১ লাখ ২৫ হাজার ডলারের ফান্ড পাওয়া মনষায় কী আছে
Published: 27th, April 2025 GMT
এক রাতের কথা। ইয়ানুর ইসলাম দেখলেন—তাঁর স্ত্রী ক্লাস শেষে ঘরে ফিরেও ল্যাপটপ খুলে বসেছেন। কখনো লেসন প্ল্যান, কখনো ছাত্রের মূল্যায়ন, কখনো অভিভাবকদের মেসেজ—তাঁর দিন যেন শেষই হয় না। ক্লান্ত চোখে তিনি বলছিলেন, ‘শিক্ষকের কাজ তো শুধু ক্লাসে না। ক্লাসের বাইরেও অনেক কিছু সামলাতে হয়।’ কথাগুলো ইয়ানুরের মাথায় গেঁথে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই নানা নতুন উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন এই তরুণ। ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ক্লাবের সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে নিজেই শুরু করেছিলেন বহুব্রীহি নামের শিক্ষাপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু স্ত্রীর কথা থেকে ইয়ানুরের মাথায় খেলতে থাকে এক নতুন উদ্যোগের ভাবনা।
যে ভাবনা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের আজমাইন আদেলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। ইয়ানুর বলেন, ‘আমি যখন আদেলের সঙ্গে আইডিয়া শেয়ার করি, তখন একটা সুবিধা ছিল। ওর মা ও স্ত্রী, দুজনই শিক্ষক। তাই সে সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখেছে। আইডিয়াটা বোঝাতে আমার খুব বেগ পেতে হয়নি।’
আরও পড়ুনহার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডকে হারিয়ে যেখানে প্রথম বুয়েট৮ ঘণ্টা আগেএভাবেই শুরু মনষার যাত্রা। মনষা এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্ল্যাটফর্ম, যা শিক্ষকদের সহায়তা করে। কমিয়ে দেয় কাজের চাপ।
যেভাবে সাড়া ফেললবাজার যাচাই করে ইয়ানুররা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শুধু বাংলাদেশের জন্য তাঁরা প্ল্যাটফর্ম বানাবেন না। কেননা বাংলাদেশের শিক্ষকেরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে এখনো পুরোপুরি অভ্যস্ত নন। কিন্তু বাইরের দেশের শিক্ষকদের কাছে যোগাযোগটা হবে কী করে? ফান্ডিং বা তহবিলের সমস্যা তো আছেই। তার ওপর আদেল তখনো একটা পূর্ণকালীন চাকরি করছিলেন।
সব বাধা সামলেই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করে ফেলেছেন দুই প্রকৌশলী। প্রথম সংস্করণটি শিক্ষকদের মধ্যে বেশ সাড়াও ফেলেছে। পাঠ্যক্রম তৈরি, সেই অনুযায়ী লেসন প্ল্যান বানানো, লেসন প্ল্যান থেকে কুইজ ও প্রয়োজনীয় স্টাডি ম্যাটেরিয়াল তৈরি—মনষার মাধ্যমে সবই করতে পারেন শিক্ষকেরা। আগে যেসব কাজ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় যেত, এখন সেগুলো কয়েক ক্লিকেই হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি গ্রাহক পেয়েছে মনষা, যার ৭০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের। ইয়ানুর বলেন, ‘আমরা কিন্তু আমাদের প্ল্যাটফর্মের মার্কেটিং সেভাবে করিইনি। গ্রাহকেরাই খুঁজে বের করছেন। এমনকি একটা ফ্রি ভার্সন থাকার পরও আমাদের গ্রাহকদের একটা বড় অংশ প্রিমিয়াম সাবস্ক্রাইব করছে। এ থেকে বোঝা যায়, এটি তাঁদের কাজ আরও সহজ করে দিচ্ছে।’
এসেছে তহবিললঞ্চ এক্সেলারেটর থেকে সম্প্রতি ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারের ‘প্রি-সিড ফান্ডিং’ পেয়েছে মনষা। এই তহবিল পাওয়ার পর নতুন করে আরও নানা পরিকল্পনা করছেন উদ্যোক্তারা। ইয়ানুর বলেন, ‘এখন আমরা পরিকল্পনা করছি, মনষার প্রোডাক্ট আরও উন্নত করে দেশের বাইরেও কাজ করব। যেভাবে সাড়া পাচ্ছি, তাতে আমরা পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী—যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি, তার সমাধান করা সম্ভব। বাজারে এর ভালো চাহিদা আছে। তবে কাজটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আমরা নানা ধরনের সাড়া পাচ্ছি এবং সেগুলোর ভিত্তিতে কাজ করতে আমাদের আরও একটি শক্তিশালী টিম প্রয়োজন। তাই এই ফান্ডিং নিয়েছি, যার মাধ্যমে আমাদের প্রোডাক্ট আরও উন্নত করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেটে আমাদের প্রোডাক্ট আরও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।’
আরও পড়ুনমায়ের শেষ সম্বল ৫০ হাজার টাকায় ছেলের উদ্যোগ২৭ অক্টোবর ২০২৪কিন্তু মনষা তাঁদের প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন দেশের সামাজিক বাস্তবতাগুলো কীভাবে বিবেচনায় নেয়? একেক দেশের পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি তো আলাদা। ফলে শিক্ষকদেরও আলাদা আলাদা কাজ করতে হয়। ইয়ানুর বলেন, ‘আমরা এমন একটা সিস্টেম ডেভেলপ করেছি, যেখানে আগেই কিছু কারিকুলাম লাইব্রেরি আকারে দেওয়া আছে। যেগুলো বিশ্বমানের। এর পাশাপাশি একজন শিক্ষক চাইলে আগেই কিছু ইনফরমেশন ইনপুট দিয়ে ওই লার্নিং অবজেকটিভ অনুযায়ী লেসন প্ল্যান, কুইজ ও প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়ালস তৈরি করতে পারেন।’
নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গিয়ে আরও একটু যোগ করলেন এই প্রকৌশলী, ‘আমাদের লক্ষ্য কিন্তু শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেট নয়, বরং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের সহায়তা করা। আমাদের এআইভিত্তিক প্ল্যাটফর্মটি শিক্ষকদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠবে। সারা বিশ্বেই শিক্ষার উন্নতিতে মনষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম শ ক ষকদ র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-পাকিস্তান কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পথে?
গত সপ্তাহে কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি মনোরম তৃণভূমিতে ২৬ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ঘাতকরা তাদের বেছে বেছে হত্যা করে। আমরা ঘটনার হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য পড়েছি। কীভাবে কাছ থেকে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে– পরিবারের সদস্যদের সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছে। এতে প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। এসব হত্যাকাণ্ড ছিল অযৌক্তিক। এ ছাড়া আমরা পড়েছি, কীভাবে কাশ্মীরি ট্যুরিস্ট গাইড ও শিশুদের বিনোদন রাইডের পনি অপারেটররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ভারতীয় পর্যটককে উদ্ধার করেছিলেন।
এই হামলা কারা ঘটিয়েছে, তা মৃতদের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়– সেটা পাকিস্তানি কিংবা স্থানীয় কাশ্মীরি হোক, অথবা উভয় সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের জীবন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভারত সরকারের চতুরতার সঙ্গে গড়ে তোলা স্বাভাবিকতার মুখোশও ধ্বংস হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটনের উত্থানের ফলে এই মুখোশ টিকেছিল।
আমরা আগেও অনেকবার এখানে এসেছি। প্রায় চার দশক ধরে কাশ্মীর রক্তপাতের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে শান্ত থাকে। স্বাভাবিকতার জয়ধ্বনিপূর্ণ ঘোষণা এবং শান্তির সঙ্গে নীরবতার ইচ্ছাকৃত মিশ্রণের মধ্যে কেটেছে, যাতে এখানে আবারও ভ্রমণে যাওয়া যায়। ২০১৯ সালেও এখানে বিরাজমান স্বাভাবিক অবস্থা এবং সংঘাতের অবসানের কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু সেই ভাবমূর্তি ভেঙে যায় ফেব্রুয়ারিতে, যখন জইশ-ই-মোহাম্মদ নামে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি আধাসামরিক বাহিনীর গাড়িতে আক্রমণ করে। এতে ৪০ ভারতীয় সৈন্য হত্যা করা হয় এবং দুই দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। ১৯৪৮ সাল থেকে তারা যে তিনটি যুদ্ধ করেছে, তাতে বহু দিক থেকে দেশ দুটি সর্বদা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ছিল। নির্দিষ্ট সময় পরপর তারা যুদ্ধের চারপাশে ঘুরতে থাকে; তারপর ফিরে আসে এবং অস্ত্র ও বাগ্বিতণ্ডা চলে।
এই বিপর্যয়কর বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে একটি প্রজন্ম এখন শেষের দিকে, যার বেশির ভাগ ক্ষতি কাশ্মীরিদের গুনতে হয়েছে। তাদের ৭০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, প্রায় ১০ হাজার হয়েছে নিখোঁজ এবং ২ লাখের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত (হিন্দু) বাস্তুচ্যুত। এর কারণ ১৯৮৯ সালে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বোমা বিস্ফোরণ বা পেহেলগামের মতো হামলায় ভারতীয় নাগরিকের নিহত হওয়ার ঘটনা। এটা বলা অযৌক্তিক– এ ধরনের সহিংসতা শূন্য থেকে উদ্ভূত। কারণ ব্যাপক সহিংসতার উৎস আমাদের ইতিহাস ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। যেমন ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগের এখনও জ্বলন্ত ক্ষত এবং কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের অমীমাংসিত প্রকৃতি।
২০১৮ সাল থেকে ভারত দিল্লির নিযুক্ত করা গভর্নরের মাধ্যমে সরাসরি এ অঞ্চল শাসন করে আসছে। পরের বছর মোদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। যদিও এখন একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তবু পদকে কার্যকরভাবে নামমাত্র করে তোলা হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত এতটাই বিকৃত হয়ে ওঠে, এই মাসের শুরুতে একটি উচ্চস্তরের নিরাপত্তা সভায় বর্তমান ক্ষমতাসীন এক কাশ্মীরিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে ভারত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান সীমান্তে প্রায় পাঁচ লাখ সৈন্য নিয়ে একটি বিশাল সামরিক বাহিনী বলবৎ রেখেছে। স্থানীয় বা পাকিস্তানি পৃষ্ঠপোষকতায় সশস্ত্র গোষ্ঠীদের জন্য এসব উর্বর ভূমি অবাক করার মতো কিছু নয়।
মির্জা ওয়াহিদ: ইংল্যান্ডভিত্তিক কাশ্মীরের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম