বাঙালির নানা রূপের চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে বৈশাখী মেলা একটি। ঐতিহাসিকভাবে মেলার জন্য বিখ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত জনপদ তাড়াশ। তাড়াশের কলেজশিক্ষক মোছা. মাসুমা খাতুন বলেন, ‘যেহেতু এই গ্রামীণ জনপদেই জন্ম, সেহেতু চৈত্রসংক্রান্তিতে শ্মশান থেকে হাজরা ছোটা, বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় দোল খেলা, বায়োস্কোপে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দৃশ্য দেখে কষ্ট পাওয়া, পতুল নাচ, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, জাদু খেলা দেখা বা সার্কাসের ইয়া বড় হাতি দর্শন জীবনের এক বড় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদের জন্য টিন বা কাঠের বন্দুক, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, আম কাটার চাকু, নিজের ও বোনদের কাচের লাল চুড়ি, চুল বাঁধার ফিতা, বনানী নামের স্নো কেনাসহ উপভোগ্য বহু ঘটনা এখনও আমায় স্মৃতিকাতর করে।’
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, আশি ও নব্বই দশকেও তাড়াশে অনুষ্ঠিত হওয়া বেশ কয়েকটি বড় মেলায় সন্ধ্যারাত থেকে কুপি বাতি, হারিকেন, হ্যাজাক জ্বালিয়ে চলত নানা অনুষ্ঠান, হরেক রকমের পণ্যের বিকিকিনি। এখন তা চলছে বিদ্যুতের বাতিতে। তাড়াশের ২৯টি বার্ষিক মেলার সবই দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় চান্দ্রক্ষণের ওপর নির্ভর করে। মূলত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায় চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ– এ তিন মাসে ২৯টি মেলার আয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রামে; যার অধিকাংশ মেলার স্থান শত বা অর্ধশত বছর আগে নির্ধারিত। এগুলোর মধ্যে উপজেলা প্রশাসন মেলার ব্যাপকতা, লোক সমাগম ও গুরুত্ব বিবেচনা করে শতবর্ষী বা শতবর্ষের কাছাকাছি ১৭টি মেলাকে একদিনের বিশেষ হাট হিসেবে ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় বা টোল আদায় করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বেহুলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বৈশাখী পূর্ণিমায় বিনসাড়া গ্রামে বসে তিন দিনের বেহুলা সুন্দরীর ‘চাঁদের মেলা’। চৈত্রের পূর্ণিমার রাতে তাড়াশের ‘বারুহাঁসের ভাদাই মেলা’, বৈশাখের তৃতীয় মঙ্গলবার বসা বড় ও ছোট ‘গুড়মা মেলা’ এবং কৃষ্ণা দিঘির ‘কৃষ্ণপুরের মেলা’ অন্যতম। অন্যদিকে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে বসে ‘গোনতা মেলা’, ‘মাঝদক্ষিণা মেলা’, ‘রানীর হাট মেলা’, ‘আড়ংগাইল মেলা’, ‘দোবিলা মেলা’, ‘বস্তল মেলা’, ‘কুন্দইল মেলা’, ‘গুড়পিপুলের নিশানের মেলা’ প্রভৃতি।
এসব মেলা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেওয়াজ; যা কমবেশি আজও বিদ্যমান। মেলার আগেই ঝি, জামাই, কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনকে নাইওর আনার প্রচলন রয়েছে এ জনপদে। আজও ‘বারুহাঁস’, ‘গুড়মা’, ‘রানীর হাট’, ‘বেহুলার মেলা’সহ অনেক মেলা বসার আগেই স্থানীয় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে জামাই, আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা থাকে। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈশাখী মেলার সতেজ আমেজ। সে আমেজে রেওয়াজ মেনে শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে শাশুড়ির হাত দিয়ে নতুন-পুরোনো সব জামাইকে মেলার ‘পরবি’ (নগদ টাকা) এবং মেলা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নতুন পোশাক, বিশেষ করে দামি লুঙ্গি উপহার দেওয়া এবং মেলার ঝুরি, মুড়কি, শাঁস, শুকনা মিষ্টি, রান্না করা খাবার বেঁধে আত্মীয় বাড়িতে পাঠানোর চল এখনও রয়েছে। নাইওরে আসা জামাইদেরও এসব মেলায় বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। মেলা থেকে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি, বড় মাছ, মাংস, শাশুড়ির জন্য পান-সুপারি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জামাই শ্বশুরের নাম রাখতে প্রতিযোগিতা করে মেলার সবচেয়ে বড় মাছ কিনে থাকেন। এ ছাড়া শ্যালক-শ্যালিকা ও তাদের সন্তানসহ ছোটদের মেলার পরবি দেওয়া বা অন্য উপহারের আবদার মেটানোও জামাইদের পুরোনো রেওয়াজ। তাড়াশের বৈশাখী মেলায় চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি আকৃতির ছাঁচ, খাগড়াই, বাতাসা, কদমা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আরও রয়েছে বাহারি মিষ্টি রসগোল্লা, চমচম, ছানার জিলাপি, রসমালাই, শাহি, ক্ষীরশা দই। এ ছাড়া মেলায় শত শত মণ ঝুরি বিক্রি হয়। বাঁশ-বেতের জিনিস, কাঠের আসবাব, মসলা, শীতলপাটি, মৃৎ পাত্র, খেলনা, কসমেটিক সামগ্রী, কৃষিজ উপকরণ– হরপাট, কারাল, ডালি, টুপরি, চালুন, কুলা এমনকি হাতপাখা, চুন, পান-সুপারি ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে তাড়াশের ২৯টি মেলায় দুই-আড়াই মাসের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়। তাড়াশের নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সনাতন দাশ বলেন, ‘এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়। সব বয়সী লাখো মানুষের মেলাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির অদৃশ্য খোরাক পূরণ হয় এসব মেলায়। উৎসবের মূল্যের কাছে অর্থের মূল্য অতি নগণ্য।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব শ খ উৎসব
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ