কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
Published: 9th, April 2025 GMT
আমাদের দাপ্তরিক ও দৈনন্দিন কাজে জেনারেটিভ এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বিশ্বের বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা করছে কী করে আরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন এআই মডেল তৈরি করা যায়। শুরুতে এসব মডেল শুধু টেক্সট বা লেখা আকারে ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে এই পরিষেবায় ইমেজ জেনারেশন বা কৃত্রিম ছবি বানানোর সুবিধাও যুক্ত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ ডালি, মিড জার্নি কিংবা স্টেবল ডিফিউশনের কথা বলা যায়। এ ধরনের টুলগুলো লিখিত আকারের নির্দেশনা, অর্থাৎ টেক্সটচুয়াল প্রম্পটকে বর্ণনানুযায়ী ছবিতে রূপান্তরিত করে। আগে ডিজিটাল মাধ্যমে একটি ছবি তৈরিতে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগত, এখন একটি বর্ণনার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে একটি প্রাথমিক বা পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করা যাচ্ছে, যা শিল্পীকে তাঁর নিজস্ব আইডিয়া নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দিচ্ছে। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করছে, তাদের এই টেক্সট-টু-ইমেজ পরিষেবাগুলো ব্যবহারকারীদের সৃজনশীলতা ও উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার প্রভাবে বিশেষ করে শিক্ষাগত, বিজ্ঞাপন বা গবেষণাকাজে চিত্রনির্ভর যোগাযোগ আরও সহজ ও ব্যাপক হয়ে উঠবে।
তবে এসব প্রযুক্তিকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়। এই টুলগুলো নতুন ছবি তৈরি করে ইন্টারনেটে থেকে যাওয়া শিল্পকর্ম, ছবি ও শৈল্পিক ধারণাগুলোর ওপর নির্ভর, যা কি না মেধাস্বত্ব ও কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের শঙ্কা তৈরি করছে। শিল্পীদের অনুমতি ছাড়াই তাঁদের কাজ ব্যবহৃত হওয়ায় সৃজনশীল পরিশ্রমের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এসব মডেল প্রায় সময়ই একই ধরনের সাংস্কৃতিক ছাঁচ অনুসরণ করে ছবি তৈরি করে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে শিল্পমাধ্যমে বৈচিত্র্য, সমতা ও নতুন চিন্তার পরিসর সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলে জানাচ্ছেন শিল্পীরা। গবেষকেরা বলছেন, এই ধরনের একমুখী উপস্থাপনায় সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী বা বিকল্প শিল্পধারার প্রতিনিধিত্ব প্রায়ই অনুপস্থিত বা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
এটি সত্য যে এসব টুল সময় ও খরচ বাঁচিয়ে উচ্চমানের ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরিতে সুবিধা এনে দেওয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপগুলো উপকৃত হতে পারে। কিন্তু এদের অতি ব্যবহার শিল্পী, ডিজাইনার ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কর্মসংস্থানের সংকট তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, এই এআই টুলগুলোর সাহায্যে সহজেই ভুয়া ছবি বা কনটেন্ট তৈরি করা সম্ভব, যা সামাজিক বিভ্রান্তি, রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ও তথ্য জালিয়াতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। আইনি ও অন্যান্য কাঠামোগত প্রস্তুতির অভাব থাকায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসব আশঙ্কা আরও বেশি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জেনারেটিভ এআই টুলের উন্নয়ন ও মূল্যায়ন নিয়ে যে গবেষণা ও বিতর্ক চলছে, তা এখনো প্রধানত পাশ্চাত্য প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ। প্রাপ্তিস্বল্পতার কারণে টুলগুলোকে অনেক সময়ই সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যহীন ডেটাসেটের ওপর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। যদিও এসব টুল গ্লোবাল সাউথ, যেমন দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মতো অঞ্চলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তবু এসব অঞ্চলের সামাজিক-প্রযুক্তিগত বাস্তবতা এবং সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গগুলো প্রায়ই গবেষণায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ফলে গ্লোবাল মেজরিটি, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রযুক্তির উন্নয়ন–কাঠামোতে প্রান্তিক, তাদের অভিজ্ঞতা, চাহিদা ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।
এ বিষয়ের গবেষক হিসেবে আমরা মনে করি, এই ন্যায্যতার প্রশ্ন আমাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে, কেননা এআইকে বহু মানুষের না করে তোলা পর্যন্ত এর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্ন থেকে যাবে।
বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং আশঙ্কাগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক আলাপে তুলে ধরার গবেষণাগত শূন্যতা পূরণে আমরা কয়েক ধাপে উদ্যোগ নিই। প্রথম ধাপে, কয়েক মাস ধরে আমরা কথা বলি বাংলাদেশের বিভিন্ন ‘ইমেজ প্র্যাকটিশনার’দের সঙ্গে। ইমেজ প্র্যাকটিশনার বলতে আমরা এমন পেশাজীবীদের বোঝাচ্ছি, যাঁরা তাঁদের পেশাগত কাজে ডিজিটাল ইমেজ তৈরি বা উৎপাদন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্থপতি, যাঁরা স্থাপত্য নকশা–ভাবনা তুলে ধরতে ড্রয়িং ব্যবহার করেন; ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, যেমন গ্রাফিক ডিজাইনার, ইলাস্ট্রেটর ও কনটেন্ট আর্টিস্টরা, যাঁরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রে চরিত্র, পরিবেশ বা প্রাণীর নকশা করেন।
বাংলাদেশ তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে এক নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা নীতিনির্ধারকদের বলতে চাই যে আমাদের স্থানিক প্রযুক্তিভাবনাকেও জাতীয়ভাবে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে।আমরা বাণিজ্যিক কাজে যুক্ত শিল্পীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। যাঁরা ব্র্যান্ড, চলচ্চিত্র, সিরিজ বা বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি করেন। এই বৈচিত্র্যময় শিল্পগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়ার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে টেক্সট-টু-ইমেজ টুল ব্যবহারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছি।
আমাদের প্রকাশিত গবেষণায় উঠে এসেছে, কীভাবে জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তিগুলো চিত্রমাধ্যমে আমাদের সাংস্কৃতিক আবহকে সীমিত করে ফেলছে। এসব টুল প্রায় অপ্রতিনিধিত্বশীল ছবি তৈরি করতে পারে, যা বাংলাদেশের সমাজের সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা ও জীবন অভিজ্ঞতাকে ‘অপর’ করে তোলে। আমরা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, যাঁরা টুলগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের পেশায় এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভাষার দুর্বলতা এবং প্রযুক্তিগত অসামর্থ্য তাঁদের সৃজনশীলতা এবং অনুসন্ধানী মনোভাবকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরে যেতে আমরা বাংলাদেশের স্থানিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় টুলগুলোর প্রম্পট অনুসরণক্ষমতা নিয়ে তাত্ত্বিক ও গুণগত মূল্যায়ননির্ভর গবেষণা করি। আমরা দেখতে পাই, উন্নত দেশের প্রেক্ষাপটে সফল হলেও দেশীয় শৈল্পিক রীতিনীতি পুনরুৎপাদনে মডেলগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। গবেষণার পরবর্তী ধাপে আরও প্রান্তিক শিল্পীদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি।
এবার আমরা কথা বলি রিকশা আর্টিস্ট, মেহেদি আর্টিস্ট, আলপনা আঁকিয়েদের সঙ্গে। আমাদের গবেষণায় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি যে ছবি আঁকার বিষয়টি শিল্পীদের সামষ্টিক অভিজ্ঞতা ও মর্যাদার সঙ্গে জড়িত এবং বিষয়টিকে অবহেলা করে সামগ্রিকভাবে এআইনির্ভর আর্টকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করা সম্ভব হবে না। এসব গবেষণা এখনো চলমান; কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, এগুলো প্রকাশিত হলে সেগুলো দেশীয় প্রেক্ষাপটে এআই টুলগুলোর উন্নতি এবং একই সঙ্গে এদের ঘিরে নৈতিক ব্যবহারবিধি ও আইনি নীতিমালা প্রস্তুতিতে ভূমিকা রাখবে।
এ পর্যায়ে আমাদের গবেষণাপদ্ধতির অংশ হিসেবে আমরা একটি এআই আর্ট হ্যাকাথনের পরিকল্পনা করেছি। মাইক্রোসফট, ইউএনডিপি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশনের সহায়তায় এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, শিল্পী ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী সবাই এক প্ল্যাটফর্মে আসবেন। অংশগ্রহণকারীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ছবি তৈরি করবেন।
এই ছবিগুলোতে তাঁরা তুলে ধরার চেষ্টা করবেন বাংলাদেশি কোনো একটি প্রেক্ষাপটকে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে খুব একটা চর্চিত হয়নি। তাই অংশগ্রহণকারীদের পুরোপুরি জেনারেটিভ এআইয়ের ওপর ভরসা করার সুযোগ নেই। তখন সামনে প্রশ্ন চলে আসে, কী করে একটা ছবি তৈরি করা যায়, যেখানে অংশগ্রহণকারীর মূল ভাবনা ও স্বকীয়তা বিসর্জন না দিয়ে এআই ব্যবহার করতে পারে।
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, আমাদের প্রয়াস এআইকে ঘিরে নয়, বরং আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশি শিল্পীদের চিত্রকর্মের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে আগ্রহী। 
এটি বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এআইনির্ভর প্রতিযোগিতা, যা বৈশ্বিক উদাহরণ হিসেবেও কাজ করবে। এই প্রাণবন্ত প্রতিযোগিতাটির মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি একজন শিল্পী যখন নিজের সামাজিক–সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর শিল্পভাবনাকে এআই মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চান, তখন ঠিক কী কী বাধার সম্মুখীন হন। আমরা আরও ভাবছি, কী করে সম্মিলিত সৃজনশীলতার শক্তিতে এআই টুলগুলোর সীমাবদ্ধতাগুলোকে আমরা উতরে যেতে পারি।
বাংলাদেশ তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে এক নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা নীতিনির্ধারকদের বলতে চাই যে আমাদের স্থানিক প্রযুক্তিভাবনাকেও জাতীয়ভাবে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশেও এআই রেডিনেস বা প্রস্তুতিবিষয়ক সরকারি ও উন্নয়ন-সহযোগীদের প্রচেষ্টা চলমান। নতুন অর্থনৈতিক যাত্রায় আমাদের তরুণ প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় দক্ষতা বাড়ানো যেমন অত্যন্ত জরুরি, তেমনি এই প্রযুক্তিগত পরিষেবাকে আমাদের সমাজ–সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে তোলার জন্য নতুন কার্যকর পদ্ধতি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণা জারি রাখার বিকল্প নেই।
আবদুল্লাহ হাসান সাফির কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যে পিএইচডি গবেষক ([email protected])
নুসরাত জাহান সহকারী অধ্যাপক ([email protected])
ইশতিয়াক আহমেদ সহযোগী অধ্যাপক ([email protected]) হিসেবে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডায় কর্মরত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত জ ন র ট ভ এআই ব যবহ র কর আর ট স ট আম দ র স এআই ট ল স জনশ ল ন র ভর এই প র ব ষয়ট র বলত
এছাড়াও পড়ুন:
জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।
জাতীয় নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সময়মতো ঘোষণা করা হবে বলে বলেও জানান তিনি। এছাড়া, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, জামায়াতের তালিকা কবে ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে দলের আমির বলেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।”
“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।”
আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে জামায়াতের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।”
মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনীতিতে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”
“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।
খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি ও গণভোটের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”
সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে। সরকার ভালো কথাই বলেছে।”
তিনি বলেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।”
এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:
আবারো দলের আমির নির্বাচত হওয়া প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”
বিদেশ সফরের কথা তুলে ধরে শফিকুর রহমান বলেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সুযোগ হয়েছে।”
“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”
ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাইরে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল করে দেয়।”
তুরস্ক সফর সফল হয়েছে জানিয়ে দলটির আমির বলেন, “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।”
তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।”
সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভোরে ঢাকায় ফেরেন।
এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দলের সিনিয়র নেতারা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
দলের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা