Samakal:
2025-04-30@21:43:24 GMT

ভাতের যুদ্ধের পর

Published: 24th, April 2025 GMT

ভাতের যুদ্ধের পর

চৌদ্দ বছর পর, বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্ষমা পেয়ে, জেল থেকে বেরিয়ে, ওবায়দুরের প্রথমেই পার্টি আপিসে যেতে ইচ্ছে করে। সে তাই-ই করে। এ ছাড়া তার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পার্টি আপিসের রাস্তাটা সে ভোলেনি; জেলখানা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে যেতে যেতে ওবায়দুরের এই শহরটা চিনতে কষ্ট হয়; নতুন নতুন দালানকোঠায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। তবুও রাস্তা চেনে বলে হাঁটতে হাঁটতে যেই ভবনে তাদের আপিস ছিল, সেই তিনতলা ভবনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের পার্টির সাইনবোর্ডের জায়গায় নতুন সাইনবোর্ড দেখে সে তেমন অবাক হয় না। লেখা আছে– আলিফ গ্রাম-উন্নয়ন সমিতি। তাদের আপিসটা এখানে আর নেই। এই আশঙ্কায় তার মন একবার ভুগেছিল তবে সে নিশ্চিত ছিল না; এত বছর জেলের ঘানি টেনে বাইরের জগতের কোনোকিছু নিয়েই সে আর নিশ্চিত নয়।
মোস্তফা ভাইয়ের সাথে তার দেখা হওয়া দরকার। তার কাছে করার মতো অনেক প্রশ্ন মনে জমে আছে। প্রশ্নগুলো করতেই হবে; না করলে শান্তি পাবে না সে।
এই গোলাম মোস্তফার ডাকেই তারা যুদ্ধে নেমেছিল। ওবায়দুর কুষ্টিগঞ্জ মহকুমায় তার সৎ বাপের আড়তে কামলার কাজ করত। লোকটা একেবারেই বাপের মতন আচরণ করত না। অনেকবার তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে লাথি মেরেছে, লোক দিয়েও পিটিয়েছে। একবার তার মায়ের সামনেও লাথি দিয়েছিল– মা তার স্বামীর এই কাজের প্রতিবাদ করতে পারেনি; মায়ের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না।
মোস্তফা ভাইয়ের এক ডাকেই তার মতো আরও হাজার ছেলে ভাতের যুদ্ধে দৌড়ে গিয়েছিল। তারপর, কী করেনি তারা এই ভাতের বিপ্লবের জন্য। আলতাফ মাস্টারকে শূলে চড়ানোর কথা তার আজও মনে আছে। আলতাফ একাত্তরের আগে কালীগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিল। একাত্তরে অনেক জমি দখল করে জোতদার বনে যায়। স্বাধীনের পর সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে এসে আলতাফ সওদাগর নাম নিয়ে মিউনিসিপালিটির ইলেকশন করে হেরে যায়, কিন্তু তার প্রতিপত্তি বাড়তেই থাকে। ওবায়দুরের সৎ বাপ তখন সওদাগরকে চাল-গম সাপ্লাই দিত।
আলতাফ সওদাগরকে যেই শূলে চড়ানো হয়েছিল, সেটা বানিয়েছিল জব্বার। জব্বার কামার বংশের ছেলে; বাবার নাম কামিনীমোহন; কামিনী একাত্তরে খুন হয়ে গেলে জীবনমোহন ধর্মান্তরিত হয়ে জব্বার হয়ে যায়, কিন্তু তার পেশা বদলায় না। কামারগিরি ছাড়া সে আর কিছু জানত না। সওদাগরকে যেদিন শূলে দেওয়া হয়, সেদিন মোস্তফা ভাই নিজেই উপস্থিত ছিলেন। 
মোস্তফা ভাইয়ের সাথে ওবায়দুরের দেখা হওয়া দরকার। অনেক প্রশ্নের উত্তর চায় সে তার কাছ থেকে।
তবে ওবায়দুরের কপাল ভালো যে বিচারকরা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেননি। বিপ্লবী পার্টির সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই পুলিশ তখন খুনের অভিযোগ এনে চার্জশিট করত। ওবায়দুরের বিরুদ্ধে সাত খুনের অভিযোগ ছিল, কিন্তু আদালতে খুনের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় তার শুধু যাবজ্জীবন হয়েছিল। তবে জব্বারের ফাঁসি হয়ে যায়। জব্বারের মৃত্যুতে ওবায়দুর কষ্ট পেয়েছিল। তার কাছে সৎ বাপের অত্যাচারের গল্প শুনে জব্বার এক রাতে ওবায়দুরের বাপকে খতম করতে গিয়েছিল। ওবায়দুরের মায়ের অনুরোধে সে তা করেনি; সেই সময় থেকে সে জব্বারকে ভালোবেসে ফেলেছিল।
মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে, জেলখানায় বেঁচে থেকেও যে ওবায়দুরের জীবনে বড় কোনো শান্তি এসেছিল তাও নয়। তার বউ মর্জিনা তাদের মেয়েকে নিয়ে জেলে দুইবার দেখা করতে এসেছিল; কিছুক্ষণ কান্নাকাটিও করেছিল; এক বছর পেরোনোর পর আর আসেনি। তারপর শুনেছিল মর্জিনা তাকে তালাক না দিয়েই, এক মুদি-দোকানিকে বিয়ে করে ঝিনাইগঞ্জে চলে গেছে। ওবায়দুর কষ্ট পায়নি; সে নিজে তাকে ভাত দিতে পারেনি; দোকানি যদি পারে তবে তাই হোক। মোস্তফা ভাই অবশ্য কয়েকবার এসেছিলেন; তিনিই মর্জিনার বিয়ের খবর ওবায়দুরকে দিয়েছিলেন। ভাই বলেছিলেন, তোর বউ ভালো আছে– ঝিনাইগঞ্জে এক এনজিওতে কাজও পেয়েছে; ঐ স্বামী তাকে ভালোবাসে; মেয়েও এনজিওর স্কুলে যাচ্ছে।
এরপর আর কারও খোঁজ সে জানে না। জেলজীবন পার করার সাত বছর পর সে জানতে পারে, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেছে; ক্রেমলিনের পতন হয়েছে; বার্লিনের দেয়াল ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়েছে; বিপ্লবের ফসল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই তার মোস্তফা ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল, কুষ্টিগঞ্জের হক ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল, জব্বারের কথা মনে পড়েছিল।
মোস্তফা ভাইকে খুঁজে বের করতে হবে। মনে অনেক কথা জমে আছে।
চৌদ্দ বছর জেলে খাটাখাটনি করে সে আয় করেছে ছয় হাজার টাকা। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সে টাকার অস্তিত্ব অনুভব করে। এই টাকায় কতদিন সে ভাত-রুটি খেতে পারবে, সে কথাও একবার মনে আসে। পার্টি আপিস নেই– হয়তো পার্টিও নেই; কিন্তু তার মোস্তফা ভাইয়ের সাথে দেখা করা জরুরি। মনে অনেক কথা জমে আছে।
আশেপাশের দোকানে তাদের পার্টি আপিসের কথা জানতে চাইলে কেউ তেমন সু-তথ্য দিতে পারে না। আপিসের উলটো দিকে একটা চায়ের দোকান ছিল, সেটা এখনও আছে। তবে আগের চা-ওয়ালা নেই। তার কাছে কিছু জানা গেল না, তবে ছেলেটা বলল– এখানে যারা আসা-যাওয়া করত, তারা সবাই নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছে।
সে এখনই ফুলবাড়ি গিয়ে বাসে চড়ে কুষ্টিগঞ্জে রওনা দিতে পারে, কিন্তু ওবায়দুর একবার দ্বীন মোহাম্মদ রোডে যেতে চায়। একটা সস্তা থাকার হোটেল খুঁজে সেখানে উঠে কিছুক্ষণ জিরোয়। দুপুরে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তার; একটা ঘুম দিয়ে বিকেল চারটায় উঠে বাইরে গিয়ে দুটো শিঙাড়া আর এক কাপ চা খেয়ে দ্বীন মোহাম্মদ রোডে যায় সে। এখানে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে তাদের পার্টির পরোক্ষ সদস্য ছিল; তার সাথে তাদের সব নেতার ভালো ওঠাবসা ছিল। ওবায়দুর পার্টির নামকরা কর্মী হওয়ায়, তার সাথেও দু’একবার মিটিং হয়েছিল। তার কাছে গেলে মোস্তফা ভাইয়ের খবর পাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে কোনো লাভ হয় না। বাড়িটা আগের মতোই আছে, তবে নিরাপত্তারক্ষী জানায়, আগের মালিক বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। একটু মন খারাপ হয় ওবায়দুরের। তবে এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবে না সে। অনেক বছর ধরে সে অনেক কিছুই ভাবে না। শুধু মোস্তফা ভাইকে কতগুলো প্রশ্ন করতে তার মন চায়।
ফুলবাড়ি গিয়ে কুষ্টিগঞ্জের বিআরটিসির টিকিট কেটে, সস্তা এক হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে সে হোটেলে ফিরে আসে। মেয়েটার মুখ মনে পড়ে ওবায়দুরের; সে নিজে সৎ বাপের ঘরে বড় হয়েছে, মেয়েটার ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটল। এই ভাতের বিপ্লবে যোগ না দিলে হয়তো মেয়েটা তারই থাকত; মর্জিনাও তারই থাকত।
কুষ্টিগঞ্জে কেন এলো তা ওবায়দুর ভেবে পায় না। এখানে তো তার আর কিছু নেই, কেউ নেই। মা মারা গেছে, মর্জিনা চলে গেছে। ভিটা দখল হয়ে গেছে। এরপর আর কী থাকে? বন্ধুরা তার মতো দাগি আসামিকে মনে রাখবে না, তা সে জানে; ওদের সাথে কথা বলার ইচ্ছেও তার নেই। হ্যাঁ, হক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে সে। তাছাড়া কুষ্টিগঞ্জ তার জন্মস্থানও। তার বন্ধু মন্টুদের বাড়ির পাশে হক ভাইয়ের বাড়ি। ওবায়দুর সেখানে যায়। হক ভাইয়ের ছেলে মঞ্জু জানায়, মিলিটারি ক্ষমতায় আসার পর, তার বাবা গুলি খেয়ে মরেছে। মঞ্জু মোস্তফা ভাইকে চিনত। তার কাছে জানতে পারে যে তিনি এখন একটা এনজিও করেছেন। কিন্তু কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে তা সে বলতে পারে না। তবে আলিফ সমিতি নিয়ে সে কিছু তথ্য দিতে পারে। এই সমিতির শাখা কুষ্টিগঞ্জে নেই তবে শৈলপাড়া আর ঝিনাইগঞ্জে আছে।
কুষ্টিগঞ্জে ওবায়দুরের রাত যাপন করার কোনো জায়গা নেই। একবার ভাবে তার সৎ বাপের আড়তটা দেখে আসে। সে বেঁচে আছে কিনা সে জানে না। কিন্তু চিন্তাটা বাদ দেয়। রাতটা কুটিপাড়া রেলস্টেশনে গিয়ে কাটিয়ে দেয়। সকালে রেলগেটের এক টং দোকানে নাশতা করে এক লোকাল বাস ধরে ওবায়দুর। বেশিক্ষণ লাগে না; শৈলপাড়া এখান থেকে ষোলো মাইল।
পৌঁছেই পথে পথে প্রশ্ন করে সে আলিফ সমিতির ঠিকানা পেয়ে যায়। সেখানে মোস্তফা ভাইকে খুঁজে পায় না। কর্মীরা জানায়, এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতার নাম মুস্তাফিজুর রহমান– এখানে মোস্তফা নামের কেউ নেই। মুস্তাফিজুর রহমান থাকেন ঝিনাইগঞ্জে, আর হেড আপিস ঢাকায়।
ওবায়দুর আরও কুড়ি মাইল বাসে চড়ে ঝিনাইগঞ্জে আসে। সমিতি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না। একবার মনে হয়েছিল এই টাউনে আসা তার ঠিক হচ্ছে না। জেলে বসে শুনেছিল এই টাউনে মর্জিনার বিয়ে হয়েছে; তার মেয়েও নিশ্চয়ই এখানে থাকে। যে একটু ভয় পেয়েছিল। যদি মর্জিনার সাথে দেখা হয়ে যায়? এসে যদি দেখে মর্জিনা এখানেই কাজ করে? সমিতির আপিসে ঢুকে সে ভয় কেটে যায় ওবায়দুরের। এই আপিসে প্রায় সবাইই মহিলা– শুধু দু’একজন পুরুষ।
মোস্তফা ভাইকে এখানে খুঁজে পায় না। সে দুইয়ে-দুইয়ে মেলানোর চেষ্টা করেছিল। পার্টি আপিসে সমিতির আপিস দেখে তার মনে হয়েছিল, মোস্তফা ভাই বোধহয় পার্টি করা ছেড়ে দিয়ে এখন এই নামে এনজিও করে। এখানে কেউ গোলাম মোস্তফাকে চেনে না। সে একটু অবাক হয়। কুষ্টিগঞ্জ-শৈলপাড়া-ঝিনাইগঞ্জ এলাকার এমন প্রতাপশালী নেতাকে সবাই ভুলে গেল? তার বিশ্বাস হয় না। এরা কী সবাই তাকে মিথ্যে বলছে? লুকোনোর চেষ্টা করছে?
ওবায়দুরের খিদে পায়। সে যখন সমিতির আপিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ধবধবে সাদা চুল-দাড়ি মণ্ডিত এক ব্যক্তিকে দেখা যায় ভেতরে ঢুকছেন। সে দাঁড়িয়ে যায়। ব্যক্তিটা তাকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকে যান। ইনিই কি সেই মুস্তাফিজুর রহমান? সে মোস্তফা ভাইয়ের সাথে এই ব্যক্তির চেহারা মেলাতে চেষ্টা করে। নাহ, কোনো মিল নেই।
সে আপিসটা থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। সে এখন কোথায় যাবে? পকেটের কয়েক হাজার টাকা শেষ হয়ে গেলে, তার ভাত জোটানোর কোনো না কোনো চেষ্টা তাকে করতে হবে। মোস্তফা ভাইকেই-বা কোথায় খুঁজবে? এই এলাকা তার চেনা। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেখানে এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে ভাত, মুরগির মাংস আর ডালের অর্ডার দেয়। খাবার আসে, সে খেতে শুরু করে। খেতে খেতে তার মনে কয়েকটা প্রশ্ন আসে, নিজেকেই প্রশ্ন করে।
মোস্তফা ভাইয়ের সাথে দেখা হলে, সে কী প্রশ্ন করবে? করবেই-বা কেন? এতদিন পর কী আসে যায়? এখন ভাতটাই আসল। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঝ ন ইগঞ জ সৎ ব প র ত র মন হয় ছ ল র আপ স র আর ক আলত ফ এনজ ও একব র

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তান কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পথে?

গত সপ্তাহে কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি মনোরম তৃণভূমিতে ২৬ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ঘাতকরা তাদের বেছে বেছে হত্যা করে। আমরা ঘটনার হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য পড়েছি। কীভাবে কাছ থেকে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে– পরিবারের সদস্যদের সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছে। এতে প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। এসব হত্যাকাণ্ড ছিল অযৌক্তিক। এ ছাড়া আমরা পড়েছি, কীভাবে কাশ্মীরি ট্যুরিস্ট গাইড ও শিশুদের বিনোদন রাইডের পনি অপারেটররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ভারতীয় পর্যটককে উদ্ধার করেছিলেন।

এই হামলা কারা ঘটিয়েছে, তা মৃতদের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়– সেটা পাকিস্তানি কিংবা স্থানীয় কাশ্মীরি হোক, অথবা উভয় সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের জীবন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভারত সরকারের চতুরতার সঙ্গে গড়ে তোলা স্বাভাবিকতার মুখোশও ধ্বংস হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটনের উত্থানের ফলে এই মুখোশ টিকেছিল। 

আমরা আগেও অনেকবার এখানে এসেছি। প্রায় চার দশক ধরে কাশ্মীর রক্তপাতের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে শান্ত থাকে। স্বাভাবিকতার জয়ধ্বনিপূর্ণ ঘোষণা এবং শান্তির সঙ্গে নীরবতার ইচ্ছাকৃত মিশ্রণের মধ্যে কেটেছে, যাতে এখানে আবারও ভ্রমণে যাওয়া যায়। ২০১৯ সালেও এখানে বিরাজমান স্বাভাবিক অবস্থা এবং সংঘাতের অবসানের কথা বলা হয়েছিল। 

কিন্তু সেই ভাবমূর্তি ভেঙে যায় ফেব্রুয়ারিতে, যখন জইশ-ই-মোহাম্মদ নামে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি আধাসামরিক বাহিনীর গাড়িতে আক্রমণ করে। এতে ৪০ ভারতীয় সৈন্য হত্যা করা হয় এবং দুই দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। ১৯৪৮ সাল থেকে তারা যে তিনটি যুদ্ধ করেছে, তাতে বহু দিক থেকে দেশ দুটি সর্বদা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ছিল। নির্দিষ্ট সময় পরপর তারা যুদ্ধের চারপাশে ঘুরতে থাকে; তারপর ফিরে আসে এবং অস্ত্র ও বাগ্‌বিতণ্ডা চলে। 

এই বিপর্যয়কর বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে একটি প্রজন্ম এখন শেষের দিকে, যার বেশির ভাগ ক্ষতি কাশ্মীরিদের গুনতে হয়েছে। তাদের ৭০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, প্রায় ১০ হাজার হয়েছে নিখোঁজ এবং ২ লাখের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত (হিন্দু) বাস্তুচ্যুত। এর কারণ ১৯৮৯ সালে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বোমা বিস্ফোরণ বা পেহেলগামের মতো হামলায় ভারতীয় নাগরিকের নিহত হওয়ার ঘটনা। এটা বলা অযৌক্তিক– এ ধরনের সহিংসতা শূন্য থেকে উদ্ভূত। কারণ ব্যাপক সহিংসতার উৎস আমাদের ইতিহাস ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। যেমন ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগের এখনও জ্বলন্ত ক্ষত এবং কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের অমীমাংসিত প্রকৃতি।

২০১৮ সাল থেকে ভারত দিল্লির নিযুক্ত করা গভর্নরের মাধ্যমে সরাসরি এ অঞ্চল শাসন করে আসছে। পরের বছর মোদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। যদিও এখন একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তবু পদকে কার্যকরভাবে নামমাত্র করে তোলা হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত এতটাই বিকৃত হয়ে ওঠে, এই মাসের শুরুতে একটি উচ্চস্তরের নিরাপত্তা সভায় বর্তমান ক্ষমতাসীন এক কাশ্মীরিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে ভারত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান সীমান্তে প্রায় পাঁচ লাখ সৈন্য নিয়ে একটি বিশাল সামরিক বাহিনী বলবৎ রেখেছে। স্থানীয় বা পাকিস্তানি পৃষ্ঠপোষকতায় সশস্ত্র গোষ্ঠীদের জন্য এসব উর্বর ভূমি অবাক করার মতো কিছু নয়।

মির্জা ওয়াহিদ: ইংল্যান্ডভিত্তিক কাশ্মীরের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

সম্পর্কিত নিবন্ধ