রাজধানীর বেসরকারি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (পারভেজ) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বিরুনী ইউনিয়নের কাইচান গ্রামে নিহত জাহিদুলের কবর জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ছাত্রদলের সভাপতি বলেন, ‘জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দায়সারা গোছের কথা বলেছে। আমি আশা করছি, একটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিথ্যাচার করায় ধীরে ধীরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাঁদের ওপর যে সামান্যতম আস্থা রয়েছে, সেই আস্থার সংকট দেখা দেবে। যেকোনো ঘটনায় আমি তাঁদের সঠিক তথ্য প্রদানের আহ্বান জানাই এবং এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাঁদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাই। তাঁদের নেতা-কর্মী যে–ই হয়ে থাকুক না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমি বিশ্বাস করি তাঁরা সেই ভূমিকা পালন করবেন।’

রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘জাহিদুলকে হত্যার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব সরাসরি বনানী থানায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন। যাঁরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব, তাঁদের যেন মামলার আসামি করা না হয়, সে জন্য সব দিক দিয়ে প্রেশার ক্রিয়েট করেছেন। এগুলো আপনারা দেখেছেন। পরে রাতে তাঁরা যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন, এটিকে আমি নেতৃত্বের ইম্যাচুরিটি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবে দেখব। তাঁরা সরাসরি অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, আমরা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের জড়িত করেছি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিসিটিভি ক্যামেরার ‍ফুটেজ পাবলিশ হলো। তখন দেখা গেল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সরাসরি জড়িত এবং বেশ কয়েকজন আশপাশে ছিল। এরপর তাঁরা আর কোনো স্টেপ (পদক্ষেপ) নেননি। আমি আশা করব, তাঁদের মাত্র সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁদের আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা খুবই কম। আমি বিশ্বাস করি, তাঁরা ধীরে ধীরে এগুলোর পরিপূর্ণতা লাভ করবেন।’

আজ নেতা-কর্মীদের নিয়ে জাহিদুলের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিহত ব্যক্তির কবর জিয়ারত করেন রাকিবুল ইসলাম। এ সময় জাহিদুলের বাবা কুয়েতপ্রবাসী জসিম উদ্দিন ও মা পারভীন আক্তার ছেলের হত্যায় জড়িতদের বিচারে পাশে থাকার জন্য ছাত্রদল সভাপতির সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্যাম্পাসে মব কালচার তৈরি করেছিল। সেই বাস্তবতায় এখনো বাংলাদেশের বেশ কিছু ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অনুসারীরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা আবার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন হবেন। দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর তাঁদের এ ধরনের স্বপ্ন দেখা কতটা বিভ্রম হলে সম্ভব। এ জন্য জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সেসব নেতৃত্ব অগ্রভাগে ছিলেন, তাঁদের অনেক বেশি দায় আছে। তাঁরা যেন যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া না দেখান, যার কারণে মব কালচার তৈরি হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড জাতি তাদের কাছে প্রত্যাশা করে না।

রাজধানীর বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (২২) নিজ ক্যাম্পাসের সামনে গত শনিবার ইঙ্গিতপূর্ণ হাসাহাসির জেরে ছুরিকাঘাতে খুন হন। জাহিদুল ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিবার ও স্বজনেরাও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ক ব ল ইসল ম ছ ত রদল কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ