চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ—এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। জাতীয় নীতিমালা, দক্ষ জনবল, অবকাঠামো, শিক্ষা-গবেষণা ও উদ্ভাবন, বাজার তৈরি, যথাযথ অর্থায়ন এবং কার্যকর ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন–আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত বাস্তবায়ন সম্ভব। আর একুশ শতকের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় ধরে জাতির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ প্রচেষ্টায় দেশের আইটি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, যা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

রোবোটিকসের মতো আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে একই সূত্রে বাঁধতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবননির্ভর কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি—এই দায়িত্ববোধ থেকেই দেশের অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশে ২০১৯ সাল থেকে রোবোটিকস প্রযুক্তিতে সক্ষমতা অর্জনে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে স্পেকট্রাম যুগান্তকারী রোবোটিকস সিস্টেম ‘যন্ত্র সৈনিক’ উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

যন্ত্র সৈনিক একটি বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, যা যুদ্ধক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী মিশনে ব্যবহারের উপযোগী এই রোবট সৈনিকদের জীবনের ঝুঁকি কমিয়ে আনবে। জীবন ও সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।

যন্ত্র সৈনিক রোবট তৈরির এই যাত্রার সূচনা হয় ২০১৯ সালের শেষ দিকে। সেই সময় স্পেকট্রামের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা চীনের রোবটশিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোবট নির্মাণ কারখানা পরিদর্শন করেন। তাঁরা জানতে পারেন, জাপানের প্রযুক্তিকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিকভাবে প্রয়োগ করে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে চীন। এসব তথ‍্যলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবনের উৎসাহ সৃষ্টি করে। স্পেকট্রামের প্রযুক্তিবিদদের মনোজগতে জেগে ওঠে দেশের জন‍্য নতুন কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা; তাঁরা তখন নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করেন, আমরা কি এমন কিছু তৈরি করতে পারব? কীভাবে তৈরি করব? কার জন্য তৈরি করব? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাঁরা মনোনিবেশ করেন রোবোটিকসের জগতে।

লক্ষ্যে অটুট থাকলে সেটি অর্জনের সুযোগও আসে, আর এ ক্ষেত্রেও সেই সুযোগ এল। বাংলাদেশের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উন্নত দেশ থেকে এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল (ইওডি) রোবট আমদানি করে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ইন্সপেক্টরেট অব ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস (আইইএন্ডআই) এসব রোবট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। স্থানীয় মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের রোবট তৈরি করা যায় কি না, সে বিষয়ে আইইঅ্যান্ডআই অনুসন্ধান করছিল।

তারা জানতে পারে, স্পেকট্রাম এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ শুরু করে। তারা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি ও বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবসা করে উচ্চ প্রযুক্তির রোবট তৈরির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করবে। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি রোবট তৈরি করা হবে, যা স্পেকট্রাম ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে অর্থায়ন করবে এবং এটি জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে ব্যবহৃত হবে।

দেশের আইটি সেক্টরে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্পেকট্রাম স্বল্পতম সময়ে স্থানীয় প্রতিভাবান ও উদ্যমীদের নিয়ে একটি দল গঠন করে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে সক্ষম হয়। শুরু হয় বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর জন‍্য রোবট তৈরির কার্যক্রম। স্পেকট্রামের উদ্যমী দলটির কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে ২০২১ সালে একাধিক পরিমার্জনার পর রোবট তৈরির এ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে এর সক্ষমতা যাচাই করা হয়। উন্নত দেশ থেকে আমদানি করা রোবটের সঙ্গে তুলনামূলক পরীক্ষা করে দেখা যায়, এটি অনেক ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট পারফর্ম করছে। গুণগত মান নিশ্চিত করার পর এটি জাতিসংঘের কঙ্গো মিশনে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও আইটি শিল্প খাতের সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্পেকট্রাম উন্নত সংস্করণের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট—যন্ত্র সৈনিক ভি ১.

০ তৈরি করেছে। বর্তমানে এ রোবট আফ্রিকায় বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা মিশনগুলোয় নিয়োজিত, যা আমাদের দেশের প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। উপরন্তু, অন্যান্য দেশও এ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ইতিমধ্যে পেরুর সেনাবাহিনী এ রোবট ব্যবসা করছে।

যন্ত্র সৈনিক রোবট শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়; এটি বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশও বটে। এখন বিষয়টি স্পষ্ট যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য দেশ আমাদের এই প্রযুক্তি আগ্রহসহ গ্রহণ করেছে এবং ব্যবহার করছে। অন্য দেশের সঙ্গে যন্ত্র সৈনিক বিনিময় করে বাংলাদেশ শুধু প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে না, বরং আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে শক্তিশালী করে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করছে।

রোবোটিকসে এ সফলতাকে আরও সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং এর কার্যক্রমগুলোকে স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে স্পেকট্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় উচ্চ প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) জন্য ‘সাইবারনেটিকস হাইটেক সলিউশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।

স্পেকট্রামের রোবট তৈরির প্রকল্পের শুরু থেকেই যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও আইবিএর প্রাক্তন শিক্ষার্থী রাশেদ নোমান চৌধুরী (বোয়িং ও জেনারেল মোটরসে ১৭ বছরের কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন), ৩০ বছরের মার্কেটিং এক্সপার্ট ঢাকা ইউনিভার্সিটির এমবিএ আমিনুল কাদের খালিলি, বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার ও আইবিএ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী রায়হান উর রশীদ (আইইইই বাংলাদেশের সংগঠক) এবং বুয়েট থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ গবেষক ফাইয়াজ আহমেদ তন্ময়। বর্তমানে ২৫ জনের বেশি গবেষক এ প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরো এই উদ্যোগের পেছনে ছিল স্পেকট্রামের দূরদর্শী নেতৃত্ব, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সস্তা শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সই প্রধান আয়ের উৎস। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের ভ্যালু চেইনে প্রবেশ করতে হবে। টেকসই উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে আরও বেশি উদ্যোগ প্রয়োজন।

উচ্চ প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী উৎপাদনশীল প্রজন্ম প্রয়োজন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সহায়ক শিল্প খাত গড়ে তুলতে হবে। আমাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য হলো ‘চিপ থেকে সিলিকন, এআই থেকে মেশিন ডিজাইন’ পর্যন্ত সমগ্র প্রযুক্তি উৎপাদনপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা। যন্ত্র সৈনিক তৈরির মাধ্যমে স্পেকট্রাম সেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে গেছে এক ধাপ এবং চূড়ান্ত লক্ষ‍্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ফোরকান বিন কাশেম ব্যবস্থাপনা পরিচালক

স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম প্রাইভেট লিমিটেড

ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ক ষ আম দ র গ রহণ ব যবস ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ