শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেছেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বিচার না হওয়ার পেছনে প্রধান ব্যর্থতা হলো এটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করা যায়নি। যদি করা যেত, তাহলে ১৬ মাসেই ভুক্তভোগীরা বিচার পেতেন।

বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘রানা প্লাজা ভবন ধস: বিচারের অপেক্ষার এক যুগ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান এ কথাগুলো বলেন। মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হন। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ১ হাজার ১৬৯ জন। এ ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়েও মামলা করে।

সভায় শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘১২ বছর আগে যে ভুক্তভোগীকে হুইলচেয়ার দেওয়া হয়েছে, সেই হুইলচেয়ার কি এখনো চলে? সেটা কি পরিবর্তন করা হয়েছে? এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি এটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করতে চাই।’

রানা প্লাজার ঘটনায় সত্য উদ্‌ঘাটন, জবাবদিহি, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেন ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কী কী চেয়েছি? যাঁরা এই ঘটনায় দায়ী, ফৌজদারি আইনে তাঁদের সাজা চেয়েছি। আরেকটি চাওয়া হলো সত্য উদ্‌ঘাটন করা, রানা প্লাজা ধস কেন ঘটল।’

সারা হোসেন বলেন, ‘শুধু একজন এখানে দায়ী নন, অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। এই ভবনের অনুমতি কারা দিয়েছিল; সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোন কর্তৃপক্ষ এতে জড়িত ছিল, সেই বিষয়গুলোর সুরাহা কিন্তু আমরা পাইনি।’

সারা হোসেন মনে করেন, বিচার প্রলম্বিত হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা বড় কারণ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থ বিভাগ, বিচার বিভাগ, অন্যান্য মন্ত্রণালয়—একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন না।’

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘বিচারকে প্রলম্বিত করার দুটো পথ আছে। একটি হলো আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে দাও, আরেকটি হলো সাক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়ে দাও। রানা প্লাজার ঘটনায় আমরা সেটাই দেখেছি। এত বেশি সাক্ষী আর আসামি যে মামলা শেষই করা যাচ্ছে না। কৌশলে বিচারকে প্রলম্বিত করার যে প্রক্রিয়া, তা আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।’

রানা প্লাজায় আহত ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা তো একরকম বেঁচে গেছেন। ধুঁকে ধুঁকে মরছেন, যাঁরা পঙ্গু হয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পর দেশি–বিদেশি বহু সাহায্য এসেছে, তার কতটুকু ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা পেয়েছেন?’

এ সময় বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন আবুল হোসেন। সুপরাশিগুলো হলো, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদন উন্মুক্ত করা, নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা বের করা, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে এখন পর্যন্ত কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা উন্মুক্ত করা, রানা প্লাজার জমিতে আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, সাভারে সরকারিভাবে স্মৃতিফলক স্থাপন, মামলা পরিচালনার জন্য সম্মিলিত মনিটরিং কমিটি গঠন করা।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনার ভুক্তভোগী নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর থেকে যে শারীরিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কাউকে বলতেও পারি না। আমি ১০ মিনিটও একসঙ্গে দাঁড়াতে পারি না, বসতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের খোঁজ নেয় না। ন্যায়বিচারটাও আমরা পাইনি। আমরা সুবিচার চাই। আমাদের ক্ষতিপূরণ চাই।’

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো.

কামাল হোসেন খান, শ্রম আদালতের আইনজীবী শারমিন সুলতানা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ। মতবিনিময় সভাটি সঞ্চালন করেন ব্লাস্টের পরিচালক মো. বরকত আলী।

মতবিনিময় সভার শুরুতে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ঘটন য় ন বল ন আম দ র ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের

এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।

চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।

টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর। 

গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।

দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত। 

শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।

মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।  

সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ