আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বৃহস্পতিবার রাত একটার দিকে মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে এসেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে রাত ১০টার পর থেকেই অবস্থান করছেন এনসিপি মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহসহ কয়েক শ নেতা-কর্মী।

মিছিল নিয়ে নাহিদ ইসলাম যমুনার সামনে আসার আগে রাত ১২টার দিকে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত যমুনার সামনে থেকে তাঁরা সরবেন না।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আপনারা আমাদের গুলি করে থামাতে পারবেন না, আমাদের এই জীবন আমরা ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছি এই বাংলাদেশকে। যখন আমরা জুলাইয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম, তখন আমরা সকল শক্তি জুলাইয়ের পক্ষে আমাদের জীবনটাকে ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছিলাম।’

এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘সহযোদ্ধাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, পলিসি (নীতি) নিয়ে বিভাজন থাকবে, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রশ্নে পুরো বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ। যতক্ষণ পর্যন্ত না আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে এখানে (যমুনার সামনে) অবস্থান করব।’

প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আপনার এটা বলার ম্যান্ডেট নাই যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নেবে।’

এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা আপনাকে সম্মান করি, যতক্ষণ না আওয়ামী লীগকে গণহত্যাকারী, ফ্যাসিস্ট, সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা না করছেন এবং নিষিদ্ধ না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এখান থেকে কেউ উঠবে না।’

যমুনার সামনে একটু পরপর স্লোগান হচ্ছে, ‘ব্যান করো ব্যান করো, আওয়ামী লীগকে ব্যান করো’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘গোলামি না আজাদি, আজাদি আজাদি’।

রাত ১০টা থেকে অবস্থান

গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করা ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণার দাবিতে যমুনার সামনে রাত ১০টা থেকে অবস্থান নেন হাসনাত। এর আগে এ বিষয়ে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তাঁর সঙ্গে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরাও তখন যমুনার সামনে জড়ো হন।

এই কর্মসূচি চলার মধ্যেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম লিখেছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফ্যাসিস্ট ও খুনি আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। আসামিদের জামিন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রপতিকে চোখের সামনে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। বিচার প্রশ্নে সরকারের প্রতি আমাদের অনাস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে।’

নাহিদ ইসলাম ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরও লিখেছেন, ‘জুলাইয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল খুনিদের বিচার এবং মুজিববাদীরা বাংলার মাটিতে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না। আজ রাতেই ফয়সালা হবে আওয়ামী লীগের বিষয়ে। আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না আসা পর্যন্ত আমরা রাজপথ থেকে উঠব না।’

জুলাইয়ের সব শক্তি, শহীদ পরিবারের সদস্যদের ও আহতদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি লিখেছেন, ‘বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।’

নিষিদ্ধ হচ্ছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তিনি জানান, সপ্তাহখানেক আগে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিষয়টি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানান আসিফ মাহমুদ।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের দাবির মুখে গত বছরের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এখন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন। তিনি আজ রাতে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই প্রসেস করে সব ফর্মালিটি শেষ করে এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নিষিদ্ধ এবং রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্নকরণ নিশ্চিত করাই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম এনস প র সরক র র উপদ ষ ট অবস থ ন আম দ র র জন ত ফ সব ক স গঠন আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

পানির জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনার একটি প্রধান কারণ হলো, পানিসম্পদ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন। ভারত ইতোমধ্যেই চেনাব নদীর পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। আর এতেই পাকিস্তান আরও সংকটে পড়েছে। এই পানি নিয়ে টানাপোড়েনে দুই দেশের সংঘাত সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পাদিত দীর্ঘদিনের ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ থেকে সরে এসেছে ভারত। দেশটি চেনাবের পানিপ্রবাহও কমিয়ে দিয়েছে। এতে পাকিস্তান পানি সংকটের মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় ইসলামাবাদ খুবই অসন্তুষ্ট। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধও স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।    

পানি চুক্তি স্থগিত করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি ভারত। গত বুধবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ৯টি স্থানে সামরিক হামলা চালায় দেশটি। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে পারাপারও বন্ধ করেছে দুই দেশ। পাকিস্তানকে পানির সংকটে ফেলতে চায় ভারত। পানি চুক্তির সব বিধান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় দিল্লি।

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সিন্ধুর ব্যবস্থার পানিবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করা। চুক্তি অনুসারে, ভারত পূর্বাঞ্চলের নদী রাবি, বিয়াসসহ তিনটি নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। অন্যদিকে পাকিস্তান পশ্চিমের 

তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যা দেশটির জলসম্পদের ৮০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায়। চুক্তি অনুসারে কোনো পক্ষ এককভাবে চুক্তি থেকে সরে যেতে পারবে না। কিন্তু ভারত একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে গেছে।   

নদীগুলোর পানিপ্রবাহের ধরন ও নদী নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রক্রিয়া ভারতের অনুকূলে। এজন্য ভারত পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিলে তা পাকিস্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করায় পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। ভারত নদীগুলোর পানিপ্রবাহের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে পাকিস্তানে পানির ঘাটতি কিংবা বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। 

জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ওই সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। তাদের অধিকাংশই পর্যটক। ভারত এই হামলায় পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। ভারতের জনগণের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। এই অবস্থায় গত বুধবার ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর আগে দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পানিপ্রবাহ বন্ধ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাংকও পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়ে ভারতের বিরোধিতা করেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিপ্রবাহ বন্ধ করা প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটানোর শামিল। এই পরিস্থিতির ফলাফল অত্যন্ত খারাপ হতে পারে। মানবসভ্যতা টিকে থাকার সঙ্গে যা সরাসরি জড়িত। এই অবস্থায় ভারতের পদক্ষেপে পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। কারণ পানির প্রবাহ কমে গেলে নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দেখা দিতে পারে খরা, অনাবৃষ্টি কিংবা দুর্ভিক্ষ। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পানিপ্রবাহ সংকটে উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করে থাকে। 

ভারত-পাকিস্তানের এই জলযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। নিজ স্বার্থে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিলে সেই ক্ষতি ভারতের দিকেও পরিচালিত হতে পারে। এই জলযুদ্ধ বিশ্বের বড় বড় যুদ্ধের কারণে হতে দেখা গেছে। নীল নদের পানিপ্রবাহ নিয়ে যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। জর্ডান নদীর প্রবাহ রোধ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতেরও একটি কারণ। সূত্র: আলজাজিরা, জিও নিউজ।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ