মহানবী মুহাম্মদ (সা.) গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন যে, নবীদের মধ্যে একটি ঈমানী বন্ধন ও একক বার্তার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি জানতেন, তাঁর লক্ষ্যও পূর্ববর্তী নবীদেরই ধারাবাহিকতা।

যখনই কোনো প্রসঙ্গে কোনো নবীর কথা স্মরণ করা হতো বা তাঁদের নাম উচ্চারিত হতো, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাভরে তাঁদের সম্পর্কে কথা বলতেন। তিনি তাঁদের ‘নবুওয়াতের ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন, যা থেকে বোঝা যায়, নবুওয়াতের বন্ধন তাঁর কাছে ছিল এক ভালোবাসার সূত্র। তিনি বিনয় ও কৃতজ্ঞতাভরে তাঁদের গুণাবলির কথা বলতেন এবং তাঁদের সম্মান করতেন।

ইবনে আব্বাস (রা.

)-এর বর্ণিত একটি হাদিসে আছে যে রাসুল (সা.) তাঁর পূর্বসূরি ও নবুওয়াতের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর মর্যাদা তুলে ধরে বলেছেন: ‘কিয়ামতের দিন সবার আগে যে ব্যক্তি পোশাক পরিধান করবেন, তিনি হবেন ইব্রাহিম (আ.)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৩৭৭)

রাসুল (সা.) তাঁর নবী ভাই সুলায়মান (আ.)-এর রাজত্বের প্রশংসাও গর্বভরে বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সুলায়মান (আ.) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন এমন এক রাজত্বের জন্য, যা তাঁর পরে কেউ পাবে না। আল্লাহ তা তাঁকে দান করেছিলেন।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ১০,৪৭৪)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি ঈসা (আ.)-কে ‘নিকটজন’ বলার মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুনিয়া ও আখিরাতে সকল মানুষের মধ্যে আমিই ঈসা ইবনে মরিয়মের সবচেয়ে নিকটজন। নবীগণ একে অপরের ভাই, তাঁদের মায়েরা ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের দীন এক।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৪৪৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৫)

তাঁর মা মরিয়ম (আ.)-এর বিশেষ মর্যাদার কথাও তুলে ধরেছেন, যা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যতিক্রমী সম্মান। আল্লাহর রাসুল (সা.) তা অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান স্পর্শ করে নি, তাই সে চিৎকার করে ওঠে। তবে মরিয়ম ও তাঁর সন্তান (ঈসা)-কে শয়তান স্পর্শ করতে পারেনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৬)

একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তায়েফে ইসলাম প্রচারে যান। সেখানকার মানুষ তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং এমনকি শিশুরাও তাঁকে পাথর ছুঁড়ে আহত করে। অবশেষে তিনি ও তাঁর খাদেম একটি আঙুর-বাগানে আশ্রয় নেন। বাগানের একজন খ্রিষ্টান কর্মচারী তাদের কিছু আঙুর খেতে দেন। রাসুল (সা.) আঙুর খাওয়ার আগে কিছু অচেনা বাক্য উচ্চারণ করেন। তখন কর্মচারী বিস্ময়ভরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ নবীজি (সা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কোথাকার লোক?’ সে উত্তর দেয়, ‘আমি নিনেভেহ শহরের খ্রিষ্টান (ইরাকের উত্তরে)।’

রাসুল (সা.) তখন আনন্দভরে বলেন, ‘তুমি কি ইউনুস ইবনে মাত্তার শহর থেকে?’

লোকটি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ইউনুসকে কীভাবে চিনেন?’

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি ছিলেন নবী, আমিও নবী।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম সফিউর রহমান মুবারকপুরি)

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক মুসলিম ও এক ইহুদি তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কথার মধ্যে মুসলমান বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি মুহাম্মদকে সকল মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন!’ ইহুদি বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি মুসাকে সকল মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন!’

এ কথা শুনে মুসলমান ব্যক্তি রাগে ইহুদিকে চড় মারেন। তিনি ভাবলেন, নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে অপমান করা হয়েছে। এই ঘটনা রাসুল (সা.)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, ‘মুসার ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠ বলো না। কিয়ামতের দিন যখন সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়বে, তখন আমি সবার আগে জ্ঞান ফিরে পাব। কিন্তু তখন দেখব, মুসা (আ.) আরশের পাশ ধরে আছেন। আমি জানি না, তিনি কি আমার আগেই জ্ঞান ফিরে পাবেন, নাকি আল্লাহ তাঁকে দুনিয়ায় একবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণে বিশেষ রেহাই দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৭৩)

এই হাদিসের আরেক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই ঘটনায় রেগে গিয়েছিলেন এবং তাঁর চেহারায় রাগের প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। তিনি নবীদের মধ্যে এ ধরনের তুলনায় লিপ্ত হওয়াকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেন।

অন্য এক হাদিসে আছে, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মানুষদের মধ্যে কে সবচেয়ে সম্মানিত?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে খোদাভীরু।’ তারা বলল, ‘আমরা এ বিষয়ে জানতে চাই না।’ তিনি বললেন, ‘তবে, আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি ছিলেন আল্লাহর এমন নবীর পুত্র, যিনিও আল্লাহর নবীর পুত্র, তিনিও আল্লাহর খলিলের পুত্র।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৩৮৩)

মদিনায় হিজরতের পর নবীজি (সা.) খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের প্রতি সম্মানজনক মনোভাব বজায় রাখেন। একবার নাজরান শহর থেকে ৬০ সদস্যবিশিষ্ট একটি খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে। নবীজি (সা.) তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে স্বাগত জানান। মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল পরিবেশে তাদের বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করেন। আলোচনার শেষে, নাজরানের খ্রিষ্টানরা শান্তিপূর্ণভাবে মদিনা ত্যাগ করেন।

যদিও মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন এবং নবুওয়াতের শৃঙ্খলে পূর্ণতা এনেছেন, তবুও তিনি সর্বদা নিজেকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তুলে ধরতেন। তিনি একবার বলেছিলেন: ‘লোকসকল, আল্লাহকে ভয় করো এবং শয়তানের ধোঁকায় পড়ো না। আমি মুহাম্মদ, আবদুল্লাহর পুত্র। আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমি চাই না তোমরা আমাকে আল্লাহর নির্ধারিত অবস্থানের চেয়ে বেশি উচ্চে তুলে ধরো।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১২,৫৫৫)

বিভিন্ন হাদিসে রাসুল (সা.) দেখিয়েছেন যে, নবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু দুনিয়ার নয়—আখিরাতেও তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ। তাঁর কথায় কখনো ঈর্ষার লেশমাত্র প্রকাশ পায়নি, বরং ছিল অন্যদের প্রতি প্রশংসা ও স্বীকৃতি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের সম্মান করা, তাঁদের কৃতিত্ব তুলে ধরা এবং তাঁদের প্রতি বিনয় ও ভ্রাতৃত্বের মনোভাব পোষণ করা মুসলিম চরিত্রের অংশ। তিনি নবুওয়াতের শৃঙ্খলে এক ঐক্যের বার্তা তুলে ধরেছেন, যেখানে সব নবী ছিলেন এক উদ্দেশ্যে প্রেরিত—আল্লাহর একত্ববাদ ও মানুষের কল্যাণের জন্য।

সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট কম

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স কর ম হ ম মদ আল ল হ একব র বলত ন বলল ন সবচ য

এছাড়াও পড়ুন:

মানুষের ‘দ্বিতীয় ঘুম’এর যুগ সম্পর্কে কতটা জানেন

তেলের বাতি, গ্যাসের বাতি এবং বৈদ্যুতিক বাতি ক্রমে সভ্যতায় যোগ হয়েছে। এর আগে মানুষ প্রাকৃতিক আলোর সঙ্গে মানিয়ে জীবন যাপন করতো। প্রাক-শিল্প যুগের সমাজে ‘দ্বিতীয় ঘুম’-এর অভ্যাস ছিলো মানুষের। 

দ্বিতীয় ঘুম বলতে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত এমন এক ধরনের ঘুমের ধরণকে বোঝায়, যেখানে মানুষ রাতে একটানা আট ঘণ্টা না ঘুমিয়ে ঘুমকে দুটি ভাগে ভাগ করে নিত। একে দ্বি-পর্যায়ের ঘুম বা খণ্ডিত ঘুম বলা হয়। দেখা যেত যে— সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পর মানুষজন বিছানায় যেত এবং প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ঘুমাত। 

আরো পড়ুন:

রক্তস্বল্পতা দূর করতে এই শাক খেতে পারেন

টানা ৬ মাস রাতের খাবার দেরিতে খেলে যা হয়

প্রথম ঘুমের পর তারা প্রায় এক ঘণ্টা জেগে থাকত। এই সময়ে বাড়ির হালকা কাজ করা, প্রার্থনা করা, পড়াশোনা করা, প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করা বা অন্তরঙ্গ কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার মতো কাজগুলো করতো।

তারা আবার বিছানায় ফিরে যেত এবং ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত আরও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ঘুমাত, যাকে ‘দ্বিতীয় ঘুম’ বা ‘ভোরের ঘুম’ বলা হত।

গত দুই শতাব্দী ধরে সামাজিক জীবনে আসা পরিবর্তনের কারণে মানুষের দ্বিতীয় ঘুমের অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেসব কারণে মানুষ দ্বিতীয় ঘুমের অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে, তার একটি হলো ‘কৃত্রিম আলো ব্যবহার।’
১৭০০ এবং ১৮০০ এর দশকে, প্রথমে তেলের বাতি, তারপর গ্যাসের আলো এবং অবশেষে বৈদ্যুতিক আলো রাতকে আরও ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে। ফলে রাতও মানুষের কাছে জাগ্রত সময়ে পরিণত হতে শুরু করে। 

সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে ঘুমাতে যাওয়ার পরিবর্তে, মানুষ প্রদীপের আলোতে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেগে থাকতে শুরু করে। জৈবিকভাবে, রাতে উজ্জ্বল আলো আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘড়িগুলোকে (আমাদের সার্কাডিয়ান ছন্দ) পরিবর্তন করে এবং কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পরে আমাদের শরীরকে জাগ্রত করার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। 

ঘুমানোর আগে সাধারণ ‘ঘরের’ আলো মেলাটোনিনকে দমন করে এবং বিলম্বিত করে। শিল্প বিপ্লব কেবল মানুষের কাজ করার পদ্ধতিই নয় বরং তারা কীভাবে ঘুমায় তাও বদলে দিয়েছে। 

২০১৭ সালে বিদ্যুৎবিহীন মাদাগাস্কান কৃষি সম্প্রদায়ের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে লোকেরা এখনও বেশিরভাগ সময় দুই ভাগে ঘুমায়, প্রায় মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠে।

সূত্র: ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস অবলম্বনে

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ