দলের নাম নিয়ে আমজনতা ও আ-আমজনতার ভাবনা
Published: 23rd, April 2025 GMT
নামে কী যায় আসে—সব জায়গায় এই কথা চলে না। রাজনীতিতে তো চলেই না। রাজনীতিতে নামে যায় আসে। কারণ ‘নামের আমি নামের তুমি নাম দিয়ে যায় চেনা’। রাজনীতিতে নামের যে কত দাম, তা আমের মৌসুম শুরুর আগেই ‘আম’ নিয়ে ‘আমজনতার দল’ আর ‘আ-আমজনতা পার্টি’র ঝগড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে।
নুরুল হকের ‘গণ অধিকার পরিষদ’ থেকে বেরিয়ে মিয়া মশিউজ্জামান আর মো.
এতে ‘অরিজিনাল’ আমজনতা পার্টি ডার্টি পলিটিকসের গন্ধ পেয়ে নির্বাচন কমিশনের সালিসে নালিশ করেছে। তারা বলছে, ‘আম’ আর ‘আ-আম’ লিখলে আলাদা দেখায়, কিন্তু বললে শোনায় একই রকম। সুতরাং রফিকুল আমীনের দলকে যেন এই নামে নিবন্ধন দেওয়া না হয়। তাদের দাবি, যেহেতু তারা ‘আমজনতার দল’ নামটি আগেই ছালাবন্দী করেছে, সেহেতু আম এবং ছালা দুটোই তাদের।
৫ আগস্টের ঝড়ে যেহেতু বহু বক পড়েছে, সেহেতু কিছু ফকিরের কেরামতি বাড়ারই কথা। অভ্যুত্থানের ঝড়ের তোড়ে আদি ও আসল ‘আম’ ওরফে ‘আওয়াম’ ওরফে ‘আওয়ামী’ বৃক্ষ উড়ে গেছে। সেই বৃক্ষের ছায়াপুষ্ট গাছপালারও ডালপালা ভেঙেছে। কিন্তু মাটির সাথে ঘাপটি মারা ঘাসপাতার কিছু হয়নি।
৫ আগস্টের ঝড়ে শুধু বাতাস ছিল না; বৃষ্টিও ছিল। সেই বৃষ্টিতে দেড় যুগের খরাপীড়িত রাজনীতির খটখটে মাঠে জো এসেছে। ভেজা মাঠে এখন রাজনৈতিক দলরূপী নতুন নতুন ঘাসপাতা ও গাছগাছড়া গজাতে শুরু করেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন শর্ত সহজ করার সুপারিশ করেছে। ইসি হয়তো ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতির পথে হাঁটতে চায়। আর তাই দেখে নতুন নতুন ফুল গাছের চারা মাথা উঁচু করছে। তবে চারাগুলোর নামের মধ্যেই যে ভাব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এসব ফুলের মধ্যে ধুতরা-আকন্দের বাড়বাড়ন্ত বেশি। চামেলি, গোলাপের আলাপ প্রলাপের মতো মনে হচ্ছে।
এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৫০টি। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫টি দল নিবন্ধন পাওয়ার আরজি জানিয়েছে। এর বাইরে আরও ৪৬টি দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। মানে, দেড় শতাধিক দল আমজনতার সেবায় দাঁড়িয়েছে। আর এই দলগুলোর ৯৯ শতাংশের মোটের ওপর যা আছে, তা হলো একটি নাম। নামসর্বস্ব এই দলগুলোর নেতা কারা, কেন তঁারা রাজনীতিতে আসতে চান, সে এক বিরাট প্রশ্ন।
যাত্রা পার্টিতে একজন অধিকারী থাকেন। তিনিই কলাকৌশল করে দল চালান। যাত্রা পার্টির কুশীলবদের অভিনয় করতে হয়। পলিটিক্যাল পার্টিতেও একজন বড় নেতা থাকেন। তাঁর নিচে মেজ-সেজ-নেতা থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিনয় করে পাবলিকের মন জয় করতে হয়। অ্যাকটিংয়ের পাশাপাশি পিকেটিং করতে হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে পার্টিতে নাম ছাড়া আর কিছুই নেই, সে পার্টির সঙ্গে কি যাত্রা পার্টির তুলনা চলে?নিবন্ধিত হতে চাওয়া একটি দলের নাম দেখা যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ সংসারবন্দি পার্টি’। রাজনীতির সংসারে এই ধরনের ‘সঙ’-সারসম্পন্ন পলিটিক্যাল পার্টির নাম শুনতে হবে, তা কে কবে ভেবেছে? একইভাবে নিবন্ধন চেয়েছে ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’, ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’, ‘জনতার কথা বলে’।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি যখন কোনো কোনো মহল থেকে তোলা হচ্ছে, সেই সময়ে ‘আওয়ামী লিগ’ নামে নিবন্ধন চেয়ে উজ্জ্বল রায় নামের এক লোক আবেদন করে বসেছেন। তবে সে নামটি শেষ পর্যন্ত তালিকায় রাখা হয়নি। এর বাইরে বাংলাদেশ
সংরক্ষণশীল দল (বিসিপি), জনতা কংগ্রেস দল, বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণময় পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল, বাংলাদেশ জনশক্তি পার্টি—এ ধরনের বহু বাহারি নামের দল আছে।
নিবন্ধন চাওয়া কোনো কোনো দলের নেতা সম্ভবত পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে যাত্রা পার্টির মিল পেয়েছেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন, একটা পলিটিক্যাল পার্টি মানে একটা দল; একটা যাত্রা পার্টি মানেও একটা দল। দুই কিসিমের দলেই নানান কিসিমের জনবল থাকে।
যাত্রা পার্টিতে একজন অধিকারী থাকেন। তিনিই কলাকৌশল করে দল চালান। যাত্রা পার্টির কুশীলবদের অভিনয় করতে হয়। পলিটিক্যাল পার্টিতেও একজন বড় নেতা থাকেন। তঁার নিচে মেজ-সেজ-নেতা থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিনয় করে পাবলিকের মন জয় করতে হয়। অ্যাকটিংয়ের পাশাপাশি পিকেটিং করতে হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে পার্টিতে নাম ছাড়া আর কিছুই নেই, সে পার্টির সঙ্গে কি যাত্রা পার্টির তুলনা চলে?
ডেসটিনির রফিকুল সাহেব বিবিসি বাংলাকে সরল সোজা মনে বলেছেন, তিনি জেলখানায় ছিলেন। ৫ আগস্টের পর দেখলেন, জেলখানা থেকে অনেক রাজনীতিককে বিনা জামিনে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি জেলারকে বললেন, ‘আমি তো বহুদিন জেলে, আমাকে ছাড়েন না কেন?’ জেলার তখন তাঁকে বললেন, ‘আপনি তো রাজনীতিক না, আপনি যদি রাজনীতিক হতেন, তাহলে ছেড়ে দিতাম। আপনি যদি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের লোক হতেন, তাহলেও ছেড়ে দিতাম।’
জেলারের এই বাণীই কি রফিকুল আমীন সাহেবকে রাজনৈতিক দল খুলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? রফিকুলের মতো অনেকেই জানেন, একটি রাজনৈতিক দল মানে একটি ঢাল। সে নামসর্বস্ব হোক আর কামসর্বস্ব হোক।
নিবন্ধন দেওয়ার সময় ইসিকে এই সত্য বুঝতে হবে।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পল ট ক য ল প র ট আমজনত র র জন ত ত ত র দল ন বন ধ দল র ন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫