রাজনীতিতে আসা নিয়ে সেদিন যা বলেছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন
Published: 25th, April 2025 GMT
প্রথম আলো :
সরকারের কোনো আর্থিক তহবিল পেয়েছিলেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: না। ২০১২ সালে বাজেটে অর্থমন্ত্রী ২০ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করেছিলেন ইনস্টিটিউট করে তা পরিচালনার জন্য। বিশ্বাস করুন, আজ পর্যন্ত সেই তহবিলের সিকিটিও পাইনি। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাইনি, কাজও হয়নি।
প্রথম আলো :
মনে পড়ছে, মিশুক মুনির ও তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর আপনার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে পরিবহনশ্রমিকেরা খেপেছিলেন। প্রকাশ্যে অনেক খারাপ মন্তব্য করেছিলেন। নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতি আরও হয়েছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: তা হয়েছে, কিন্তু কাজটাকে আমি ভালোবেসেই করতে চেয়েছি। তাই বিষয়কে অন্যভাবে আমলে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে তাঁদের মানসিকতার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই। আসলে এ ক্ষেত্রে নিজের ব্যবহার, আচরণ বড় একটা বিষয়। আমি নিজেও যাত্রীদের বিষয়টি বুঝিয়েছি। বাসে উঠে একজন শ্রমিক বা চালকের সঙ্গে ভালো আচরণ করলে, তাঁকে বয়সানুযায়ী ‘ভাই’, ‘চাচা’ কিংবা এ ধরনের কোনো সম্বোধনে ডাকলে দেখবেন ঠিকই তিনি আপনার কথা শুনবেন। তাঁরা ভালো আচরণ করবেন। আমি এ জায়গায় সফল। একসময় পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা আমাকে দেখতে পারতেন না। তাঁরা মনে করতেন, আমি ভুল করছি। তাঁদের ধারণা ছিল, দুর্ঘটনা কপালের লেখা। এখন এ ধারণা থেকে তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন। আমার ওপর ধারণা বদলে গেছে। মনে পড়ছে, কয়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে খুলনায় একজন ড্রাইভার আমাকে ধরে কেঁদেই ফেলেন। বললেন, ‘আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। কারণ, আপনার সম্পর্কে এত খারাপ শুনেছি যে মনে হতো রাস্তায় পেলে আপনার ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেব। এখন মনে হচ্ছে, আপনাকে মহব্বত করা উচিত।’ তাঁর কথা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, চোখ ভিজে যায়।
প্রথম আলো :
শুধুই চালক আর শ্রমিকদের নিয়েই কাজ করেছেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: পথচারীদের নিয়েও কাজ করেছি। তাঁদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। তরুণ পথচারীদের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে আমি বলেছি, শুধু চালকদের দোষ, গাড়ির দোষ, রাস্তার দোষ খুঁজে বেড়াবেন? তাহলে আপনাদের কোনো দায়িত্ব নেই? আপনার নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পথচারী হিসেবে আপনার দায়িত্ব নেই? পথচারী হিসেবে নিজে যে ভুলগুলো করেন, তা কখনো দেখতে চান না। শুধু অন্যের দোষ দেখেন।
প্রথম আলো :
২৫ বছরে কী পেলেন, কী হারালেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি তখন চলচ্চিত্রে সুপারস্টার ছিলাম। এ কাজে এসে আমার চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে। আমি অবশ্য ওই সময় ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবিনি। এই আন্দোলন যখন শুরু করলাম, প্রথম দিকে কোনো সাফল্য পাইনি, বরং অনেকে আমাদের গালাগালি করতেন। কেউ বলতেন, ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে’, ‘আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কাজ করছি, আল্লাহর মাল আল্লাহ নেয়’—এমনই নানা কথা। এখন কিন্তু মানুষ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন সবাই বোঝে, দুর্ঘটনা কারও না কারও গাফিলতির জন্য, অনিয়মের জন্য ঘটছে। এটা শুধু নিয়তির বিষয় না। আমরা এই সচেতনতাকে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা মনে করি। দেখেন, এত বছর পর এই নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে আমি একাত্মতা প্রকাশ করেছি। এই সময়ে আমার সন্তানসম্ভবা মেয়ে ইমাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল লন্ডনে। এ সময় মেয়ের পাশে বাবা হিসেবে আমার থাকাটা ভীষণ জরুরি, কিন্তু এরপরও যাইনি শুধু একটি কারণে। লন্ডনে আমার একটা মেয়ে, আর এই দেশে বর্তমানে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রাস্তায় আন্দোলনে হাজার হাজার সন্তান। এই কোমলমতি সন্তানদের রাস্তায় রেখে আমি কী করে মেয়ের কাছে যাই?
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত তথা বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল র জন য আপন র পথচ র
এছাড়াও পড়ুন:
টিনএজ সিনড্রোম: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক নীরব সংকট
এক সময় ছিল, যখন সন্তানের আবেগ, দুষ্টুমি বা হঠাৎ রাগ দেখে বাবা-মা মুচকি হেসে বলতেন—“বয়স হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু আজ, সেই দুষ্টুমি পরিণত হয়েছে এমন আচরণে, যা অনেক সময় বাবা-মা পর্যন্ত চেনেন না। সন্তান চোখে চোখ রাখে না, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, কথা বললে রাগে ফেটে পড়ে। এই চিত্র এখন বিশ্বব্যাপী। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আমরা এক ‘Adolescent Syndrome’ বা ‘Teenage Behavioral Crisis’-এর মুখোমুখি, যা বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
আচরণগত বিপর্যয়ের পেছনে বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ সিনড্রোমের প্রধান কারণ তিনটি:
হরমোনের দোলাচল: ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের ওঠানামা টিনএজারদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হরমোনাল পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, যা আচরণে অতিরিক্ত আবেগ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণ বিকাশ: ১৩-১৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কের যুক্তিবোধ ও নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অংশ (prefrontal cortex) এখনও গঠনের পর্যায়ে থাকে। ফলে তারা আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়, ঝুঁকি নেয়, এবং কখন কী বলতে হবে—তা বোঝে না।
প্রযুক্তির নীরব আগ্রাসন: TikTok, Instagram, Snapchat—এসব প্ল্যাটফর্মে মেয়েরা দিনে গড়ে ৬–৮ ঘণ্টা সময় কাটায়। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়া সৌন্দর্য ধারণা, জনপ্রিয়তার চাপ, ফিল্টার সংস্কৃতি তাদের আত্মপরিচয়কে বিকৃত করে তুলছে।
কেন বেশি দেখা যায় মেয়েদের মধ্যে?
Emotional Sensitivity: মেয়েরা আত্মপরিচয় ও আত্মমূল্যায়নে বেশি স্পর্শকাতর।
Beauty Pressure: সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের শরীর, ত্বক, স্টাইল—সবকিছু নিয়েই এক অনিয়ন্ত্রিত চাপ কাজ করে।
Hormonal Impact: মাসিক চক্র ও হরমোন ওঠানামা তাদের মুড, আবেগ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বাবা-মা কি আগের তুলনায় বেশি সমস্যায়?
হ্যাঁ, এবং এর পেছনে রয়েছে পরিবারে সংলাপের ঘাটতি। অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের আধিপত্য। পিতামাতার নিজের মানসিক চাপ। বিকৃত প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা। আজ অনেক অভিভাবক জানেন না—কীভাবে সন্তানের কাছে পৌঁছাতে হয়। তারা নিজেরাই কর্মব্যস্ত, ক্লান্ত, মানসিকভাবে নিঃশেষ।
বিশ্বের অবস্থা কী বলছে?
জাপানে টিনএজ আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সুইডেনে, গত ১০ বছরে কিশোরীদের বিষণ্ণতা বেড়েছে ৪৭%। যুক্তরাষ্ট্রে, CDC বলছে—“Teenage girls are experiencing record levels of sadness, violence, and suicidal thoughts.” বাংলাদেশে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্ণতা বেড়েছে প্রায় ৫০% (মনোরোগ ইনস্টিটিউট, ২০২৩)।
তাহলে বাবা-মা কী করবেন?
শুনুন, শাসন নয় – সন্তানকে সময় দিন, তার কথার পেছনে আবেগ বুঝুন।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ করুন – নিজেরাও মডেল হোন প্রযুক্তি ব্যবহারে।
কাউন্সেলিংয়ে ভীতি নয় – প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিন।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যও রক্ষা করুন – সন্তানকে বোঝাতে গেলে নিজের ভেতরে শান্তি থাকা জরুরি।
একটি প্রজন্ম যেন না হারিয়ে যায়। এই সংকট নিছক পারিবারিক নয়—এটি এক সামাজিক দায়। টিনএজারদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা বোঝা না গেলে, আমরা এক ‘চুপ করে থাকা বিষণ্ণ প্রজন্ম’ হারিয়ে ফেলব। সন্তান যখন বিদ্রোহ করে, সে আসলে জানিয়ে দেয়— ‘আমি ভালোবাসা চাই, বোঝার মানুষ চাই।’ আমাদের দায়িত্ব তাদের ভাষা বুঝে নেওয়া।
তারা//