জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা ছিল, বল প্রয়োগভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নাগরিক অধিকারভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন। কিন্তু অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকে রাখার ঘটনা একটা ভয়ানক বার্তা দিচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য সন্দেহভাজন যে কাউকে আটক করতে পারে। এই আইন বাতিলের কথা বিএনপি ’৯১-এর নির্বাচনী ইশতেহারে রাখলেও ক্ষমতায় গিয়ে তা অক্ষত রাখে। বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি সংসদ এই আইন বাতিল না করে তা রক্ষা করে গেছে। 
জুলাই আন্দোলন বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সব জনবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী আইন ও ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের দাবি জানায়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কাঠামোর বিলুপ্তি দাবি করে। অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে হবে বল প্রয়োগের ভিত্তিতে নয়; বরং জনগণের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারকে ভিত্তি করে। জুলাই ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লেমেশনে স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা থাকার কথা ছিল– বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হবে জনগণের সার্বভৌমত্ব, যা ব্যক্তির মর্যাদা, অধিকার ও বিকাশ নিশ্চিত এবং সুরক্ষিত করবে। এই প্রোক্লেমেশন এখনও হাজির না করতে পারা জুলাইকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। 

একবার ভাবুন– বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, র‍্যাব আইন, ৭০ অনুচ্ছেদসহ সব জবরদস্তিমূলক আইন অক্ষত রয়েছে; সব ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি অক্ষত রয়েছে; আপনি শুধু সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই সরকার কীভাবে আপনার নাগরিক অধিকার, আপনার স্বাধীনতা এবং আপনার মর্যাদা নিশ্চিত করবে? আপনার সংবিধান আবার একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন বা সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র আরোপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে। আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ বা বাধা 
দেওয়ার জন্য সব কঠোর জবরদস্তিমূলক আইন প্রয়োগ করা হবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হলে কোনো অবস্থাতেই, কোনো অজুহাতেই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা যাবে না। রাষ্ট্রের সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে জরুরি অবস্থা মানে সরকারের গদি অরক্ষিত হয়ে পড়া। তাই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করে জরুরি অবস্থা দেয় তারা। 
রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, তা-ই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার উৎস। নতুন গণক্ষমতা মানেই নতুন আইন, নতুন সংবিধান। যারা এখন মৌলিক রাষ্ট্র কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই দ্রুত সংসদীয় নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তারা মূলত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে চাইছেন। তারা বর্ষার এই বিপ্লবকে শুধু ভোট বাক্সে সীমাবদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন।

শেখ হাসিনার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জালিয়াতির নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখা আর জুলাই বিপ্লবীদের রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’কে এক করে দেখিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন বানচাল করতে চাইছেন কিছু রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী। অথচ দুটো এক না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংস্কারপন্থিরা নির্বাচন চাইছেন, কিন্তু তা সংস্কারের পর। আর শেখ হাসিনা কথিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেননি। ফলে যারা দুই বিপরীত বিষয়ের তুলনা দিচ্ছেন, তাদের কথায় বড় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগত বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করেছেন– ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’, যা পাকিস্তান আমলের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মডেল। এখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার এবং পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। যে রাষ্ট্র কাঠামোতে ফ্যাসিবাদ স্তরে স্তরে বিদ্যমান, তার বিলোপ সাধন এই অন্তর্বর্তী সরকার না করলে তা নতুন নির্বাচিত সংস্কার করবে বলে আস্থা রাখা কঠিন। তখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা আর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের অজুহাত তোলা হবে। এ দেশের শাসকগোষ্ঠী ’৭২-এ এসব করেনি, ’৯০-এও করেনি। বরং সংসদ হয়ে উঠেছে জনগণকে নির্যাতন করা আর তাদের অধিকার হরণের আইন প্রণয়নের কেন্দ্র। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচিত সংসদ যেমন ২৭টি সংস্কার প্রস্তাব মানেনি, একই রকম এখনও নতুন সংসদ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে বলে আমাদের আস্থা নেই। 

দুনিয়াজুড়েই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর নতুন সংবিধান করে আগে রাষ্ট্র গঠন বা পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা হয়, তারপর সংসদ বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেওয়া হয়। ইউনূস সরকারকেই তাই রাষ্ট্র সংস্কার ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে হবে এবং রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের রোডম্যাপ দিতে হবে। এ জন্য সাংবিধানিক সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন, নাগরিক অধিকার হরণকারী আইনি কাঠামো উচ্ছেদ বা ব্যাপক সংস্কার, গণবিরোধী আমলাতন্ত্র, জবরদস্তিমূলক নিরাপত্তা সংস্থা, বিজনেস অলিগার্ক নিয়ন্ত্রিত লুটেরা অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈপ্লবিক সংস্কারের রোডম্যাপ দিতে হবে। বল প্রয়োগের ভিত্তিতে নয়, বরং জনগণের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে এবং তার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের রোডম্যাপ দিতে হবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পর একটি সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। 

ড.

যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন র ব শ ষ ক ষমত ব যবস থ জনগণ র ন র পর র জন য নত ন স র গঠন আপন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রিজভীর ভাইকে কুপিয়ে জখম, গ্রেপ্তার ৩

নোয়াখালী জেলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভীর ছোট ভাই স্কুলছাত্র শাহরিয়ার হাসান রিমনকে (১৬) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে আহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রবিবার (২৮ এপ্রিল) রাতে সুধারাম মডেল থানায় রিমনের মা বাদী হয়ে দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম ও ছবি প্রকাশ করেনি।

এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে।

আহত শাহরিয়ার হাসান রিমন জেলা শহরের বসুন্ধরা কলোনি বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন ও ফরিদা ইয়াছমিন দম্পত্তির ছেলে। সে স্থানীয় হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

আরো পড়ুন:

কুমিল্লায় বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু

ধর্ষণের অভিযোগে গণপিটুনি, কারাগারে ইমামের মৃত্যু

বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে রোববার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে কিশোর গ্যাং সদস্যরা শাহরিয়ার হাসান রিমনকে ধারালো ছুরি এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এতে সে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তবে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

এ ঘটনায় রাতে আহত রিমনের মা ফরিদা ইয়াছমিন ২১ জনকে এজহারভুক্ত ও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ রাতেই অভিযান পরিচালনা করে তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।

রিমনের  মা ফরিদা ইয়াছমিন জানান, রিমনের পিঠে, মাথায়সহ মোট ছয়টি ছুরির আঘাত করা হয়। তার অপারেশন ঢাকা মেডিকেল কলেজে করানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসা চলছে। তার পিঠের আঘাতগুলো ফুসফুস পর্যন্ত চলে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

তিনি আরো জানান, হামলাকারীরা ভেবেছিল রিমন মারা গেছে। যখন জানতে পারে সে বেঁচে আছে, তখন তারা ফের হামলা করতে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। রিমনের অপরাধ দুই দল কিশোরের মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব মিমাংসা করে দেওয়া। একপক্ষ মানলেও অপরপক্ষ মিমাংসার বিষয়টি মন থেকে মানতে পারেনি। তারাই আমার ছেলের উপর হামলা করেছে।

রিমনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, রিমনকে ধারালো ছুরি দিয়ে মোট ছয়টি আঘাত করা হয়েছে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপতালে নেওয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি রিমনের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন।

ঢাকায় রিমনের সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদা সুলতানা ইতু জানান, রাতেই রিমনের সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। এরপর তার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, রিমনের পিঠের আঘাতগুলো গুরুতর। ছুরির আঘাত প্রায় ফুসফুস পর্যন্ত চলে এসেছে। তার সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।

রবিবার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে জেলা শহরের বার্লিংটন মোড়ে একদল কিশোর রিমনকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নোয়াখালী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বার্লিংটন এলাকাটি কিশোর গ্যাংয়ের আখড়া। এই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, হরিনারায়ণপুর স্কুল, সরকারি মহিলা কলেজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা যাতায়াত করে। প্রতিদিন তাদের উত্ত্যক্ত করা হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রশাসনেরও নজরদারি নেই।

এদিকে, রিমনকে ছুরিকাঘাত করে আহত করার প্রতিবাদে তার স্কুলের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্কুলের সামনে প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থী ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী, স্কুলের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তারা অবিলম্বে রিমনের উপর যারা হামলা করেছেন, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এজহারভুক্ত একজনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনায় আমাদের আরো অনুসন্ধান চলছে। সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অপরাধীদের খুব দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি। 
 

ঢাকা/সুজন/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংস্কারের একাল-সেকাল
  • তরুণ সমাজ দেশপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে, বাংলাদেশ উচ্চস্থানে উন্নীত হবে : ডিসি
  • শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ মির্জা ফখরুলের
  • ঐকমত্য কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে দ্রুত রাজনৈতিক বোঝাপড়া সম্ভব: সাইফুল হক
  • গণঅভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনীতিতে প্রাণপ্রবাহ
  • জুলাই বিপ্লবী মেয়েরা আজ নিরাপদ বোধ করছে না: ফরহাদ মজহার
  • আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত দুজন শনাক্ত  
  • ড. ইউনূস অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেননি, আমাদের হাতে বিপ্লবের দলিল নেই: ফরহাদ মজহার
  • ড. ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ফসল, নেতা নন: ফরহাদ মজহার
  • গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রিজভীর ভাইকে কুপিয়ে জখম, গ্রেপ্তার ৩