স্বপ্না আক্তারের (২৩) সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিন ছিল আগামী ২০ এপ্রিল। তবে হঠাৎ রোববার গভীর রাতে প্রসব ব্যথা ওঠে। এত রাতে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে নিজের কাঁচামাল টানা ভ্যানে করে তাকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা দেলোয়ার খান। ততক্ষণে ভোর। এদিকে স্বপ্না ব্যথায় কাতর। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, পেটের পানি নেমে গেছে, শিশুর অবস্থা জটিল। এ অবস্থায় নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয়। অবেশেষে সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে সোমবার পহেলা বৈশাখের সকালে স্বপ্নার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান।

বৈশাখের প্রথম দিন জন্ম নেওয়ায় দেলোয়ার খান নাতনির নাম রেখেছেন বৈশাখী, আর দাদা আবদুল জব্বার ফকির রেখেছেন হাবিবা। মা ও মেয়ে দু’জনই এখন সুস্থ। নববর্ষের প্রথম দিন শিশুর জন্মে খুশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বপ্নাকে উপহার ও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিতরণ করেছে।

এদিকে দুশ্চিন্তা, শঙ্কা পেরিয়ে সন্তান এসে কোল জুড়ালেও স্বপ্নার মন কিছুটা খারাপ। কারণ এই সময়ে স্বামী আল ইসলাম ফকিরকে তিনি পাশে পাননি। এ নিয়ে মন খারাপ হলেও স্বামীর প্রতি তাঁর কোনো রাগ কিংবা ক্ষোভ নেই। কারণ, ইসলাম কাজের জন্যই স্ত্রীর পাশে থাকতে পারেননি। তাই তো স্বপ্না বলেন, ‘শুধু সন্তানের জন্মের মুহূর্তে ও পাশে থাকলে খুব ভালো লাগত। কিন্তু আমি জানি, সে কত কষ্ট করে সংসার চালায়।’

শরীয়তপুর পৌরসভার আটং গ্রামের আবদুল জব্বার ফকিরের বড় ছেলে ইসলাম ঢাকার একটি বেসরকারি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে কাজ করেন। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনে চলে তাঁর সংসার। ছুটি চেয়েও তিনি পাননি, বহুবার অনুরোধ করেও ফিরতে পারেননি স্ত্রীর পাশে। ইসলাম দ্বিতীয় কন্যার জন্মের খবর পান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকতে না পেরে তাঁর কষ্টও কম হয়নি।

আল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল। কিন্তু কাজের চাপের কারণে ছুটি পাইনি। স্ত্রীর সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তেও পাশে থাকতে পারিনি। এ নিয়ে নিজের কষ্ট বুকের মাঝে চেপে রাখি। তবুও খুশি, এমন একটি দিনে আমার সন্তান হয়েছে।’

পৌর শহরের চৌরঙ্গী মোড়ের নিউ পপুলার হাসপাতালের চিকিৎসক ঐশ্বর্য চৌধুরী জানান, স্বপ্নাকে পহেলা বৈশাখের ভোরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে রাত ৪টার দিকে মাতৃসদন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয় পরিবার। কিন্তু সেখানে তখন চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। পরে স্বপ্নাকে নিউ পপুলার হাসপাতালে এনে ডা.

ঐশ্বর্যকে জানানো হয়। তিনি হাসপাতালে এসে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে দেখেন, মায়ের পেটে পানি নেই, বাচ্চা পেটেই পায়খানা করেছে। অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে দ্রুত অস্ত্রোপচার করেন তিনি। সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে কন্যাশিশু জন্ম নেয়।

ঐশ্বর্য চৌধুরী বলেন, ‘স্বপ্নাকে হাসপাতালে আনতে আরও ৩০ মিনিট দেরি করলে শিশুটিকে হয়তো বাঁচানো যেত না। পহেলা বৈশাখে আমাদের হাসপাতালে শিশুর জন্ম হওয়ায় আমরা অনেক খুশি।’

হাসপাতালের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বাদল বেপারী বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি আসে। কারণ আমরা কম খরচে সেবা দিই। যারা অতিদরিদ্র, তাদের খরচ নিই না। উৎসবে জন্ম নেওয়া শিশুদের উপহার দিই, মিষ্টি বিতরণ করি। ১৪ এপ্রিল সকালে জন্ম নেওয়া শিশুটিকেও উপহার দিয়েছি।’

সোমবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পাশে জড়িয়ে রেডে শুয়ে আছেন স্বপ্না আক্তার। তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। স্বপ্নার পাশে বসে থাকা তাঁর মা আসমা বেগম জানালেন মেয়ের জীবনের গল্প।

তিনি জানান, তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে স্বপ্না বড়। নাসিমার স্বামী দেলোয়ার খান ভ্যানে করে কাঁচামাল বিক্রি করেন। অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণিতেই থেমে যায় স্বপ্নার পড়াশোনা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ২০১৯ সালে পারিবারিকভাবে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় ছিলেন। এক বছর পর জন্ম হয় প্রথম কন্যাসন্তান। দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে মার্চের শেষে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি।

নাসিমা বলেন, ‘আমার মেয়েটার ছোট বয়সে স্বপ্ন ভেঙেছে সংসারের চাপে। আজ সেই মেয়ের কোলজুড়ে নতুন আশার আলো এলো। ওর স্বামী এই আনন্দের সময়টায় পাশে থাকতে পারেনি। তবু আমরা জানি, ওর বুকের কষ্ট কতটা।’

স্বপ্না আক্তার বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। এক বছর পর প্রথম সন্তান আসে। এরপর ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকি। সে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, আর আমি একা হাতে সংসার সামলাই। দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হলে এক মাস আগে বাবার বাড়িতে আসি। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ ছিল ২০ এপ্রিল। কিন্তু ১৩ এপ্রিল রাতেই অবস্থা খারাপ হয়। অনেকবার স্বামীকে বললেও সে ছুটি নিয়ে আসতে পারেনি। তবে এত কষ্টের মধ্যেও যখন সন্তানের মুখ দেখি, সব ভুলে যাই। আল্লাহ চেয়েছেন নববর্ষেই আমার সন্তান জন্ম নিক, তাই হয়েছে।’

দ্বিতীয় নাতনিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন স্বপ্নার শাশুড়ি হোসনারা বেগমের। তিনি বলেন, ‘আমার বড় সন্তান আল ইসলামের দ্বিতীয় মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াবো। আমার ইচ্ছা, সে একদিন বড় ইসলামী চিন্তাবিদ হবে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ শ র জন ম র জন ম জন ম ন প রথম ইসল ম অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ