ওয়াক্ফ আইন মুসলমানদের ছন্নছাড়া করার ষড়যন্ত্র
Published: 17th, April 2025 GMT
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ও গণতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। সংখ্যাগরিষ্ঠতামুখী রাজনীতি দ্রুত আইন পাস করতে পারে। এই ধরনের আইন ঐকমত্য ও অন্তর্ভুক্তির চেতনায় বিকশিত আইন বলে দাবি করতে পারে না। গণতন্ত্রের জন্য আলোচনা, সংবেদনশীলতা এবং সর্বস্তরের মতামতের সঙ্গে সদিচ্ছার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু ও ধর্ম, বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল, নারী-পুরুষভিত্তিক সব ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠী সবসময় নিজেদের ক্ষমতার বাইরে দেখবে। তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। শুধু তাই নয়; তাদের ওপর প্রায়ই প্রভাবশালী গোষ্ঠীরা ভাবাদর্শ, ধারণা ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়।
ভারতের অসংখ্য শহর ও গ্রামের নানা প্রান্তের মসজিদ, দরগা ও এতিমখানা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বাসের জীবন্ত সাক্ষী, যেখানে ‘ওয়াক্ফ’ শব্দটি আস্থার এক গৌরবময় ওজন বহন করে। এটি কেবল সম্পত্তির ব্যাপারে নয়; বরং দান, উত্তরাধিকার ও সম্প্রদায় সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে। এর উদ্দেশ্য মুনাফা নয়; বরং ভারতের সবচেয়ে দুর্বলদের ভরণপোষণ, শিক্ষা ও আশ্রয় দেওয়া। এটি বিদ্যমান সর্বশেষ স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটি, যা স্বয়ং নিজেকে নিজেই টিকিয়ে রেখেছে। ওয়াক্ফ সম্পত্তির অনেকটি জরাজীর্ণ। এখনও একে অন্যান্য সাধারণ সম্পত্তির মতো দেখায়। কোনো ধরনের জবাবদিহি বা সম্মতি ছাড়াই তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তীব্র করার মানে হলো জীবনকে আরও ভোগান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া।
এই সংশোধনী এমন এক প্রেক্ষাপটে এসেছে, যা ইতোমধ্যে ক্ষতবিক্ষত। এটি জবরদস্তিমূলক নীতি অনুসরণ করে, যা নির্লজ্জ অবিচারের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই তৎপরতাকে সন্দেহ করা কোনোভাবে অযৌক্তিক নয়। যখন কোনো সম্প্রদায় কাঠামোর বাইরে ঠেলে দেওয়ার প্রমাণ হাজির করে, তখন এটি কেবল ভোগান্তি হিসেবে তুলে ধরে না। বাড়ি থেকে শুরু করে খাবার পছন্দ ও কলেজ ক্যাম্পাস পর্যন্ত স্বাধীন ভারতে মুসলিম নাগরিকরা আগের চেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চনা কেবল সম্পদের অনুপস্থিতি নয়, বরং একসময় মর্যাদার দিকে চালিত দরজাগুলোর পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ করে ফেলা।
সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনটি ভাষাগত পদ্ধতির নামে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস ও অপমান করার তৎপরতা। এটি জুলম (নিপীড়ন)। এই জুলুমের মূলে কেবল অহংকার ও পাশবিক বল প্রয়োগই নয়, বরং একে অপরকে পুরোপুরি মানুষ হিসেবে দেখতে অস্বীকৃতিও রয়েছে। আইনসভা ও প্রশাসনিক লাগাম যেভাবে জোরালো করা হচ্ছে, তাতে মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক বিপজ্জনক মোড়ের সম্মুখীন।
এ ধরনের সংশোধনী সেই হাতুড়ির মতো, যার সাহায্যে মানবিক বন্ধন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। প্রতিটি দখল, ধূর্ত দাবি, স্বেচ্ছাচারী ধ্বংসলীলা এবং প্রতিটি আমলাতান্ত্রিকভাবে উপেক্ষার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা এমন একটি সমাজে পরিণত হচ্ছি, যেখানে ইনসানিয়াত ও ভ্রাতৃত্ব ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটি সেই চেতনা নয়, যা মহাত্মা গান্ধীর উপবাস বা মওলানা আজাদের ধর্মোপদেশকে পরিচালিত করেছিল। আমরা নিজেদের এমন একটি দেশে বাস করছি, যেখানে আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আর আপনার প্রতিষ্ঠানগুলো লালনপালনের উত্তরাধিকারের চেয়ে পরিচালনার বোঝা হিসাবে ভাবা হয়। এটি এক ধরনের জুলুম, যা শৃঙ্খলা ও সংস্কারের ভাষার নেপথ্যে আরও তীব্র করে তোলে।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যে ইনসাফের (ন্যায়বিচার) আশা নিহিত। এটি তাদের অধ্যবসায়ের মধ্যে হাজির আছে, যারা আজ একে অপরের দুঃখ বিচ্ছিন্ন করে দেখে না। তাদের চুপ থাকা উচিত নয়, বরং কথা বলা উচিত। কারণ, জুলম সম্পর্কে নীরব হলে তা আরও বাড়তে থাকে, যা কখনও ইনসাফের দিকে পরিচালিত করতে পারে না।
আমরা ভুলতে পারি না, ‘সরফরোশি কি তামান্না’ বা মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে আত্মত্যাগের আকাঙ্ক্ষার দরকার পড়ে, যা এখনও জাতির শিরায় বেজে চলেছে। অন্যায়ের প্রতিটি মুহূর্ত তার প্রতিপক্ষকে ডাক দেয়, যা সত্যের প্রতি নতুন করে সমর্থন জোরালো করা, একটি ন্যায্য ও সবার একই ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।
জাতির বয়ান থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করা মানে জাতির ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন করা। এর অর্থ আমির খসরুর গানের সাংস্কৃতিক প্রতিধ্বনি, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন এবং বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের করুণ সুর অস্বীকার করা। এর মধ্য দিয়ে কেবল মুসলমানদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না; ভারতকে বিচ্ছিন্ন, নীচ ও ক্ষুদ্র করে তোলা হচ্ছে। আগামীর দাবি হলো– মুসলমানদের ইনসাফের ওপর জোর দেওয়া এবং তাদের সহযোদ্ধারা জুলুমকে ভাগ্য হিসেবে নয়, বরং ব্যর্থতা হিসেবে দেখবে। এটি এমন এক ব্যর্থতা, যা তারা পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে কোনো আইন বিচার করে দেখা উচিত– এটি সাম্য, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিনা। ওয়াক্ফ আইনের সেই ভিত্তি অনুপস্থিত। এই আইন উৎসাহ কিংবা সহ্য– কোনোটাই করার সুযোগ নেই।
মনোজ কুমার ঝা: ভারতীয় রাজনীতিবিদ; দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ নারীকে হত্যায় বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার, পরিবার বলছে ষড়যন্ত্র
কুমিল্লার মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ নারীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলম সরকারকে গ্রেপ্তার করেছেন জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নে পীর কাশিমপুর গ্রাম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শাহ আলম একই এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান। ডিবি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার দাবি, প্রাথমিক তদন্তে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা মেলায় শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ওই তিন খুনের মামলায় এজাহারনামীয় আসামি।
আরও পড়ুনআড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর আর স্বীকারোক্তি দেননি ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’০৬ জুলাই ২০২৫তবে শাহ আলম ওই মামলার প্রকৃত আসামি নন বলে দাবি করেছেন তাঁর ছেলে উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আজিজ সরকার। তিনি বলেন, ‘ডিবি পুলিশ বলছে, আমার বাবাকে ট্রিপল মার্ডার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তিনি এজাহারনামীয় আসামি। তবে এ মামলার এজাহারের ২৫ নম্বরে থাকা শাহ আলম নামের আসামির বয়স ৪০ বছর। আর আমার বাবার বয়স ৭০ বছরের বেশি। এ ছাড়া আমার দাদার নাম জানেন না, এলাকায় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে আসামির পিতার নাম অজ্ঞাত রাখা হলো কেন? এটা সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র। আমার বাবাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য এই মামলায় গ্রেপ্তার করানো হয়েছে।’
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিনও বিষয়টি ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে শুনিনি তিনি (শাহ আলম) এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ঘটনার সময় বা আগে-পরের কোনো সিসিটিভি ফুটেজে তাঁকে দেখা যায়নি। আমার মনে হয়, কোথাও ভুল হচ্ছে। তাঁকে অযথা গ্রেপ্তার করে বৃদ্ধ বয়সে হয়রানি করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুনকুমিল্লায় মা, মেয়ে ও ছেলেকে হত্যার মামলায় আরও ৬ জন গ্রেপ্তার০৫ জুলাই ২০২৫ঘটনার সময় শাহ আলম ঘটনাস্থলে ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী রিক্তা আক্তার। আজ সকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনায় পীর কাশিমপুরের শাহ আলম নামের একজন জড়িত বলে যখন জানতে পেরেছি, তখন মামলায় নামটি উল্লেখ করেছি। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি বলে আমি মামলাতে আসামির বাবার নাম অজ্ঞাত রেখেছি। ডিবি পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। আমি কাউকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করতে চাই না। ডিবি পুলিশের তদন্তে যদি তিনি ঘটনায় জড়িত থাকেন, তাহলে গ্রেপ্তার করুক; না হলে, আমি চাই না কোনো নিরীহ মানুষের হয়রানি হোক।’
ঘটনার প্রায় এক মাস পার হলেও প্রধান আসামি শিমুল বিল্লাহ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ক্ষোভ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রিক্তা। তিনি বলেন, ‘শিমুল গ্রেপ্তার না হলে যেকোনো সময় আমার ওপর হামলা হতে পারে, আমাকে হত্যাও করতে পারে। আমি দ্রুত তার গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।’
আরও পড়ুনকুমিল্লায় মা, মেয়ে ও ছেলেকে হত্যার ৩৯ ঘণ্টা পর মামলা, আটক ২০৫ জুলাই ২০২৫সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন কুমার চক্রবর্তী বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে শাহ আলমের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে মামলাটির মোট ১০ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৯ আসামি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। নতুন করে গ্রেপ্তার শাহ আলমকে আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। বাকি আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
৩ জুলাই সকালে উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে মা, ছেলেমেয়েসহ একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ওই গ্রামের রোকসানা বেগম (৫৩), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে তাসপিয়া আক্তার (২৯)। পরদিন রাতে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানায় মামলা করেন রোকসানার বড় মেয়ে রিক্তা আক্তার। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে আকুবপুর ইউপির চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহকে। তিনি পলাতক আছেন।
আরও পড়ুনমুঠোফোন চুরিকে কেন্দ্র করে খেপিয়ে তোলা হয় এলাকাবাসীকে০৩ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনকুমিল্লায় মাদক বেচাকেনার অভিযোগে মা ও দুই সন্তানকে গণপিটুনি, কুপিয়ে হত্যা০৩ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনস্থানীয় ইউপি সদস্যের পরিকল্পনায় মুরাদনগরে ‘মব’ সৃষ্টি করে তিনজনকে হত্যা০৫ জুলাই ২০২৫