মিয়ানমারে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা হাজার হাজার। ধর্ম–বর্ণ–ধনী-গরিবনির্বিশেষে কেউ ছাড় পায়নি। দেশের মধ্যাঞ্চলেই ক্ষয়ক্ষতি বেশি। বিশেষ করে মান্দালয় অঞ্চলে।
মান্দালয় ও পাশের অমরাপুরা মিয়ানমারের পুরোনো রাজধানী। ফলে এখানে আছে পুরোনো দিনের অনেক স্থাপনা। আবার ভূমিকম্পের কেন্দ্রও ছিল এই শহরের খুব কাছে। ফলে মান্দালয়ের অবস্থা হয়েছে আণবিক বোমা পড়ার পর হিরোশিমা-নাগাসাকির অবস্থার মতো।

মিয়ানমারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের মুসলমান পরিবারগুলো ভূমিকম্পে বাড়তি বিধ্বস্ত। ভূমিকম্প আঘাত হানে শুক্রবার জুমার সময়। এই অঞ্চলের প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষদের বড় অংশ এ সময় মসজিদে ছিলেন। জুমা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদেই পড়ার রেওয়াজ। আবার ভূমিকম্পের দিনটি ছিল রোজার মাসের শেষ জুমাবার। ফলে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল স্বাভাবিক জুমার চেয়ে বেশি।

ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল দুপুরে নামাজের সময়ে। মুসল্লিরা কেউ মসজিদে এ সময় ছিলেন রুকুতে, কেউ সিজদায়, কেউবা মোনাজাতে। কোথাও নামাজ সবে শুরু হচ্ছিল। মধ্য মিয়ানমারের মসজিদগুলোও অধিকাংশ পুরোনো আমলের তৈরি।

ভূমিকম্পের আঘাতে স্থাপনাগুলো সহজেই ভেঙেচুরে পড়ে যায়। দুই দফা কম্পন হয়। প্রথম কম্পনে বেঁচে যাওয়ারা যখন আহত ব্যক্তিদের সরাচ্ছিলেন, তখন আরও জোরের দ্বিতীয় কম্পন হয়। ফলে ইতিমধ্যে বেঁচে যাওয়ারাও আহত-নিহত হন।

ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডি। মুসলমান পল্লিগুলোতে শোকের মাতম যেন খানিকটা বেশিই। বিধবাদের কান্নায় ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। অনেক পাড়ায় মৃতদের দাফন-কাফনও আটকে ছিল অনেকটা সময়। কারণ, একদিকে পুরুষ মানুষের অভাব, অন্যদিকে এসব অঞ্চলে সরকার বলে কিছু নেই এখন। গৃহযুদ্ধের কারণে সামরিক বাহিনী উদ্ধার তৎপরতার জন্য আসতেও সাহস পাচ্ছে না। স্থানীয় মানুষের কাছে তারা খুবই ঘৃণিত সংস্থা। ফলে রাষ্ট্রীয় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতাও এখানে খুব অল্প।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মান্দালয় ও সাগাইংয়ের মাঝ দিয়েই বইছে মিয়ানমারের প্রাণরেখা ইরাবতী নদী। ইরাবতীর পশ্চিমে হলো সাগাইং এবং পূর্বে মান্দালয়। সাগাইংয়ে রয়েছে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা।

এই নদীর দুই দিকে আগে থেকেই অনেক মুসলমান বসতি। এখানকার মুসলমানদের বাহ্যিক দিক দেখে বাংলাদেশের মতো বোঝা যায় না। তবে মসজিদ দেখে আশপাশের জনবসতির ধরন টের পেতে হয়। মসজিদগুলোও স্থাপত্যে বাংলাদেশ-ভারতের চেয়ে ভিন্ন। বামার স্থাপত্য নকশায় সেগুলো তৈরি। মসজিদগুলো এখানে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যাপীঠ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

এ রকম অনেক মসজিদই এখানে রাজা বোধাপায়ার আমলে তৈরি। অমরাপুরা যখন ১৭৮৩ সালে রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়, সেই বোধাপায়ার আমলে রাজদরবারে মুসলমানদের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কেবল বাংলা নয়, সুদূর আফগানিস্তান থেকেও এখানে অনেক মুসলমান এসেছেন তখন। এ সময় মান্দালয়-অমরাপুরা সড়কজুড়ে কিছু পরপরই অনেকগুলো মসজিদ তৈরি হয়। কিছু দরগাহও আছে এদিকে। এখানেই আছে বিখ্যাত আবিদ হুসাইনির লিঙ জিঙ গোয়ে দরগাহ। মান্দালয়ে রাজা মিঙদিনের আমলে রাজপ্রাসাদের ভেতরও মসজিদ ছিল। সেসময় বার্মিজ মুসলমানদের মক্কায় হজের সময় থাকার জন্য সেখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন এখানকার রাজা। বলা বাহুল্য, সেসব দিন এখন একান্ত অতীতের বিষয়।

এখানকার টিকে থাকা মসজিদ ও দরগাহগুলো সংস্কারের প্রতি পরবর্তী সময়ের বামার জাতীয়তাবাদীদের খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। এমনকি মুসলমানরা নিজেরা সেসবের সংস্কার করতে চাইলেও অনুমতি পাওয়ার সমস্যা ছিল। ২০১২-১৩ থেকে এসব বিষয়ে একধরনের বিদ্বেষই দেখা যেতে শুরু করে।

এরপরও অনেক মুসলমান স্থাপনা টিকে ছিল এদিকে। কিন্তু এবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আরাকানের বাইরে মিয়ানমারজুড়ে মুসলমানের সংখ্যা কত—এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কামিয়ান ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সম্প্রদায়কে এখানে পৃথক ‘জাতি’সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তবে অনেক সংস্কৃতির মুসলমান আছেন দেশজুড়ে। সরকার জাতি হিসেবে স্বীকার না করলেও কেন্দ্রীয় এই অঞ্চলে মুসলমানরা নিজেদের ‘বার্মিজ মুসলমান’ বলে উল্লেখ করে থাকে।

স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি মিলে আরাকানের বাইরে এ রকম ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা হবে অন্তত ১৫ লাখ। এর বড় একাংশ রেঙ্গুন এবং আরেক অংশ ইরাবতীর দুই পাড়ে থাকতেন। মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে শান্তিতে থাকতে পারতেন। তবে ভূমিকম্প এবার এ রকম মানুষদের বড় সংখ্যায় উদ্বাস্তু করেছে। বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়িয়েছে বিপুল।

রেঙ্গুন থেকে এক বন্ধু জানালেন সাগাইং ও মান্দালয়ে অন্তত এক হাজার মুসলমানের মারা যাওয়ার খবর মিলছে। সামনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কিছু অঞ্চল এখনো স্বাভাবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রথম তিন দিন সাগাইংয়ে কোনো উদ্ধার তৎপরতাই ছিল না বলা যায়। কারণ, বাড়িঘরের চার ভাগের তিন ভাগই পড়ে গেছে।

রেঙ্গুন সূত্রে পাওয়া খবর হলো, মসজিদ বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত এক শ। তবে এই তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা যাচাইয়ের সুযোগ নেই।

সরকারি উদ্ধার তৎপরতার অনুপস্থিতির মাঝে মালয়েশিয়া থেকে একদল উদ্ধারকারী এসে মান্দালয় ও সাগাইংয়ে বিধ্বস্ত মসজিদের সুরকির নিচে থেকে মৃতদেহ বের করছে। উদ্ধারকর্মীদের সর্বশেষ হিসাবে ইরাবতীর দুই পাড়ে বিধ্বস্ত হয়নি এমন মসজিদ পাওয়া দুষ্কর। বলা বাহুল্য, বৌদ্ধদের অনেক প্যাগোডাও এই দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে মৃতের সংখ্যা মুসলমানদের মতো নয়। কারণ, দুপুরে সেখানে মসজিদের মতো জনসমগাম ছিল না। তবে বৌদ্ধ ধর্মালয়ের কিছু আবাসিক ভবন ধসে অনেক শিক্ষার্থী মারা গেছেন এদিকেও। এর বাইরেও ধর্ম–জাতিনির্বিশেষে মৃতের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এ মুহূর্তে সাড়ে তিন হাজারের মতো। তবে মৃত্যুর চেয়েও ধ্বংসলীলাই ঘটেছে সীমাহীন। আশপাশের অঞ্চলের মধ্যে পঁচাত্তর বছর আগে কেবল আসামে এ রকম ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও লেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ভ ম কম প র ম সলম ন ক ম সলম ন অন ক ম সরক র মসজ দ এ রকম

এছাড়াও পড়ুন:

সবাই ভেবেছিলেন কিশোরী ডুবে গেছে, ১০ দিন পর ফোন করে জানাল সে গাজীপুরে আছে

১০ দিন আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মরা কালিগঙ্গা নদীতে গোসল করতে গিয়েছিল কিশোরী সোহানা খাতুন। বাড়িতে ফিরে না আসায় পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী তাকে খুঁজতে শুরু করেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নদীতে অভিযান চালিয়েও তার সন্ধান পায়নি। তবে গত বুধবার রাতে মাকে ফোন করেছে সোহানা; জানিয়েছে সে গাজীপুরে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে।

নিখোঁজ হওয়া কিশোরীর নাম সোহানা খাতুন। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রাম কারিগর পাড়ায়। তার বাবা গোলাম মওলা ও মা শিরিনা খাতুন।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯ জুলাই দুপুরে বাড়ির পাশের মরা কালিগঙ্গা নদীতে গোসল ও কাপড় ধুতে গিয়েছিল সোহানা। দীর্ঘ সময়েও না ফেরায় তার মা নদীর ধারে যান; দেখেন, সোহানার কাপড় পড়ে আছে। এরপর স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে খুঁজতে শুরু করেন। খবর পেয়ে ওই রাতে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল নদীতে উদ্ধার অভিযান চালায়। পরদিন খুলনা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ১২ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েও তার সন্ধান না পেয়ে অভিযান স্থগিত করে। ২১ জুলাই এক কবিরাজ এনে নদীতে খোঁজার চেষ্টাও করেন সোহানার বাবা–মা।

এমন অবস্থায় বুধবার রাতে হঠাৎ সোহানা তার মায়ের ফোনে কল দিয়ে জানায়, সে ঢাকার গাজীপুরে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান সোহানার বাবা গোলাম মওলা। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, মেয়ে নদীতে ডুবে গেছে। সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করেছি। এমনকি কবিরাজও এনেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ বুধবার আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানায়, সে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে। আমরা বিষয়টি গতকাল রাতে পুলিশকে জানিয়েছি।’ বিষয়টি বুঝতে না পেরে সবাইকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তিনি ক্ষমা চান।

স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় দুই বছর আগে খালাতো ভাই কুতুব উদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে যায় সোহানা এবং দুজন বিয়ে করে। তবে বনিবনা না হওয়ায় তিন মাস আগে সোহানা তাকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। নদীতে নিখোঁজ হওয়ার ‘নাটক’ করে সে পালিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে কুমারখালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিরুল ইসলাম বলেন, শুরুতে পরিবারের লোকজন জানিয়েছিল, নদীতে গোসলে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সোহানা। গতকাল আবার তার বাবা জানিয়েছে, মেয়ে গাজীপুরে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ