১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে যান। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় আটক থাকা অবস্থায় তাঁর মামলা পরিচালনার জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে শেখ মুজিবের কৌঁসুলি হিসেবে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। লন্ডনে শেখ মুজিবের একটা ‘ইন্ডিয়া কানেকশন’ হয়। সেখানে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর কর্মকর্তা ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর। সংশ্লিষ্ট মহলে তিনি নাথবাবু নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে আসন্ন রাজনৈতিক পালাবদলের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল।
শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এসে তাঁর আস্থাভাজন চার যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে একসঙ্গে কাজ করতে এবং প্রস্তুতি নিতে বলেন। তিনি তাঁর দল আওয়ামী লীগের চেয়েও এই চারজন তরুণের ওপর নির্ভর করতেন বেশি। মুজিবের প্রতি তাঁদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য ছিল।
এ সময় বিএলএফ (বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স) নামটির উদ্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করে ১৯৬০–এর দশকে একটা ‘নিউক্লিয়াস’ কাজ করত। তাঁরা একটা ফোরাম তৈরি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। যদিও এর কোনো দালিলিক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর তৈরি হলো বিএলএফ। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমাদের রাজনৈতিক সংগঠন হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং সামরিক সংগঠন হলো বিএলএফ।’
তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিএলএফের জন্ম ১৯৬৯ সালের শেষে অথবা ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে। ওই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্লোগানগুলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো, ‘জাগো জাগো/ বাঙালি জাগো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা/ বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা/, ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এরপর এল আরও দুটো স্লোগান, ‘জয় বাংলা’ এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ দেশে তখন জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের একতলায় মেয়েদের কমনরুমের সামনের করিডরের দেয়ালে ছোট করে কেউ লিখে দিয়েছিল, ‘বিএলএফে যোগ দিন’।
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি ছাত্রলীগের বাছাই করা একদল কর্মীর অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার কথা। শেখ মুজিব নিজেই এর আয়োজন করেছিলেন। কলকাতা থেকে যোগাযোগ করতেন ‘র’-এর অপারেটিভ চিত্তরঞ্জন সুতার। তাঁর বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। কলকাতার ভবানীপুরে একটা তিনতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল ‘র’। সুতার এই বাড়িতে সপরিবার থাকতেন। মুজিবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হতো সিরাজগঞ্জের তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং একসময় ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু হেনার মাধ্যমে।
শেখ মুজিব ভেবেছিলেন, ইয়াহিয়া নির্বাচন দেবেন না। দেশ স্বাধীন করার জন্য ছাত্রলীগের কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে একটি ব্যাচের বাছাই প্রক্রিয়াধীন ছিল। ১৯৭০ সালের আগস্টে মুজিবের মনে এই প্রতীতি জন্মে যে নির্বাচন হবে। তখন প্রশিক্ষণ স্থগিত করা হয়। বলা হয়, এখন এটার আর দরকার নেই।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পায়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই সংবিধান প্রশ্নে অচলাবস্থা দেখা দেয়। মুজিবের মনে আশঙ্কা, সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হবে না।
১৮ ফেব্রুয়ারি মুজিব তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের চার সদস্য—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং চার যুবনেতা—মনি, সিরাজ, রাজ্জাক ও তোফায়েল। হাইকমান্ডের অপর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ উপস্থিত ছিলেন না কিংবা তাঁকে ডাকা হয়নি। শেখ মুজিব কাগজে একটি ঠিকানা দেখিয়ে তাঁদের মুখস্থ করান। এরপর কাগজটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেন, দরকার পড়লে তাঁরা যেন ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করেন। ঠিকানাটি হলো—সানি ভিলা, ২১ রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। পাকিস্তানের রাজনীতির হাওয়া দেখে মুজিব কয়েকটি ‘অপশনের’ কথা ভেবে রেখেছিলেন। এটি ছিল তার একটি।
শেখ মুজিবুর রহমান.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।