনুলিখন
ফয়সল আহমদ বাবলু
সিলেট ব্যুরো
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২৫ ম র চ ২৮ ম র চ পর ব র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
কালিয়াকৈরে এক মাসে ২০ ডাকাত গ্রেপ্তার
গাজীপুরে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রায়ই রাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ও মহাসড়কে ডাকাতের কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। এসকল ডাকাত সদস্যদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত এক মাসে কালিয়াকৈর থানা ও মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ি অভিযান চালিয়ে ২০ জন ডাকাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। একইসঙ্গে ছয়টি পিকআপও জব্দ করেছে।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সুমন হোসেন ও সোহাগ নামে দুজন ডাকাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ি। এসময় তাদের দখলে থাকা একটি পিকআপ জব্দ করা হয়। পরে গ্রেপ্তারকৃতদের ডাকাতি মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এরআগে, গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের তিন গ্রেপ্তার করা হয়। উপজেলার মৌচাক ফকিরবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকমাস ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। বিশেষ করে কালিয়াকৈর-মাওনা আঞ্চলিক সড়ক ও ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কে তাদের উৎপাত বেশি।
সড়কে পুলিশ টহল থাকলেও ডাকাত সদস্যরা বিভিন্ন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে এরপর সুযোগ বুঝে ডাকাতি করে। এছাড়াও মাওনা কালিয়াকৈর আঞ্চলিক সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতি করে তারা। পুলিশ এরপর থেকেই বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে।
মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) আব্দুস সেলিম বলেন, “ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। তবে আমরা ডাকাতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। গত ১ মাসে আমাদের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ১৫ জন ডাকাত সদস্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং পাঁচটি পিকআপ জব্দ করা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান বলেন, “রাতে আমাদের টহল পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। আমরা গত এক মাসে ২০ জন ডাকাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন তথ্য মিলেছে। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
ঢাকা/রেজাউল/এস