অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে আসন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচন। আগামীকাল শনিবার নির্বাচনকে সামনে রেখে লেবার পার্টি ও লিবারেল-ন্যাশনাল জোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের নেতৃত্বাধীন লেবার সরকারের প্রথম মেয়াদে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে।

সাম্প্রতিক জরিপে লেবার কিছুটা এগিয়ে আছে। তবে শেষ মুহূর্তের ভোটারদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, কে বসবেন ক্ষমতার মসনদে। দিন যত গড়াচ্ছে, অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সম্ভাবনা ততই বাড়ছে। বাড়ছে তাঁর বেড়ে উঠা, রাজনীতি ঘিরে মানুষের কৌতূহলও। সরকারি অনুদানের ফ্ল্যাটে শৈশব কেটেছে তাঁর। সেখান থেকে কীভাবে তিনি পৌঁছালেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ পদে, জীবনের সেই ঘটনা আলোচনায় এসেছে আবার।

একেবারে সাদামাটা এক পরিবারে জন্ম অ্যান্থনি অ্যালবানিজের। ১৯৬৩ সালের এক শীতের সকালে সিডনির ডার্লিংহার্স্ট এলাকার একটি সরকারি অনুদানের ফ্ল্যাটে জন্ম নেন তিনি। টিনের ছাউনির নিচে টয়লেট, সংকুচিত জীবনযাপন। মা ম্যারিয়ান এলিরি, যিনি ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী, একাই ছেলেকে বড় করেছেন। কারণ, মা অস্ট্রেলীয় হলেও বাবা ছিলেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত। তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে যাওয়ার পর আর এ দেশে ফিরে আসেননি। ফলে বেশ অভাব-অনটনে চলত সংসার। খরচ চলত প্রতিবন্ধী ভাতা ও সীমিত সরকারি সহায়তায়।

অ্যালবানিজের মায়ের একটিই স্বপ্ন ছিল—ছেলে যেন তাঁর চেয়ে ভালো জীবনযাপন করতে পারে। সেই স্বপ্নই হয়ে ওঠে অ্যালবানিজের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা।

প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাম্পারডাউনের স্কুলে, পরে সেন্ট মেরিজ ক্যাথলিক কলেজে পড়াশোনা করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খবরের কাগজ বিক্রি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় খণ্ডকালীন কাজ করে চালাতে হয়েছে পড়ালেখার খরচ। পরিবারে তিনিই প্রথম, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। ১৯৮৪ সালে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

রাজনীতিতে অ্যালবানিজের অবস্থান মধ্য-বামপন্থায়। ১৯৯৬ সালে নিজের এলাকায়, গ্রেইন্ডলার আসন থেকে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। প্রথম বক্তৃতাতেই বলেছিলেন, ‘আমি শুধু আমার এলাকার মানুষের নয়, সব শ্রমজীবী মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করব।’ সেই লক্ষ্যেই তিনি এগিয়ে যান নিরন্তর।

সমকামী দম্পতিদের অবসর সুবিধা নিশ্চিতকরণ, প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতীয় বীমা প্রকল্প প্রবর্তনসহ বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তনে অ্যালবানিজের অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০০৭ সালে অবকাঠামো মন্ত্রী হিসেবে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার অস্ট্রেলিয়া’ গঠনের মাধ্যমে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

২০২২ সালের ২৩ মে একদা সরকারি অনুদানের ফ্ল্যাটে বেড়ে ওঠা ছেলেটিই শপথ নেন অস্ট্রেলিয়ার ৩১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তাঁর সরকার এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের উন্নয়নে নিরলস কাজ করছে।

অ্যালবানিজের ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। ২০১৯ সালে ১৯ বছরের বৈবাহিক জীবনের ইতি টানার পর ২০২০ সালে এক নৈশভোজে পরিচয় হয় জোডি হেডেনের সঙ্গে। গত বছরের ভালোবাসা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বাগদান সম্পন্ন করেন তাঁরা। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বাগদানের ঘোষণা দেওয়া অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী এখন অ্যান্থনি অ্যালবানিজ।

শৈশবে বাবার অনুপস্থিতি ও সামাজিক কুসংস্কারের ভার নিয়ে বড় হওয়া অ্যান্থনি অ্যালবানিজ একসময় নিজে খুঁজে বের করেন তার হারিয়ে যাওয়া ইতালীয় বাবাকে। বাবার সঙ্গে সেই পুনর্মিলন তাঁর জীবনবোধে নতুন মাত্রা যোগ করে।

নিজের গল্প বলতে গিয়ে অ্যালবানিজ প্রায়ই বলেন, ‘আমি চাই অস্ট্রেলিয়া এমন এক দেশ হোক, যেখানে কোনো শিশুর জন্মপরিস্থিতি, ধর্মবিশ্বাস বা নামের শেষাংশ তার সামনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।’

অন্যদিকে, অ্যালবানিজের নির্বাচনী এলাকার আশপাশের অঞ্চলগুলোয় বাংলাদেশি কমিউনিটির ব্যাপক উপস্থিতি। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে অ্যালবানিজের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল জয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনেও অ্যালবানিজ ও তাঁর দল লেবার পার্টির হয়ে বহু বাংলাদেশি কাজ করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর সরক র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে

ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।

হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।

মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।

ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।

আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫

কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।

টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।

হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ  আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।

আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪

আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।

এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।

আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫

কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।

সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।

তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে