সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের বিবৃতি, সাম্প্রতিক সময়ে স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ এবং এসব বিবৃতি ও তথ্যের বিপরীতে পাল্টাবিবৃতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা মাত্রার উৎকণ্ঠা লক্ষণীয়। সেনাবাহিনী ও নির্দিষ্টভাবে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের গণ-অভ্যুত্থান ও গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের ভূমিকা নিয়ে নানামুখী মন্তব্য এবং তা নিয়ে যার যার মতো বিশ্লেষণের মাধ্যমে অস্থিরতা ও উদ্বেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হয়।

অথচ এই সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান কর্তৃক ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত যেভাবে তরুণদের আরও সাহসী করেছিল এবং আন্দোলনকে বেগবান করেছিল, কেউ কেউ যেন তা মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করছেন না। বিষয়টি দুঃখজনক। বর্তমানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মাঠপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি বা তাৎক্ষণিক কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে সেনাসদস্যরা নিয়োজিত আছেন।

যাঁরা আগেকার সামরিক শাসন প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বর্তমান সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের ধৈর্য ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি সম্মানবোধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পার্থক্য লক্ষ করেছেন। এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে কেবল প্রচার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্য নিয়ে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই বেফাঁস কিংবা স্পর্শকাতর বা চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ মাঠপর্যায়ে থাকা সেনাসদস্যদের মনোবলের ওপর স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়ে। ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে এভাবে বক্তব্য দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

সম্প্রতি আলোচিত এক আইনজীবী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া জাগানো বক্তা, সর্বোপরি জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্রনেতাসহ কেউ কেউ এমন কিছু কথা বলেছেন, যা সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতীয়মান হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের অপর অংশীজনেরাও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন বিরূপ বক্তব্য করা উচিত নয় বলে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। সুস্থ রাজনীতির চর্চা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে মাঠপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের একতা, শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কর্তব্য পালন ও নির্বাচন শেষে সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে কোনো বিশেষ মহল থেকে এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য আশঙ্কার জন্ম দেয়, যা দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অকল্যাণকর।

অন্যদিকে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর মধ্যে অঘটন সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যেই যেন কাল্পনিক ও অযৌক্তিক সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমনকি সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বন্দী ও অচিরেই হত্যাযজ্ঞ শুরুর মতো বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনও করেছে ভারতে কিছু তথাকথিত সংবাদমাধ্যম। ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই ধারাবাহিকতা মিথ্যা প্রচারণা চলছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস এই ভুল-বোঝাবুঝির সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের মধ্যে জুলাইয়ে দেখা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ঐক্য ফিরিয়ে আনবেন, এটাই আজ চরম প্রত্যাশিত। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমঝোতা এবং সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দিকে সবাইকে ধাবিত করলেই সফলভাবে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হতে পারে, যা হবে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। অন্যথায় অনৈক্য আর ভুল-বোঝাবুঝির চোরাপথে অন্য কোনো মহল প্রবেশ করে নষ্ট করে দিতে পারে সব অর্জন।

পাকিস্তান আমলে ১০ বছর সামরিক শাসন ও অনেক উন্নয়ন করেও সেনাশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে পাকিস্তানি অপর জেনারেলদের সমর্থন না পাওয়ায় আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আইয়ুব খানের মতো প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গেই দেশ চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ নূরউদ্দীন এবং অপরাপর সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা রাজনৈতিক কারণে জনগণের প্রতিপক্ষ না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নব্বইয়ে এরশাদের পতন ঘটে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ও কতিপয় জেনারেল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশের সমর্থন না থাকায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

 ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ মূলত গুটিকয় জেনারেল ও ডিজিএফআইয়ের দু-তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে দেশ পরিচালনার স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন। এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। এই মেয়াদ পূর্তিকালে প্রকাশ্য রাজপথে এই জোটের সঙ্গে আওয়ামী জোটের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই জেনারেল মইনের এক-এগারোর সরকারের প্রতি তখন সমর্থন জুটেছিল।

তবে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নীরব অসম্মতি ও নানামুখী চাপের কারণে দুই বছরের মাথায় জেনারেল মইন ইউ আহমেদ অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হলে তিনি কেবল ক্ষমতাই ছাড়েননি, দেশ ছাড়তেও বাধ্য হন। তাঁর ছায়াসঙ্গীরাও আজ দেশছাড়া। তবে এ সময়ে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কর্মযজ্ঞে এই জাতি প্রথমবারের মতো একটি গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা পেয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে কেবল যথাযথ নির্বাচনই নয়, জনগণের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতেও সহায়তা করে। সেনাবাহিনীর করা ভোটার তালিকাভিত্তিক সে নির্বাচনও সব মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। দেশের রাজনীতির ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় সেনাবাহিনীর অবদানের এসব ঘটনা বা ইতিহাস ভুলে যাওয়াও ভুল হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সাহসী ভূমিকা ও ব্যাপক অবদান অবশ্যই চিরস্মরণীয়। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকাকে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। তবে এ কথাও সত্য যে এই তরুণেরা তখন পাশে পেয়েছিল দেশের প্রায় সর্বস্তরের মানুষকে। এর আগে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন দল তাদের ঐক্য ধরে রাখে এবং সুযোগমতো প্রতিবাদ করেছে। বিগত ১৬ বছরে গুম ও খুন হওয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অবদানকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যে নেতারা ১৬ বছর জেল, হাজত আর বিচারালয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা ও তাঁদের পরিবার জুলাই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সরকার পতনে প্রকাশ্যে এককাট্টা হয়ে সপরিবার রাজপথে নেমেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা।

আন্দোলনে ছাত্র-জনতার এই ঐক্যে ক্রমাগত আঘাত করেও ফাটল ধরাতে পারেনি স্বৈরাচারী সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনী। সবার মধ্যে তখন ছিল দেশের স্বার্থে কিছু করার অদম্য বাসনা, যা ইতিহাসে বিরল। পদ-পদবি আর আসনবিন্যাসের বদলে দেশের জন্য আর কী করা যায়, এমন ভাবনাই যেন ছিল আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। বহু প্রাণহানি, অঙ্গহানি ও সম্পদহানির বিনিময়ে লক্ষ্য অর্জনের পর একই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশ কাঙ্ক্ষিত ধারায় ফিরে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের প্রতি অপরের তির্যক মন্তব্য, সন্দেহ ও কাদা-ছোড়াছুড়ি জাতিকে কিছুটা হতাশ করেছে।

এক জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। বিচারালয়ের বিচারক থেকে জাতীয় মসজিদের খতিব আর পুলিশপ্রধান থেকে থানার কনস্টেবল একযোগে পালিয়ে যাওয়ার এমন নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনের তিন স্তম্ভ—আইন, বিচার ও শাসন বিভাগে ব্যাপক শূন্যতা ও অতীতের অরাজকতা মোকাবিলা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আর নিমজ্জিত অর্থনীতি, বিশেষত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ধস ঠেকানো ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দেশ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্ব, উপদেষ্টাদের উদ্যোগ এবং সেনাবাহিনীর অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতাচর্চার বদলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী দায়িত্ব শেষে ব্যারাকে ফেরার সংকল্প জাতির জন্য স্বস্তিদায়ক।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ভুল-বোঝাবুঝির সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের মধ্যে জুলাইয়ে দেখা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ঐক্য ফিরিয়ে আনবেন, এটাই আজ চরম প্রত্যাশিত। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমঝোতা এবং সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দিকে সবাইকে ধাবিত করলেই সফলভাবে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হতে পারে, যা হবে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। অন্যথায় অনৈক্য আর ভুল-বোঝাবুঝির চোরাপথে অন্য কোনো মহল প্রবেশ করে নষ্ট করে দিতে পারে সব অর্জন।

নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও বিশ্লেষক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ত র জনত র গণতন ত র কর মকর ত পর স থ ত ম হ ম মদ ড স ম বর র জন ত র ওপর সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

করের চাপ কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ কমানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, করজাল বৃদ্ধি না পাওয়ায় যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপরই করের চাপ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি করহারের চেয়েও প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি কর দিতে হয় তাঁদের। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের যে হয়রানি করেন, তা বন্ধ করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় এ দাবিগুলো জানান বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। এনবিআর এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল বুধবার এই সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

পরামর্শক সভায় বিভিন্ন খাতের প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী নেতা বাজেটে বাস্তবায়নের জন্য নানা দাবি তুলে ধরেন। শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতাদের জন্য এই সীমা পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো জরুরি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষদের নিত্যপণ্য কিনতে আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বিদ্যমান করকাঠামো তাঁদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

এ ছাড়া পণ্য রপ্তানিতে পাঁচ বছরের জন্য উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ করা, আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা, স্থানীয় পর্যায়ে সব পণ্য সরবরাহে মূসক ২ শতাংশ নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এইচএস কোডে ভুলের জন্য জরিমানার যে বিধান আছে, সেটি বাতিলের সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।

অন্যদিকে বাজেটে করহার না কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, করহার আর কমানো সম্ভব নয়। তবে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা থাকবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সব কথা হয়তো শুনতে পারব না। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয় কমানো যাবে না। সরকার চালাতে রাজস্বের প্রয়োজন।’

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, করজাল বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। দেশে ১ কোটি ১৪ লাখ করদাতা রয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ লাখ রিটার্ন দেন, যাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। ফলে এখানে গুণগত পরিবর্তন দরকার। করজাল না বাড়িয়ে বর্তমান করদাতার ওপর বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে করদাতাদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হয়।

সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের ৮৪ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসে—এমন তথ্য দিয়ে ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি রাজীব চৌধুরী বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে কর আহরণ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ দেশের অর্থনীতিতে ৬০-৭০ শতাংশ অবদানই এই খাতের।

তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান রাঙামাটি চেম্বারের প্রতিনিধি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মানুষের মন থেকে করভীতি দূর করতে হবে। তাহলে স্বচ্ছন্দে কর দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

গ্যাস-বিদ্যুৎ চান ব্যবসায়ীরা

কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেও গ্যাস–বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরাসহ অনেকেই কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করেছেন। আমরা ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছি। তবে দুই বছরেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। আমরা বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য ডাকছি। অথচ নিজের দেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানিসংকটে ভুগছেন। এটা অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।’

মোস্তফা কামাল আরও বলেন, সবাই করজাল বাড়ানোর কথা বলেছেন। বাস্তবতা হলো, যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপর আরও বেশি করের চাপ আসে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকের ব্যাংক হিসাব ও করনথি তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়া তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ঢালাওভাবে তল্লাশি করে ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানান।

সিরামিকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে সিরামিক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সিরামিক পণ্যের মূল কাঁচামাল হিসেবে যে মাটি আমদানি করা হয়, তার মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ পানি থাকে। এটি বাদ দিয়ে শুল্কায়ন করা হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমানোর দাবি

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমিয়ে ৯ শতাংশ করার দাবি জানান আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের পরিচালক আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি সর্বমোট ১৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি কমানো গেলে গ্রাহকেরা ফ্ল্যাট নিবন্ধনে আগ্রহী হবেন।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘নিবন্ধন ফি কমানোর ক্ষেত্রে জমি বা ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে বড় সমস্যা। এটা ঠিক করা গেলে নিবন্ধন ফি ৯ শতাংশ করা হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। এটার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। হয়তো একদিন সফল হব।’

নির্মাণ খাতের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান ইস্পাতশিল্পে সরকারের বিশেষ নজর দাবি করেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম। তিনি বলেন, ‘কাস্টমসের অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। এক টন স্ক্র্যাপ আনতে ১ হাজার ২০০ টাকা কর দিই। কিন্তু চালানে কোনো স্ক্র্যাপ ৫-৭ ফুট দীর্ঘ হলেও হয়রানি করা হয়। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হয়। এখান থেকে বের হতে হবে।’

শুল্ক কমান, রপ্তানি বাড়বে

প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে রপ্তানি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, খেলনাশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। দেশে কারখানা গড়ে ওঠায় খেলনা আমদানি কমে গেছে। রপ্তানিও হচ্ছে অনেক দেশে।

সিলেট চেম্বারের প্রতিনিধি হিসকিল গুলজার বলেন, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে। সেখান থেকে দিনে ১২-১৪টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট যাচ্ছে। হ্যান্ডলিং চার্জসহ অন্যান্য মাশুল কমানো গেলে পণ্য রপ্তানি বাড়বে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, ‘একসময় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে বিটিএমএ ছাড়পত্র দিত। কোনো বিতর্ক হয়নি। এনবিআর পুরো বিষয়টি নিজের হাতে নেওয়ার পর জটিলতা বেড়েছে। দেখা যায়, ৩০ হাজার টাকা শুল্ক–কর জমা দিতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।’

ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন।

নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান প্রশাসন বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সেবা মসৃণ হয়েছে। তবে বন্ড কমিশনারেট কার্যালয়ের নিচের দিকে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সেখানে নজর দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু।

সম্পর্কিত নিবন্ধ