প্রাণনাশের ভয় নিয়ে পালাতে হয়েছিল, দাবি হাথুরুসিংহের
Published: 21st, April 2025 GMT
জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে প্রধান কোচের দায়িত্ব হারান চান্দিকা হাথুরুসিংহে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে সেই অধ্যায়ের পর্দা একটু খুললেন শ্রীলঙ্কান এই কোচ। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ ছাড়ার সময় তিনি প্রাণনাশের ভয় পর্যন্ত পেয়েছিলেন। জনরোষের মুখে পড়তে পারেন, এমন ভয়ও নাকি জেগেছিল তার মনে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চূড়ায় ওঠে। গণঅভ্যুথানে সরকার পরিবর্তনের পর গত আগস্টে পরিবর্তন আসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেও। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ফারুক আহমেদ। দায়িত্ব পেয়ে গত অক্টোবরের মাঝামাঝিতে প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে হাথুরুসিংহেকে সরিয়ে দেন তিনি।
বিশ্বকাপে স্পিনার নাসুম আহমেদকে হেনস্তা করার অভিযোগ ছিল হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে। আরও কিছু আচরণগত অভিযোগে তাকে ‘কারণ দর্শানোর’ নোটিশ দিয়েছিল বোর্ড। মাত্র একদিনেই তার জবাব পাঠান হাথুরুসিংহে। কিন্তু সেটিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে বিসিবি চুক্তি বাতিল করে দেয়।
সম্প্রতি ‘কোড স্পোর্টস’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ছাড়ার সেই সময়কার ভয়ের কথা বলেন হাথুরুসিংহে। তার দাবি, বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে তিনি সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন- ‘আপনার যাওয়া উচিত, আপনি কি টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন?’
হাথুরুসিংহে বলেন, ‘তখনই টের পাই, আমার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। সাধারণত আমার সঙ্গে একজন ড্রাইভার ও একজন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী থাকতেন। সেদিন কেবল ড্রাইভার এসেছিলেন।’
এরপর ব্যাংকে টাকা তুলতে গেলে টিভির ব্রেকিং নিউজে জানতে পারেন, তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং একজন ক্রিকেটারকে হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ‘ব্যাংকের ব্যবস্থাপক তখন বললেন, ‘কোচ, আপনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দেব, কারণ আপনি রাস্তায় নিরাপদ নন।’ তখন সত্যিই ভয় পেয়ে যাই।’ যোগ করেন হাথুরুসিংহে।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, হুডি ও ক্যাপ পরে তিনি মধ্যরাতের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন। বিমানবন্দরে কোনো আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা ছিল না। প্রবেশপথে এক বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার আবেগমাখা বিদায়বাক্যও তাকে নাড়িয়ে দেয়, ‘আমি দুঃখিত কোচ, আপনি আমাদের দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন।’
রাজনৈতিক অস্থিরতার সেই সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কেও ভুগছিলেন হাথুরুসিংহে। জানান, ‘সাবেক সরকারের একজন মন্ত্রী দেশ ছাড়ার সময় রানওয়েতে তার বিমান থামিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমিও আশঙ্কায় ছিলাম, যদি আমাকে থামিয়ে দেওয়া হয়।’
যদিও তবে সাক্ষাৎকারে হাথুরুসিংহের বক্তব্যে যে আতঙ্কের কথা এসেছে, সেটা একটু অমূলকই। তার জন্য ওই সময়ের পরিস্থিতি যতটা ভীতিকর ছিল বলে তিনি বর্ণনা করেছেন, আসলে সে রকম কিছুই ছিল না। বরং বাংলাদেশ দলের সমর্থকদের অনেকে যেমন চেয়েছিলেন হাথুরুসিংহকে বিদায় করা হোক, অনেকে আবার তার পক্ষেও ছিলেন। হাথুরুসিংহেকে রেখে দিলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে, এমনটা মনে করা মানুষেরও অভাব ছিল না তখন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ