মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মানিকগঞ্জের তরা ঘাটে মানুষের হাতে লোহার পেরেক গুঁজে, পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিন পর এক ফল বিক্রেতা কলার সঙ্গে বিষ খাইয়ে পাকিস্তানি সেনাকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। দুটি ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মো. মাইন উদ্দিন; কিন্তু কোনো দিন তাঁর কাছে কেউ জানতে চাননি এসব কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ঘটনাগুলোর এমন স্মৃতিই তুলে আনতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাঁরা সংগ্রহ করেছে ৫৫ হাজারের বেশি এমন সব স্মৃতিভাষ্য। তৃতীয় প্রজন্মের কলমে উঠে আসা এই ঘটনার ক্রমিক নম্বর ৪৪ হাজার ৯০২।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে প্রতিষ্ঠানের আছে বছরব্যাপী সাতটির বেশি ধারাবাহিক উদ্যোগ। গত দুই যুগে এই প্রতিষ্ঠান দেশের ১৫ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে।

গল্প তুলে আনেন শিক্ষার্থীরা

‘ছাত্র-ছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য’ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ১২ খণ্ডে প্রায় দুই হাজারের বেশি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থের সহযোগী সম্পাদক সত্যজিৎ রায় মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানের সামনে বাবাকে দুই ভাগ করা, নিজের শরীরের মাংস কেটে খেতে বাধ্য করা, জীবিত মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া; এমন সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিকের গল্প তুলে এনেছেন এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। এটি বিশাল আর্কাইভ।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সবচেয়ে সফল দুটি কর্মসূচি হচ্ছে ‘আউটরিচ’এবং ‘রিচ আউট’ কর্মসূচি। আউটরিচ কর্মসূচি হলো ঢাকা শহর ও এর আশপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। রিচ আউট কর্মসূচি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিদর্শন করানো। এই দুই মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি নিয়ে ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভবত পৃথিবীর সবচাইতে বেশি মৌখিক গল্পের সংগ্রহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। এত সংগ্রহ হলোকাস্ট মিউজিয়ামেরও নেই বলে মনে হয়।

জাদুঘর পরিদর্শন

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে বানানো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আছে ১৫ হাজারের বেশি স্মারক। চারটি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী এই স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীসহ দুর্লভ সব আলোকচিত্র,দলিল ও চিঠিপত্র। জাদুঘর নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে। শিক্ষার্থীরা এখানে ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র দেখেন। এই কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে।

আউটরিচ কর্মসূচির নেটওয়ার্কের শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে এসে শিক্ষার্থীরা যাঁরা আসতে পারেন না, তাঁদের কাছে গিয়ে গল্পগুলো বলেন। একজনের অভিজ্ঞতা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।

গত বছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারি পরিদর্শন করেছেন ষাট হাজারের বেশি মানুষ।

ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর

প্রতিষ্ঠানের দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের প্রতিটি জেলায় গিয়ে এক মাস করে থাকে। এ সময়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো দেখে। ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের সঙ্গে থাকেন একজন শিক্ষক। যিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এখন পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে এ কার্যক্রম।

এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দুটি এরই মধ্যে সারা বাংলাদেশের সব জেলায় একবার করে ভ্রমণ করেছে। তরুণদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক তৈরি করতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আছে পাঠ কর্মসূচিও।

‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ’

তিন মাসব্যাপী বই পাঠের এই উদ্যোগের সূচনা হয় ২০২৩ সালে। একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি প্রয়াত আলী যাকেরের স্মৃতি রক্ষায় জাদুঘর ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ’ গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বই পড়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন ঢাকা মহানগরের ১০টি এবং সারা দেশের ৪৬টি পাঠাগারের শিক্ষার্থী, সদস্যরা। তাঁদের কাছ থেকে ৫৪৮টি প্রতিক্রিয়া জমা হয় গত বছর।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস (সিএসজিজে)। সিএসজিজে গণহত্যা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা–সংক্রান্ত জাতীয়–আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এবং গবেষণা কেন্দ্র। আছে জাদুঘরের ফিল্ম সেন্টার।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংযুক্তি ঘটিয়ে দেওয়াই জাদুঘরের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

রাজধানীর সেগুনবাগিচার পুরোনো একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সেগুনবাগিচার পুরোনো বাড়ি থেকে জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়ে আগারগাঁওয়ে যায় ২০১৭ সালে। শুরু থেকে মানুষের ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তার কথা জানিয়েছেন জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, ‘যে শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিষে হত্যা করা হয়েছিল, তার কাছেও দায় আছে আমাদের।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ জ দ ঘর র র ম ক ত য দ ধ জ দ ঘর প রথম আল ক ব যবস থ প রজন ম

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে এবার জামায়াতের বিক্ষোভ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিজয়নগর উপজেলা জামায়াতের উদ্যোগে ‍উপজেলার চান্দুরা এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২টি আসনসহ দেশের মোট ৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাথমিক গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন সদর ও বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল। নতুন গেজেটে বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়ন—হরষপুর, চান্দুরা ও বুধন্তি ইউনিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। ওই ইউনিয়ন তিনটিকে আগের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের মধ্যে রাখতে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন বিজয়নগর উপজেলার চার বাসিন্দা।

আজকের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা জামায়াতের সভাপতি লুৎফর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্রু সরকার, চান্দুরা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি সোহাগ খন্দকার, চান্দুরা হেফাজতে ইসলামের সহসাংগঠনিক সম্পাদক শিহাব সিদ্দিকী, চান্দুরা ইউনিয়ন যুব খেলাফত মজলিসের সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমদসহ আরও অনেকে। তারা আধা ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩টিতে প্রায় ৯৬ হাজার ভোটার আছেন, যা উপজেলার মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। দুই লক্ষাধিক ভোটারবিশিষ্ট উপজেলা একক সংসদীয় আসনের উপযুক্ত হলেও বছরের পর বছর ধরে এটিকে একবার সদর, একবার সরাইল, আবার কখনো নাসিরনগরের সঙ্গে যুক্ত করে অবহেলার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে।

তিনটি ইউনিয়নকে আগের আসনে রাখার দাবিতে উপজেলার গোলাম মোস্তফা, এ কে এম গোলাম মুফতি ওসমানী, মো. জাহিদুজ্জামান চৌধুরী ও মো. বায়েজিদ মিয়া স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদন গতকাল দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

আরও পড়ুনব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ১৭ ঘণ্টা আগে

এর আগে গতকাল বিকেলে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কর্মসূচিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন অংশগ্রহণে বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। এ সময় তাঁরা আধা ঘণ্টার মতো সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগান দেন। একই স্থানে আজ বিকেলে একই দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ করার কথা আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ