অন্য নবীদের কথা মহানবী (সা.) কীভাবে বলতেন
Published: 22nd, April 2025 GMT
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন যে, নবীদের মধ্যে একটি ঈমানী বন্ধন ও একক বার্তার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি জানতেন, তাঁর লক্ষ্যও পূর্ববর্তী নবীদেরই ধারাবাহিকতা।
যখনই কোনো প্রসঙ্গে কোনো নবীর কথা স্মরণ করা হতো বা তাঁদের নাম উচ্চারিত হতো, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাভরে তাঁদের সম্পর্কে কথা বলতেন। তিনি তাঁদের ‘নবুওয়াতের ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন, যা থেকে বোঝা যায়, নবুওয়াতের বন্ধন তাঁর কাছে ছিল এক ভালোবাসার সূত্র। তিনি বিনয় ও কৃতজ্ঞতাভরে তাঁদের গুণাবলির কথা বলতেন এবং তাঁদের সম্মান করতেন।
ইবনে আব্বাস (রা.
রাসুল (সা.) তাঁর নবী ভাই সুলায়মান (আ.)-এর রাজত্বের প্রশংসাও গর্বভরে বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সুলায়মান (আ.) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন এমন এক রাজত্বের জন্য, যা তাঁর পরে কেউ পাবে না। আল্লাহ তা তাঁকে দান করেছিলেন।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ১০,৪৭৪)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি ঈসা (আ.)-কে ‘নিকটজন’ বলার মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুনিয়া ও আখিরাতে সকল মানুষের মধ্যে আমিই ঈসা ইবনে মরিয়মের সবচেয়ে নিকটজন। নবীগণ একে অপরের ভাই, তাঁদের মায়েরা ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের দীন এক।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৪৪৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৫)
তাঁর মা মরিয়ম (আ.)-এর বিশেষ মর্যাদার কথাও তুলে ধরেছেন, যা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যতিক্রমী সম্মান। আল্লাহর রাসুল (সা.) তা অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান স্পর্শ করে নি, তাই সে চিৎকার করে ওঠে। তবে মরিয়ম ও তাঁর সন্তান (ঈসা)-কে শয়তান স্পর্শ করতে পারেনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৬)
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তায়েফে ইসলাম প্রচারে যান। সেখানকার মানুষ তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং এমনকি শিশুরাও তাঁকে পাথর ছুঁড়ে আহত করে। অবশেষে তিনি ও তাঁর খাদেম একটি আঙুর-বাগানে আশ্রয় নেন। বাগানের একজন খ্রিষ্টান কর্মচারী তাদের কিছু আঙুর খেতে দেন। রাসুল (সা.) আঙুর খাওয়ার আগে কিছু অচেনা বাক্য উচ্চারণ করেন। তখন কর্মচারী বিস্ময়ভরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ নবীজি (সা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কোথাকার লোক?’ সে উত্তর দেয়, ‘আমি নিনেভেহ শহরের খ্রিষ্টান (ইরাকের উত্তরে)।’
রাসুল (সা.) তখন আনন্দভরে বলেন, ‘তুমি কি ইউনুস ইবনে মাত্তার শহর থেকে?’
লোকটি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ইউনুসকে কীভাবে চিনেন?’
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি ছিলেন নবী, আমিও নবী।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম সফিউর রহমান মুবারকপুরি)
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক মুসলিম ও এক ইহুদি তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কথার মধ্যে মুসলমান বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি মুহাম্মদকে সকল মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন!’ ইহুদি বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি মুসাকে সকল মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন!’
এ কথা শুনে মুসলমান ব্যক্তি রাগে ইহুদিকে চড় মারেন। তিনি ভাবলেন, নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে অপমান করা হয়েছে। এই ঘটনা রাসুল (সা.)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, ‘মুসার ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠ বলো না। কিয়ামতের দিন যখন সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়বে, তখন আমি সবার আগে জ্ঞান ফিরে পাব। কিন্তু তখন দেখব, মুসা (আ.) আরশের পাশ ধরে আছেন। আমি জানি না, তিনি কি আমার আগেই জ্ঞান ফিরে পাবেন, নাকি আল্লাহ তাঁকে দুনিয়ায় একবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণে বিশেষ রেহাই দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৭৩)
এই হাদিসের আরেক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই ঘটনায় রেগে গিয়েছিলেন এবং তাঁর চেহারায় রাগের প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। তিনি নবীদের মধ্যে এ ধরনের তুলনায় লিপ্ত হওয়াকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেন।
অন্য এক হাদিসে আছে, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মানুষদের মধ্যে কে সবচেয়ে সম্মানিত?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে খোদাভীরু।’ তারা বলল, ‘আমরা এ বিষয়ে জানতে চাই না।’ তিনি বললেন, ‘তবে, আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি ছিলেন আল্লাহর এমন নবীর পুত্র, যিনিও আল্লাহর নবীর পুত্র, তিনিও আল্লাহর খলিলের পুত্র।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৩৮৩)
মদিনায় হিজরতের পর নবীজি (সা.) খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের প্রতি সম্মানজনক মনোভাব বজায় রাখেন। একবার নাজরান শহর থেকে ৬০ সদস্যবিশিষ্ট একটি খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে। নবীজি (সা.) তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে স্বাগত জানান। মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল পরিবেশে তাদের বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করেন। আলোচনার শেষে, নাজরানের খ্রিষ্টানরা শান্তিপূর্ণভাবে মদিনা ত্যাগ করেন।
যদিও মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন এবং নবুওয়াতের শৃঙ্খলে পূর্ণতা এনেছেন, তবুও তিনি সর্বদা নিজেকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তুলে ধরতেন। তিনি একবার বলেছিলেন: ‘লোকসকল, আল্লাহকে ভয় করো এবং শয়তানের ধোঁকায় পড়ো না। আমি মুহাম্মদ, আবদুল্লাহর পুত্র। আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমি চাই না তোমরা আমাকে আল্লাহর নির্ধারিত অবস্থানের চেয়ে বেশি উচ্চে তুলে ধরো।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১২,৫৫৫)
বিভিন্ন হাদিসে রাসুল (সা.) দেখিয়েছেন যে, নবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু দুনিয়ার নয়—আখিরাতেও তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ। তাঁর কথায় কখনো ঈর্ষার লেশমাত্র প্রকাশ পায়নি, বরং ছিল অন্যদের প্রতি প্রশংসা ও স্বীকৃতি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের সম্মান করা, তাঁদের কৃতিত্ব তুলে ধরা এবং তাঁদের প্রতি বিনয় ও ভ্রাতৃত্বের মনোভাব পোষণ করা মুসলিম চরিত্রের অংশ। তিনি নবুওয়াতের শৃঙ্খলে এক ঐক্যের বার্তা তুলে ধরেছেন, যেখানে সব নবী ছিলেন এক উদ্দেশ্যে প্রেরিত—আল্লাহর একত্ববাদ ও মানুষের কল্যাণের জন্য।
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট কম
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স কর ম হ ম মদ আল ল হ একব র বলত ন বলল ন সবচ য
এছাড়াও পড়ুন:
বিগ-বির মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ
এক দশক আগে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাংলাদেশের জন্য বিগ-বি নামে পরিচিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট গ্রহণ করেছিল জাপান। বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প প্রবৃদ্ধির ওই উদ্যোগে রয়েছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প আর আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার বিকাশ। মে মাসের শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরে বিগ–বির মাধ্যমে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তাঁর জাপান সফরের আগে টোকিওতে ১৫ মে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টিতে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জাপানের আলোচনায় কোন কোন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
১৫ মে টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের এবং জাপানের জ্যেষ্ঠ উপমন্ত্রী আকাহোরি তাকেশি তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কোন কোন বিষয়গুলো ১৫ মের আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পাবে, তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়। পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরসহ সচিব পর্যায়ের সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিগ–বিতে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ খাতভিত্তিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, টোকিওতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে। প্রথম ভাগে থাকবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয়। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।
আঞ্চলিক বিষয়াদিতে জাপানের বিগ–বি নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বলা হবে। পরে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তবে তার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হবে।
বিগ–বির সঙ্গে ২০২৩ সালে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে জাপান। কিন্তু ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক। এমন এক প্রেক্ষাপটে বিগ–বিকে বিশেষ করে সংযুক্তিকে বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে নেওয়ার পরিকল্পনায় আপাতত একটা ধাক্কা এসেছে। এ নিয়ে জাপান নানাভাবে নিজেদের অস্বস্তির বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়েছে। বিগ–বি জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অগ্রাধিকার প্রস্তাব হওয়ায় এটিতে বিশেষ গুরুত্ব আছে টোকিওর। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আগ্রহী জাপান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফরে জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিবিড় করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিক্রির ওপর কয়েক বছর ধরে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে জাপান।
বাংলাদেশকে ২০২৩ সালে জাপানের সরকারি নিরাপত্তা সহায়তায় (ওএসএ) যুক্ত করা হয়েছে। মূলত জাপান নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে এই কাঠামো তৈরি করেছে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং ওই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দিয়ে থাকে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ঋণের পরিবর্তে অনুদান দিয়ে থাকে।