পরিবেশ নিয়ে নবীজি(সা.) এর ১০ শিক্ষা
Published: 19th, April 2025 GMT
আধুনিক যুগে পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি নবীজির (সা.) জীবন ও হাদিস নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়—এসব সবুজ ভাবনার গভীরতর ভিত্তি ইসলামের মধ্যেই বহু আগে থেকে বিদ্যমান।
নবীজির (সা.) পরিবেশ-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি দুনিয়ার উপকারিতা ছাড়াও পরকালের সওয়াবের সঙ্গে এ বিষয়টি জুড়ে দিয়েছেন। নিচে মহানবীর (সা.
শেষ মুহূর্তে হলেও গাছ লাগাও
হজরত আনাস (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন ‘কিয়ামত কায়েম হওয়ার মুহূর্ত এসে পড়লেও যদি তোমার হাতে একটি খেজুর গাছের চারা থাকে, তবে তা রোপণ করে দাও।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১২,৪৯১)
এই হাদিসটি আমাদের শেখায়, জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্তও একজন মুসলমানের দায়িত্ব রয়ে যায় পরিবেশের জন্য অবদান রাখার। গাছ লাগানোর মতো একটি ক্ষুদ্র কর্মও চিরস্থায়ী সওয়াব বয়ে আনতে পারে।
আরও পড়ুন নবীজি (সা.)-এর কান্না২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫গাছ লাগানো সদকা
হজরত আনাস (রা.) কাছ থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি গাছ লাগায় বা কোনো ফসল বপন করে এবং তা থেকে যদি কোনো পাখি, মানুষ বা জন্তু খায়, তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩২০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৫৫২)
অর্থাৎ, গাছ বা ফসল রোপণ করা শুধু পার্থিব উপকারেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সদকায়ে জারিয়া (অব্যাহত দান)-এর মর্যাদা পায়। মানুষ, পাখি বা পশু—যে-কেউ উপকৃত হলে মুসলমান এর জন্য সওয়াব অর্জন করে।
ইবাদতেও অপচয় নয়
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, একদিন নবীজি (সা.) হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তখন অজু করছিলেন। নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত অপচয় কেন?’ সা’দ বললেন, ‘অজুতে কি অপচয় হয়?’ নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি যদি তুমি প্রবাহমান নদীর থেকেও অজু করো।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ৭,০৬৫)
এই হাদিস শিখায়, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সংযমী হওয়া জরুরি, এমনকি তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হলেও। যদিও অধিক পানি ব্যবহার করাকে অনেকে অপচয় বলে মনে না।
আরও পড়ুনজুরাইজ এবং তাঁর মা১১ এপ্রিল ২০২৫পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ইমানদারের দায়িত্ব
হজরত মুআয (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সাধারণ) সতর্ক করে বলেছেন, ‘তিনটি কাজ থেকে সাবধান থেকো—যেগুলোর কারণে মানুষ অভিশপ্ত হয়: ১. এমন ছায়াযুক্ত স্থানে মলত্যাগ করা, যা মানুষ ব্যবহার করে, ২. চলাচলের পথের মধ্যে মলত্যাগ করা, ৩. পানি সংগ্রহের জায়গায় অশুচি করা।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২৬)
এই হাদিস স্পষ্টভাবে পরিবেশ ও জনসাধারণের উপযোগিতার স্থানসমূহ রক্ষা করার নির্দেশনা দেয়। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম শুধুই ব্যক্তি ইবাদতের শিক্ষা দেয় না, সামাজিক সচেতনতার দিকেও গুরুত্ব দেয়।
রাস্তা থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরানো
হজরত আবু যার গিফারী (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘রাস্তা থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে দেওয়াও এক প্রকার সদকা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,০০৯)
এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর হাদিসটি আমাদের শেখায়—পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষুদ্র কাজগুলোও আল্লাহর দরবারে সদকা হিসেবে গণ্য হয়।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.) এবং এক কুস্তিগিরের গল্প১০ এপ্রিল ২০২৫প্রতিবেশীর খেয়াল রাখা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘আসল মুমিন সে নয়, যে নিজে পরিপূর্ণ খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২০০১৭)
এই হাদিসটি আজকের ভোগবাদী সমাজে একটি অত্যন্ত মূল্যবান শিক্ষা। মুসলমানকে শুধু নিজের আরাম নয়, আশপাশের মানুষের অবস্থার প্রতিও সচেতন থাকতে হবে। একদিকে এই বার্তা খাদ্য অপচয় রোধে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে সমাজে মানবিক সহমর্মিতা গড়ে তোলে।
বস্তুর পুনর্ব্যবহার
নবীজি (সা.) ঘরে কী করতেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রিয় স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা.) বলেন: ‘তিনি নিজের জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং সাধারণ মানুষের মতো ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন।’ (আল-আদবুল মুফরাদ, হাদিস: ৫৩৮)
এই হাদিস আমাদের শেখায়, কোনো বস্তু একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার শিক্ষা নবীজির (সা.) নয়। গৃহস্থালি কাজে অবহেলা করতেন না এবং ছেঁড়া কাপড় বা জুতা সেলাই করে পরতেন, ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নষ্ট করতেন না।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.) এবং এক ইহুদি ছেলের গল্প০৫ মার্চ ২০২৫অন্যায়ভাবে প্রাণী হত্যা না করা
নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া একটি চড়ুই পাখি বা তার চেয়েও বড় কোনো প্রাণী হত্যা করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জবাবদিহির জন্য ডাকবেন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, ন্যায়সংগত কারণ কী?’ তিনি বললেন, ‘যদি কেউ তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে জবাই করে, তাহলে ঠিক আছে; কিন্তু শুধু মাথা কেটে ফেলে দিলে, তা অন্যায়।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৪,৪৪৫)
এই হাদিস পরিবেশ-সচেতনতা ও প্রাণীর অধিকারের স্পষ্ট শিক্ষা দেয়। ইসলাম জীবন ও প্রাণের প্রতি অত্যন্ত সম্মান দেখায়—এমনকি একটি ছোট পাখির জীবনকেও।
পশুপাখির সেবাও পুণ্য
হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘এক ব্যক্তি একবার পথ চলতে গিয়ে তৃষ্ণায় কাতর হয়। সে একটি কূপ পেয়ে তাতে নেমে পানি পান করে। উঠে এসে সে দেখে, একটি কুকুর মাটি চেটে খাচ্ছে—তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছে। লোকটি ভাবল, ‘এই কুকুরটি তো আমার মতোই তৃষ্ণার্ত।’ সে আবার কূপে নেমে নিজের জুতা পানি দিয়ে ভরে মুখে করে তা তুলে এনে কুকুরকে পান করাল। আল্লাহ তার এই কাজকে পছন্দ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, পশুপাখিকে পানি পান করানোতেও কি সওয়াব আছে?’ তিনি বললেন: ‘প্রত্যেক প্রাণীকে সেবা করায় সওয়াব আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩৬৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৪৪)
প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘এক নারী জাহান্নামে প্রবেশ করেছে একটি বিড়ালের কারণে। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল, খাবার দেয়নি; আবার ছেড়ে দেয়নি যাতে সে মাটি থেকে পোকামাকড় খেতে পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৪২)
নিষ্ঠুরতা যেকোনো জীবের প্রতিই হোক না কেন, তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত। ইসলাম শুধু উপকার নয়, অনিষ্ট থেকে বিরত থাকার নির্দেশও দেয়।
এই দশটি হাদিস চৌদ্দশো বছর আগের হলেও আজকের পরিবেশ সংকট ও সামাজিক বৈষম্যের যুগে আশ্চর্যরকম প্রাসঙ্গিক। গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পানি অপচয় রোধ, প্রাণী সেবার গুরুত্ব ও সামাজিক সহমর্মিতা—সবকিছুতেই নবীজি (সা.) আমাদের সামনে রেখে গেছেন এক অনন্য সবুজ দর্শন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি ইসলামের এই চেতনা অনুসরণ করলেই গড়ে উঠতে পারে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দায়িত্বশীল ও কল্যাণময় সমাজ।
আরও পড়ুনরাগ সংবরণ করার উপায় নিয়ে মহানবী (সা.)–এর পরামর্শ২১ জানুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর ণ ত হ দ স এই হ দ স ম সলম ন ব যবহ র র জন য আম দ র বল ছ ন আল ল হ পর ব শ বলল ন করল ন করত ন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।