ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নিজ জেলা সাগাইংয়ের দিকে ছুটছিলেন মান্দালয়ে অবস্থান করা কো জেয়ার। চারপাশে বিধ্বস্ত ভবন, ফেটে যাওয়া রাস্তা ও বিশালাকারের অনেক গর্ত দেখেছেন তিনি। সাধারণত মান্দালয় থেকে সাগাইং যেতে ৪৫ মিনিট লাগে। ভাঙা সেতু ও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার কারণে তাঁর পুরো ২৪ ঘণ্টা লেগেছে সেখানে পৌঁছাতে।

কো জেয়ারের পরিবারের বসবাসের ভবনটি ধসে পড়লেও, আগেই বেরিয়ে আসায় তারা সবাই নিরাপদে আছেন। তবে শহরের অন্য সবার ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। তাঁর বন্ধু ও প্রতিবেশীদের অনেকেই মারা গেছেন। পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা সামান্য সরঞ্জাম নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামরিক শাসনে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকা দেশটির এমন অনেক অঞ্চলেই পর্যাপ্ত সহায়তা পৌঁছাচ্ছে না।

মিয়ানমারে হওয়া শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে সাগাইং শহর, রাজধানী নেপিদোসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছে। এরই মধ্যে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪৫। আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ধার যন্ত্র ও লোকবলের সংকটে ভূমিকম্পের ছয় দিন পেরোলেও এখনও অনেক এলাকায় সরকারি উদ্ধার তৎপরতা নেই বললেই চলে। দেশীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আটকে পড়াদের উদ্ধারে যৎসামান্য চেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয়রা। ‘মৃতদেহের গন্ধ পুরো শহরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে’ বার্তা সংস্থা সিএনএনকে বলেন কো জেয়ার। গণকবর খুঁড়তে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি হারানো মানুষ দিন কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। সবার ভাগ্যে তাঁবুও জোটেনি। কারও কারও ঠাঁই হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। যেখানে তীব্র গরমের সঙ্গে প্রচণ্ড মশার উৎপাত তাদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তারা।

ভূমিকম্পে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের আবাস– এমন একটি অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়িঘর, হাসপাতাল, বিদ্যালয়সহ হাজারো ভবন ধসে পড়েছে। এতে বিস্তীর্ণ এক অঞ্চল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। জাতিসংঘ বলছে, চার বছর আগে শুরু গৃহযুদ্ধের কারণে মিয়ানমারে ২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। এর মধ্যে ভয়াবহ ভূমিকম্প দেশটির মানুষের জীবনে আরও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ভূমিকম্পের পর নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। দেশটির মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১০ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়েছে, নয়তো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বিপর্যয়ের পরও মিয়ানমারের সামরিক সরকার কার্যকর কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে না। ‘বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও কেন তারা উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছে না’– এমন প্রশ্ন তোলেন জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি ইয়াংহি লি। ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজধানী নেপিদোও। সরকারি ভবন, হাসপাতাল, রাস্তা, সেতু ও কর্মচারীদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মান্দালয়ে ২ হাজার ৫৩ জন এবং নেপিদোতে মারা গেছেন ৫১১ জন। 

ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সহায়তার আবেদন করলেও ত্রাণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে। দেশটিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে, বিদেশি ত্রাণ সংস্থাগুলোর জন্য কড়া অনুমতি নেওয়ার নিয়ম চালু করেছে তারা। এতে সাগাইংয়ের মতো বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত সাহায্য পৌঁছাচ্ছে না। এমনকি সেনাদের বিরুদ্ধে ত্রাণ জব্দ করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ভ ম কম প ত হয় ছ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আদালতে ঝুলছে ২২ হাজার মামলা

সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ১৩টি শ্রম আদালতে মামলাজট কমছে না। মামলার তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় বাড়ছে জট। আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। তবে ১৩টি শ্রম আদালতে ৬ মাসের বেশি হয়েছে এমন ১৩ হাজার ৪০২টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।  

শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে সব শ্রম আদালত ও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২২ হাজার ৭৩৭টি। ওই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৮৮টি মামলা। এর মধ্যে ৬টি বিভাগীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন ৫০৫টি মামলা। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের সব শ্রম আদালতে বিচারাধীন ছিল ২১ হাজার ৬১টি মামলা। 
বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারক সংকট, মামলা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার না করা এবং আইনজীবী ও মালিকপক্ষের বারবার সময় নেওয়ার প্রবণতার কারণে মামলা নিষ্পত্তির গতি কমে গেছে। 

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, ‘কয়েকটি শ্রম আদালতে বিচারকের সংখ্যা মামলার তুলনায় অপ্রতুল। অনেক সময় মামলার নথি প্রস্তুত বা সাক্ষী হাজির করার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হয়, যে কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যাচ্ছে।’ তাঁর মতে, মামলার আধিক্য অনুযায়ী শ্রম আদালতের কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। তা না হলে শ্রম আদালতের প্রতি শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ আস্থা হারাবে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় শ্রম আইন দ্রুত যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। 

ঢাকার আদালতে ভয়াবহ জট

পরিসংখ্যান বলছে, শ্রমিকদের করা ১০ হাজার ৫৮৯টি মামলা ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে ঝুলে রয়েছে। মার্চ মাসের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ১ম শ্রম আদালতে বিচারাধীন ৪ হাজার ৬৭৬টি মামলা। ওই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৭১টি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন যথাক্রমে ৩ হাজার ২৯৯ এবং ২ হাজার ৬১৪টি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে যথাক্রমে ১২৫ ও ৭৩টি। 

চট্টগ্রামের চিত্র অনেকটা একই রকম। প্রথম শ্রম আদালতে ১ হাজার ৩৭৬টি এবং দ্বিতীয় আদালতে ৫৫৪টি মামলা বিচারাধীন। চট্টগ্রামে মোট বিচারাধীন ১ হাজার ৯৩০টি মামলার মধ্যে মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৭টি। ওই মাসে হয়েছিল ৫২টি মামলা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রম আদালতে যথাক্রমে ২ হাজার ১৩৩ এবং ৫ হাজার ৫২৮টি মামলা বিচারাধীন। মার্চ মাসে এ দুই আদালতে নিষ্পত্তি হয় ৪২৩টি মামলা; একই সময়ে করা হয়েছিল ২০৮টি মামলা।

অন্য ৬টি  আদালতের চিত্র

বর্তমানে খুলনায় ৯১টি, রাজশাহীতে ৭৩, রংপুরে ৭৫, সিলেটে ৪৮, কুমিল্লায় ১৫২ এবং বরিশালে ৬৬টি মামলা বিচারাধীন। এ ৬টি বিভাগীয় শ্রম আদালতে সব মিলিয়ে বিচারাধীন ৫০৫টি মামলা।

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালেও ঝুলছে অনেক মামলা

শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায় বা যে কোনো আদেশের বিরুদ্ধে মালিক বা শ্রমিকের আপিল করার সুযোগ আছে। এজন্য আইন অনুযায়ী ঢাকায় গঠিত হয়েছে একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। একটিমাত্র ট্রাইব্যুনাল থাকায় দেশের বিভাগীয় বা জেলা আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও এর বিরুদ্ধে আপিল দায়ের বা শুনানির জন্য সংক্ষুব্ধ পক্ষকে (মালিক বা শ্রমিক) ঢাকায় আসাতে হয়। তবে অনেক শ্রমিকই ঢাকায় এসে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেত উৎসাহী হন না। আবার মামলা জটের কারনেও শ্রম আদালতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিকদের। একইভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখে। এতেও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয় এবং শ্রমিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। 
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ হাজার ২২৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৪১টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ৬ মাসের বেশি হয়েছে এমন মামলা শ্রম আপিল ট্রাইবুন্যালে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৮২২টি। 

বিচার পেতে বছর গুনছেন শ্রমিকরা

রূপগঞ্জের গার্মেন্ট শ্রমিক মনিরা আক্তার বকেয়া বেতন ও ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ দাবিতে ২০১৮ সালে ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা করেন। এখন পর্যন্ত পাঁচবার বিচারক বদল হয়েছে এবং মামলার সাক্ষ্য পর্বই শেষ হয়নি। মনিরা বলেন, ‘আগে মামলার খোঁজখবর রাখতাম। শুধু তারিখ দেয়। বিচারক থাকেন না। মালিকপক্ষের আইনজীবীও বারবার সময় নেন। এখন আর খবর নিই না। সারাদিন আদালতে ঘুরলে চাকরি থাকত না।’

জনবল সংকট

আপিল ট্রাইব্যুনাল ও ১৩টি শ্রম আদালতে বর্তমানে ৫৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি শ্রম আদালতে রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। তাই এসব আদালতে আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ, মামলা করা, কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তি করাসহ নানা ক্ষেত্রে মামলা-সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি হচ্ছে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. হেদায়েতুল ইসলাম সমকালকে বলেন, শূন্য পদ পূরণে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।  বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর আইন উপদেষ্টা (অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ) এসএম রেজাউল করিম বলেন, ‘শ্রম মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে সচেতন হতে হবে। আইনে বলা আছে, সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। বাস্তবে তা হয় না। আইনজীবীরাও মামলা দীর্ঘায়িত করেন। অনেক সময় শ্রমিকপক্ষ উপস্থিত থাকে, অথচ মালিকপক্ষ বারবার সময় নেয়।’

তিনি আরও বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়টিও দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। এটি দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।’

এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘শ্রম আইন সংশোধনের জন্য আমরা চার-পাঁচ মাস ধরে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। শ্রম কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমরা সেটি এবং খসড়া আইন পর্যালোচনা করছি। আশা করছি, 
জুলাই-আগস্টের মধ্যে নতুন আইন প্রণীত হবে।’ সচিব আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, আদালত পুনর্বিন্যাস ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থার কথা নতুন আইনে থাকছে। এতে হয়রানি কমবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ