বিতরণে ঘুষ লেনদেন, হদিস মিলছে না বহু যন্ত্রের
Published: 27th, March 2025 GMT
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সরকারি ভর্তুকিমূল্যে দেওয়া বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র কৃষকদের মাঝে বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে এসব যন্ত্র দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি, দালালদের। এ জন্য কৃষি কর্মকর্তাকে প্রতিটি যন্ত্রের জন্য দিতে হয় অর্থ। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছেন খোদ মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল। এমন পরিস্থিতিতে বিতরণ হওয়া বেশিরভাগ যন্ত্রের হদিসও মিলছে না।
জানা গেছে, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় হাওর অঞ্চলে ৭০ শতাংশ এবং সমতল অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে সরকারি অর্থায়নে সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয় প্রায় ৬ কোটি ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি। কিন্তু সরেজমিনে মাঠ পর্যায়ে এর বেশির ভাগ মেশিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
কৃষি যন্ত্রপাতি লাপাত্তা হওয়ার পেছনে মূল হোতা মির্জাপুর উপজেলা কৃষি অফিসের সাবেক কৃষি অফিসার সঞ্জয় কুমার পাল। তার সঙ্গে রয়েছেন উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল হালিম ও নৈশপ্রহরী অরুণ কুমার সরকার।
সংশ্লিষ্ট নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সরকার থেকে ২১টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার দেওয়া হয়। কিন্তু বিতরণ করা হয় মাত্র ছয়টি। এসব যন্ত্রের মূল্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ২টি রিপার বাইন্ডার, ১৫টি বেড প্লান্টার, ২৪টি পাওয়ার থ্রেসার, ৩টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ২টি পাওয়ার টিলার চালিত সিতার, ১টি মেইজ শেলার এবং ২টি পাওয়ার উইডার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব যন্ত্র বিতরণ করা হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে ২ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। এছাড়া সুবিধাভোগী কৃষক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা অনেকেই কৃষক নন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষিযন্ত্র সরবরাহের আগেই কৃষকের সঙ্গে কৃষি অধিদপ্তরের একটি চুক্তিপত্র করতে হয়। ওই চুক্তিপত্রে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ তিনজন এবং কৃষকের পক্ষে তিনজন সাক্ষীর স্বাক্ষরের পর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে মেশিন সরবরাহ করার কথা।
কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিতরণে অনিয়ম বড় ধরনের। একটি মেশিনে দুই লাখ থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয় সরকার। কৃষি কর্মকর্তা তার পছন্দের কৃষক নির্বাচন করে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে ডাউন পেমেন্ট ৮ লাখ টাকা দিয়ে মেশিন এনে কৃষককে বুঝিয়ে দেন। কৃষকের প্রাপ্তি স্বীকার নিয়ে কোম্পানি সরকারের ভর্তুকির টাকা আবেদন করে আদায় করে থাকে। এরপরে কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে ওই মেশিন বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে নেন দুই পক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যারা মেশিনের জন্য আবেদন করেন তাদের মেশিন দেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু কেউ মেশিন নিয়ে কাজে লাগান আবার কোম্পানির লোকজন এই মেশিন দিয়ে ব্যবসা করেন।
ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য এসিআই মোটরস লিমিটেড, আদি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, মেটাল অ্যাগ্রিটেক লিমিটেড, বাংলা মার্ক, এসকিউ অ্যাগ্রিকালচার লিমিটেড ও কৃষিবিদ অ্যাগ্রিকালচার লিমিটেডসহ ৩৪ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর এসব কোম্পানির সঙ্গে কৃষকরা চুক্তি করার আগে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিভিন্ন কোম্পানির লোকদের সঙ্গে দেন-দরবার শুরু করেন কে কত দেবেন। যে বেশি টাকা দেবে সেই কোম্পানির মেশিনই সরবরাহ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কৃষকদের মাঝে কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। কোনো রকম অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। অনেক কৃষক যন্ত্র বরাদ্দ পেয়ে বিক্রি করে দিতে পারেন। ফলে অনেক যন্ত্র হয়তো মাঠে নেই।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র জ প র উপজ ল কর মকর ত ক ষকদ র সরবর হ ভর ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।