গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসের অত্যধিক নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে– যা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণ শিল্পকারখানা ও জ্বালানি, পরিবহন খাত, কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড এবং বর্জ্য নিষ্কাশন ও ল্যান্ডফিল থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়া।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ এমন একটি লক্ষ্য অর্জন করা, যা বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবদান কমিয়ে আনবে। এই লক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি চরম পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছে। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং নিম্নাঞ্চলীয় এই দেশটির একটি বড় অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম উচ্চতায় অবস্থিত, যা বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ধ্বংসাত্মক বন্যার মুখোমুখি করেছে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে মাত্র ০.

৩ শতাংশ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুতর শিকারগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা স্থায়ীভাবে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে, যা লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে। বাংলাদেশের জন্য শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের প্রেক্ষাপটে কিছু উদাহরণ এবং সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো: গ্রামীণ শক্তি সামাজিক ব্যবসা লিমিটেডের নবায়নযোগ্য শক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ বাংলাদেশের ১৮ লাখেরও বেশি পরিবারে সোলার হোম সিস্টেম সরবরাহ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে, যেখানে জাতীয় গ্রিডের সুবিধা পৌঁছায় না। এটি পরিবার, স্কুল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরিষ্কার, সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি নিশ্চিত করেছে। উন্নত চুলা, বায়োগ্যাস প্লান্ট জ্বালানির জন্য গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে একটি টেকসই শক্তি সমাধান প্রদান করেছে। পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ প্রকল্প তথা বিপরীতভাবে সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সরকারি পরিকল্পনা শূন্য নেট কার্বনের লক্ষ্যের বিরোধী এবং পরিবেশগত উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। 


পরিষ্কার শক্তি সমাধান গ্রহণ তথা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এতে বিনিয়োগ করা যেমন– সৌরশক্তি, বায়ু ও টেকসই জলবিদ্যুৎ। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা কাজে লাগানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে অত্যাধুনিক পরিষ্কার শক্তি প্রযুক্তি এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা দেশটিকে দূষণকারী শক্তির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে। সবুজ উদ্যোগকে উৎসাহিত করা। গ্রামীণ শক্তির মতো পরিবেশবান্ধব সামাজিক ব্যবসাগুলোকে সমর্থন এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার প্রযুক্তি ও অনুশীলনগুলোর ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প এড়ানো। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা এবং এড়িয়ে চলা উচিত, যা পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রযুক্তিগত লিপফ্রগিং বা অতিদ্রুত অগ্রগতি। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে পুরোনো ও দূষণকারী প্রযুক্তি এড়িয়ে সরাসরি আরও দক্ষ ও পরিষ্কার বিকল্প গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। টেকসই অনুশীলনের ওপর ফোকাস করা। টেকসই কৃষিনীতির প্রচার, বন উজাড় রোধ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো পদক্ষেপগুলো সামগ্রিক পরিবেশগত প্রভাব কমাতে এবং শূন্য নেট কার্বনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন শুধু বাংলাদেশের জন্য একটি পরিবেশগত অপরিহার্যতা নয়, বরং এর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের কল্যাণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। 

বিলাতের কিংস কলেজের অধ্যাপক ও ব্রিটিশ ভূগোলবিদ জে. এ. অ্যালান কর্তৃক ভার্চুয়াল পানির ধারণাটি জনপ্রিয় হয়েছিল, যা পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পানি হিসেবে পরিচিত। ভার্চুয়াল পানিকে পণ্যের মধ্যে ‘অন্তর্নিহিত’ পানি হিসেবে দেখা যায়। এটি একটি সূচক, যা একটি পণ্য উৎপাদন ও পরিবহনের সময় বাষ্পীভূত বা দূষিত হওয়া স্বাদু পানির পরিমাণ নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, এক কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় আড়াই হাজার লিটার পানি প্রয়োজন অথবা একটি কাপড় তৈরি করতে প্রায় ১০ হাজার লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে? এই পানি সরাসরি দেখা যায় না, কিন্তু পণ্যের মাধ্যমে ‘ভার্চুয়ালি’ স্থানান্তরিত হয়। পানির প্রাপ্যতা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং জলবায়ু পরিবর্তন এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আমাদের রপ্তানি পণ্যের মাধ্যমে পানির গোপন স্থানান্তর সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। ভার্চুয়াল পানি বাণিজ্য বাংলাদেশের জন্য পানি সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি উপকরণ হতে পারে। 
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পানি-ঘন পণ্য (যেমন– পাট, চামড়া, তৈরি পোশাক, কৃষিজাত পণ্য) রপ্তানি করছে, যা ভার্চুয়াল পানির বড় ধরনের ক্ষতি ঘটাচ্ছে। এক জোড়া চামড়ার জুতা উৎপাদনে ৮ হাজার ৫০০ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়, যা রপ্তানির মাধ্যমে দেশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভার্চুয়াল পানির সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য কিছু পরিকল্পনা ও কৌশল প্রয়োজন। পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যে ব্যবহৃত পানির পরিমাণ হিসাব করে ভার্চুয়াল পানির আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ যদি গমের পরিবর্তে কম পানি ব্যবহার করে এমন ফসল (যেমন ভুট্টা) উৎপাদন করে, তাহলে ভার্চুয়াল পানির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। ভার্চুয়াল পানির সমস্যা মোকাবিলায় নাগরিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে ভার্চুয়াল পানির আমদানি কমাতে হবে। বিদেশি ফল ও শাকসবজির পরিবর্তে স্থানীয় পণ্য কেনা। পরিবহনের কারণে এর পেছনে পানি বেশি খরচ হবে। তবে সরকারকেই ভার্চুয়াল পানি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুল ও কলেজে কর্মশালা আয়োজন করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা পানির অপচয় রোধ ও ভার্চুয়াল পানির ধারণা সম্পর্কে শিখবে। 

সরকারের উচিত নাগরিকদের সচেতন এবং কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা নাগরিকদের মানতে বাধ্য করবে। নিচে সরকারের করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো: প্রতিটি পণ্যের প্যাকেটে পানি ও কার্বন ফুটপ্রিন্ট উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে নাগরিকরা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন; জৈব ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের ওপর ভর্তুকি দেওয়া এবং রাসায়নিক সার ও প্লাস্টিক পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা; বাড়ি ও অফিসে পানির পুনর্ব্যবহার ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা; পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা উন্নত এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানোর জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা; পানি ও কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রদান এবং সেগুলো মেনে চলার জন্য নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করা।


পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ভার্চুয়াল পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। এ জন্য সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এদিক দিয়ে তিন শূন্যের পৃথিবী তত্ত্বের জনক, শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিবেশ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উপযুক্ত নেতা।


মোহাম্মদ আসিফ চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ শ ন য ন ট ক র বন ল দ শ র জন য র ব যবহ র ক র বন ন পর ষ ক র স বর প পর ব শ ব যবস জলব য উৎপ দ ট কসই র ওপর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শনি গ্রহের একাধিক চাঁদে কার্বন ডাই–অক্সাইডের সন্ধান

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে শনি গ্রহের আটটি মাঝারি আকারের চাঁদে কার্বন ডাই–অক্সাইড শনাক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে মিমাস, এনসেলাডাস, ডায়োন, টেথিস, রিয়া, হাইপেরিয়ন, লাপেটাস ও ফিবি নামের চাঁদগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের তথ্য টেলিস্কোপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে। তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি চাঁদগুলোর ওপরে নিয়মিত নজরও রাখছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, ডায়োন ও রিয়া চাঁদে থাকা কার্বন ডাই–অক্সাইড শনির প্রধান বলয়ের বরফের অনুরূপ। ফিবি চাঁদে কার্বন ডাই–অক্সাইড জৈব পদার্থের বিকিরণের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়ে থাকে। লাপেটাস ও হাইপেরিয়নের অন্ধকার অঞ্চলে কার্বন ডাই–অক্সাইড দেখা যায়। বরফযুক্ত এসব চাঁদে কার্বন ডাই–অক্সাইডের অবস্থা সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী বিজ্ঞানীরা।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ও তাঁর সহকর্মীরা এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, কঠিন কার্বন ডাই–অক্সাইড সৌরজগতের প্রান্তসীমার বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। যদিও সেই অবস্থানে কার্বন ডাই–অক্সাইড স্থিতিশীল নয়। আমরা শনির উপগ্রহে কার্বন ডাই–অক্সাইডের অবস্থান জানার মাধ্যমে ভিন্ন পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন গ্রহে কার্বন ডাই–অক্সাইড কীভাবে আটকে আছে, তা জানার সুযোগ আছে এখানে।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, শনির চাঁদে আটকে থাকা কার্বন ডাই–অক্সাইড থেকে আদর্শ ল্যাবের মতো তথ্য পাওয়া যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, শনি গ্রহের বিভিন্ন চাঁদে কমপক্ষে দুটি পৃথক উৎস থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড তৈরি হয়েছে।

সূত্র: এনডিটিভি

সম্পর্কিত নিবন্ধ