বাবুয়ানা যেখানে বীর ও আদর্শ, সৃষ্টিশীলতা সেখানে ব্যাহত
Published: 2nd, May 2025 GMT
কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, বাংলাদেশে এখন ভয়াবহ এক বন্ধ্যত্ব দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এখানে বেকার; যারা কাজে আছে, তারাও কাজ করে কম। কোনোমতে সময়টা কাটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসে। উৎপাদনে উৎসাহ নেই। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া– এই প্রবচন সব দেশেই আছে এবং সব দেশে সব কালেই তা সত্য বটে। মানুষ এখানে অলস হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়। কাজ পায় না। অকাজ করে, কুকাজ করে।
অপরাধ বাড়ে। বাড়তেই থাকে। আর বাড়ে লকলকিয়ে মৌলবাদ। সৃষ্টিশীলতা না থাকলে নানা প্রকার ব্যাধি দেখা দেবে। পচা ডোবা অসুখ ছাড়া আর কোন সুখই বা দিতে পারে! দিতে পারে না এবং দিচ্ছে না। জগৎ যেহেতু মানুষকে কিছু দিচ্ছে না, মানুষ তাই জগৎবিমুখ হয়ে পড়ছে। সামনে যেহেতু সে এগোতে পারছে না, তাই রওনা দিয়েছে পেছন দিকে। কেননা, তাকে তো চলতেই হয়– এক দিকে না এক দিকে সে চলবেই। মৌলবাদ ও অপরাধ একই উৎসমূল থেকে উৎসারিত। সেটি হচ্ছে ওই সৃজনশীলতার অভাব। বস্তুকে জানা এবং সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নব নব সৃষ্টির পথে অগ্রসর হওয়া; এটা হচ্ছে না। পাশাপাশি ভোগবিলাসিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিরকালের নিয়ম এটা, কিছু লোক থাকবে যারা পরিশ্রম করে উৎপাদন করবে, আর কিছু লোক থাকবে (সংখ্যায় তারা খুবই কম) যারা উৎপাদন ভোগ করতে থাকবে। এই ভোগবিলাসীরা বাবু স্বভাবের। সৃজনশীল নয়, উপভোগকারী। কেউ দস্যু, প্রতারক এবং কেউই উৎপাদনকারী নয়। সবচেয়ে করুণ ব্যাপার এই যে, এরাই আবার সামনে থাকে। নেতৃত্ব দেয়, কর্তৃত্ব করে। মর্যাদা পায় বীরের। এই শ্রেণির চাকচিক্য, সুগন্ধ, চলাফেরা, ভাবভঙ্গি সবকিছুই শ্রমজীবী মানুষের বিপরীতমুখো। কিন্তু এরাই হয়ে দাঁড়ায় সমাজের আদর্শ। শ্রমজীবী মানুষ এদের মাপে নিজেদের মাপতে চায় এবং স্বভাবতই নিজেকে অত্যন্ত হীন মনে করে। জলের ওপর তেল পড়লে সেটা যেমন শুধু ভাসতেই থাকে, মেশে না; ভোগবিলাসীদের সংস্কৃতিও তেমনি, জনজীবনের ওপর ভাসমান বোঝা হিসেবেই রয়ে যায়। জলের জন্য উপকারে লাগে না। কেবল পীড়ন করে।
কৃষক-শ্রমিকের জীবনকে আদর্শায়িত করার প্রয়োজন নেই। বস্তুত আদর্শায়িত করার অর্থটা দাঁড়াবে নিষ্ঠুর প্রতারণা। কৃষক-শ্রমিকের জীবন অত্যন্ত নিকৃষ্ট জীবন। প্রায় আদিম। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে, সমাজে সৃজনশীলতা যেটুকু রয়েছে তা ওই কৃষক-শ্রমিকের কারণেই। তার বাইরে তো কেবলই ভোগবিলাস, অপচয়, অনাসৃষ্টি। আর কৃষকের যে দুর্দশা তা সৃষ্টিশীল মানুষের দুর্দশারই প্রতীক বটে।
এই যে সৃষ্টির অভাব, এটা নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। বড় বেশি আওয়াজ শোনা যায়, সব দিক থেকে। অনেক উক্তিই দায়িত্বজ্ঞানহীন। অধিকাংশই অতিরঞ্জিত। ভেতরে জিনিস অল্প। সেই দিকটা আওয়াজ দিয়ে ভরে দেবার চেষ্টা চলে; ভরে না। সৃষ্টি অবশ্য নানা রকমের হয়। কোনো সৃষ্টি মাকড়সার, কোনটা মৌমাছির। আমাদের অনেক সৃষ্টিই আসলে মাকড়সার জালের মতো। খুবই সূক্ষ্ম, প্রশংসা করতে চাইলে অবশ্যই করা যাবে। কিন্তু মোটেই উপকারী নয়। কোনো কাজে লাগে না। বরঞ্চ জায়গা নষ্ট করে। লোকে দেখলে ব্যস্ত হয়, ফেলে দেবার জন্য। মাকড়সার জাল অনেক তৈরি হয়েছে। মৌমাছির মতো মধু আহরণ ততটা হয়নি। আমরা মনে করি আর কিছু না থাক, আমাদের সাহিত্য আছে। কিন্তু সে সাহিত্যে সারবস্তু কতটা রয়েছে– বলাটা আত্মসম্মানের জন্য সুখকর নয়। অনুবাদ করতে গেলে দেখা যায়, তেমন দাঁড়ায় না; অনেকটাই বায়বীয় মনে হয়।
পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাস করে। সেখানেই তার বিশেষ গুণ। প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করবে, বিক্রি করবে এবং মুনাফা করবে। সেটাই তার স্বর্গ। কিন্তু উৎপাদনে বিশ্বাসী ওই পুঁজিবাদই এখন উৎপাদনের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুঁজিবাদ সমস্ত কিছুকেই পণ্যে পরিণত করে। কাজেই যে সমস্ত মানবিক সৃষ্টির বাজার ছোট সেগুলোতে উৎসাহ দেখায় না। এই সমালোচনা পুরাতন এবং সঠিক। কিন্তু পুঁজিবাদ তো আর এক কাজ করে। বেকার সৃষ্টি। একদিকে যন্ত্র বসিয়ে মানুষের প্রয়োজনকে খাটো করে দেয়; অন্যদিকে ধনবৈষম্য সৃষ্টি করে অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে দেয় লাঘব করে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে পণ্যের চাহিদা কমে এবং চাহিদা কমলে পণ্যের উৎপাদন কমাতে হয়। উৎপাদন কমালে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। পাবেই।
পুঁজিবাদের রাজধানী খোদ আমেরিকাতে এখন বেকার সমস্যা দেখা দিয়েছে। সৃষ্টিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। অপরাধ বাড়ছে। ক্রমাগত। আর আমাদের মতো দরিদ্র পুঁজিবাদী দেশের তো কথাই নেই। আমাদের এখানে শিল্প নেই। এখানে অন্য দেশের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি কিছুটা আছে। পয়সা তাই ব্যবসায়ে রয়েছে। শিল্পে নেই।
বাবুরা যেখানে বীর এবং বাবুয়ানা যেখানে আদর্শ, সৃষ্টিশীলতা সেখানে ব্যাহত হবে না তো কোথায় হবে। হচ্ছেও। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী মানুষের পক্ষেও আশাকে লালন করা ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রয়াত শিল্পী এস এম সুলতান তাঁর বক্তৃতায় একটি জরুরি সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, সরকার সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করছে না। ফলে অপরাধ উৎসাহিত হচ্ছে। জরুরি সত্যটা হচ্ছে সরকারের ওই নেতিবাচক ভূমিকা। সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্র আসে। এবং রাষ্ট্র এলে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রশ্ন আসে। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি সৃষ্টিশীলতার অনুকূলে নয়। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্রের ওপর যখন যে দল কর্তৃত্ব করে সেই দলের সেবক ও সমর্থকরা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। গণমাধ্যমগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কেবল শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তো জীবন নয়। আরও জরুরি ও প্রাথমিক যা, তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন। সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে না। সঞ্চয় যেটুকু ঘটছে তা পুঁজিতে পরিণত হচ্ছে না। কেননা, তার বিনিয়োগ ঘটছে না। খেয়ে ফেলছে কিংবা বিদেশে দিচ্ছে পাচার করে। কিংবা রাখছে ফেলে। সব কিছু মিলে অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
সৃজনশীলতা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না। কেউ পারেনি। বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে নিত্য দেখা যাচ্ছে। কারণ কী? না; কারণটা রাজনৈতিক নয়। কারণ হচ্ছে, নিজেদের মধ্যকার সুবিধাপ্রাপ্ত এবং সুবিধাবঞ্চিতদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা যে এমন কাণ্ড করল, তার নিন্দা সহজেই করা যাবে। কিন্তু কেন করল– সেটা ভাবা অধিক জরুরি বটে। করল এই জন্য যে, এই ছাত্রদের সামনে এর চেয়ে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। জয় করবার নেই কোনো বিশ্ব। তাই জয় করতে চায় ক্ষমতা ও প্রাপ্তি। শহরে এসেছি। কাজ যা সামান্য ছিল শেষ হয়ে গেছে, এখন কী করা যায়? দিই চাচার নামে একটা মামলা ঠুকে। এ গল্প পুরোনো, কিন্তু এ গল্প এখনও সত্য এবং নিয়মিত ঘটে চলেছে।
পরিবেশের প্রসঙ্গটাই বা বাদ থাকে কেন? পুঁজিবাদ কখনও স্বীকার করেনি, সে পরিবেশের শত্রু। বস্তি তৈরি করেছে। অপরাধ বাড়িয়েছে। মানুষকে অভাবে রেখেছে। সবই ঠিক কিন্তু স্বীকার করেনি– এসবের কারণে পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। এখন স্বীকার করছে। কেননা, প্রাকৃতিক পরিবেশ এতই রুগ্ণ হয়ে পড়েছে, তাতে কেবল গরিব মানুষ নয়, ধনীরাও বিপন্ন। গায়ে আঁচ লাগছে, তাই স্বীকার করছে যে আগুন লেগেছে। পুঁজিবাদের এখন আর দেবার কিছু নেই, আগুন ছাড়া। যথার্থ সৃষ্টিশীলতার পথ ভিন্ন। সে পথের কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব ক র কর স জনশ ল পর ব শ আম দ র ক জ কর উৎপ দ সরক র আদর শ অপর ধ উৎস হ
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি সফরে কাতার গেলেন সেনাপ্রধান
সরকারি সফরে কাতার গেলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
শনিবার (৩ মে) সকালে তিনি কাতারের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।
আইএসপিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সফরকালে সেনাপ্রধান কাতারের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার লক্ষ্যে মতবিনিময় করবেন।
সফর শেষে আগামী ৫ মে সেনাবাহিনী প্রধানের দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
ঢাকা/হাসান/ইভা