সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ও গণতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। সংখ্যাগরিষ্ঠতামুখী রাজনীতি দ্রুত আইন পাস করতে পারে। এই ধরনের আইন ঐকমত্য ও অন্তর্ভুক্তির চেতনায় বিকশিত আইন বলে দাবি করতে পারে না। গণতন্ত্রের জন্য আলোচনা, সংবেদনশীলতা এবং সর্বস্তরের মতামতের সঙ্গে সদিচ্ছার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।

সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু ও ধর্ম, বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল, নারী-পুরুষভিত্তিক সব ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠী সবসময় নিজেদের ক্ষমতার বাইরে দেখবে। তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। শুধু তাই নয়; তাদের ওপর প্রায়ই প্রভাবশালী গোষ্ঠীরা ভাবাদর্শ, ধারণা ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। 

ভারতের অসংখ্য শহর ও গ্রামের নানা প্রান্তের মসজিদ, দরগা ও এতিমখানা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বাসের জীবন্ত সাক্ষী, যেখানে ‘ওয়াক্ফ’ শব্দটি আস্থার এক গৌরবময় ওজন বহন করে। এটি কেবল সম্পত্তির ব্যাপারে নয়; বরং দান, উত্তরাধিকার ও সম্প্রদায় সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে। এর উদ্দেশ্য মুনাফা নয়; বরং ভারতের সবচেয়ে দুর্বলদের ভরণপোষণ, শিক্ষা ও আশ্রয় দেওয়া। এটি বিদ্যমান সর্বশেষ স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটি, যা স্বয়ং নিজেকে নিজেই টিকিয়ে রেখেছে। ওয়াক্ফ সম্পত্তির অনেকটি জরাজীর্ণ। এখনও একে অন্যান্য সাধারণ সম্পত্তির মতো দেখায়। কোনো ধরনের জবাবদিহি বা সম্মতি ছাড়াই তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তীব্র করার মানে হলো জীবনকে আরও ভোগান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া।

এই সংশোধনী এমন এক প্রেক্ষাপটে এসেছে, যা ইতোমধ্যে ক্ষতবিক্ষত। এটি জবরদস্তিমূলক নীতি অনুসরণ করে, যা নির্লজ্জ অবিচারের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই তৎপরতাকে সন্দেহ করা কোনোভাবে অযৌক্তিক নয়। যখন কোনো সম্প্রদায় কাঠামোর বাইরে ঠেলে দেওয়ার প্রমাণ হাজির করে, তখন এটি কেবল ভোগান্তি হিসেবে তুলে ধরে না। বাড়ি থেকে শুরু করে খাবার পছন্দ ও কলেজ ক্যাম্পাস পর্যন্ত স্বাধীন ভারতে মুসলিম নাগরিকরা আগের চেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চনা কেবল সম্পদের অনুপস্থিতি নয়, বরং একসময় মর্যাদার দিকে চালিত দরজাগুলোর পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ করে ফেলা।

সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনটি ভাষাগত পদ্ধতির নামে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস ও অপমান করার তৎপরতা। এটি জুলম (নিপীড়ন)। এই জুলুমের মূলে কেবল অহংকার ও পাশবিক বল প্রয়োগই নয়, বরং একে অপরকে পুরোপুরি মানুষ হিসেবে দেখতে অস্বীকৃতিও রয়েছে। আইনসভা ও প্রশাসনিক লাগাম যেভাবে জোরালো করা হচ্ছে, তাতে মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক বিপজ্জনক মোড়ের সম্মুখীন। 

এ ধরনের সংশোধনী সেই হাতুড়ির মতো, যার সাহায্যে মানবিক বন্ধন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। প্রতিটি দখল, ধূর্ত দাবি, স্বেচ্ছাচারী ধ্বংসলীলা এবং প্রতিটি আমলাতান্ত্রিকভাবে উপেক্ষার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা এমন একটি সমাজে পরিণত হচ্ছি, যেখানে ইনসানিয়াত ও ভ্রাতৃত্ব ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটি সেই চেতনা নয়, যা মহাত্মা গান্ধীর উপবাস বা মওলানা আজাদের ধর্মোপদেশকে পরিচালিত করেছিল। আমরা নিজেদের এমন একটি দেশে বাস করছি, যেখানে আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আর আপনার প্রতিষ্ঠানগুলো লালনপালনের উত্তরাধিকারের চেয়ে  পরিচালনার বোঝা হিসাবে ভাবা হয়। এটি এক ধরনের জুলুম, যা শৃঙ্খলা ও সংস্কারের ভাষার নেপথ্যে আরও তীব্র করে তোলে। 

আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যে ইনসাফের (ন্যায়বিচার) আশা নিহিত। এটি তাদের অধ্যবসায়ের মধ্যে হাজির আছে, যারা আজ একে অপরের দুঃখ বিচ্ছিন্ন করে দেখে না। তাদের চুপ থাকা উচিত নয়, বরং কথা বলা উচিত। কারণ, জুলম সম্পর্কে নীরব হলে তা আরও বাড়তে থাকে, যা কখনও ইনসাফের দিকে পরিচালিত করতে পারে না।

আমরা ভুলতে পারি না, ‘সরফরোশি কি তামান্না’ বা মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে আত্মত্যাগের আকাঙ্ক্ষার দরকার পড়ে, যা এখনও জাতির শিরায় বেজে চলেছে। অন্যায়ের প্রতিটি মুহূর্ত তার প্রতিপক্ষকে ডাক দেয়, যা সত্যের প্রতি নতুন করে সমর্থন জোরালো করা, একটি ন্যায্য ও সবার একই ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। 

জাতির বয়ান থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করা মানে জাতির ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন করা। এর অর্থ আমির খসরুর গানের সাংস্কৃতিক প্রতিধ্বনি, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন এবং বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের করুণ সুর অস্বীকার করা। এর মধ্য দিয়ে কেবল মুসলমানদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না; ভারতকে বিচ্ছিন্ন, নীচ ও ক্ষুদ্র করে তোলা হচ্ছে। আগামীর দাবি হলো– মুসলমানদের ইনসাফের ওপর জোর দেওয়া এবং তাদের সহযোদ্ধারা জুলুমকে ভাগ্য হিসেবে নয়, বরং ব্যর্থতা হিসেবে দেখবে। এটি এমন এক ব্যর্থতা, যা তারা পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে কোনো আইন বিচার করে দেখা উচিত– এটি সাম্য, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিনা। ওয়াক্ফ আইনের সেই ভিত্তি অনুপস্থিত। এই আইন উৎসাহ কিংবা সহ্য– কোনোটাই করার সুযোগ নেই।

মনোজ কুমার ঝা: ভারতীয় রাজনীতিবিদ; দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এমন এক ধরন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

আসামে বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র মামলায় পরেশ বড়ুয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

ভারতের আসামে গত বছর একাধিক ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটানোর ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে উলফা (আই) নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। সংস্থাটি শনিবার গুয়াহাটির আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।

পরেশ বড়ুয়া নিষিদ্ধঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (ইনডিপেনডেন্ট ) চেয়ারম্যান এবং স্বঘোষিত কমান্ডার ইন চিফ। চার্জশিটভুক্ত অন্য দুজন হলেন অভিজিৎ গগৈ ও জাহ্নু বড়ুয়া।

গত বছর আসামে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন ব্যাহত করতে গুয়াহাটির দিসপুর লাস্ট গেটে একাধিক আইইডি পুঁতে রাখা হয়েছিল। এর সঙ্গে এই তিনজনের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ ঘটনা তদন্তের ভার নেয় এনআইএ।

এনআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হতাহত করা, সম্পত্তি ধ্বংস করা, ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি তৈরি এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে আইইডি স্থাপন করা হয়েছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আসামে বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র মামলায় পরেশ বড়ুয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
  • ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠক ষড়যন্ত্রকারীদের কফিনে শেষ পেরেক: প্রেস সচিব