এনবিআর বিলুপ্তির যে ব্যাখ্যা দিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
Published: 13th, May 2025 GMT
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে যে দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মূল লক্ষ্য হলো করনীতি প্রণয়ন ও কর ব্যবস্থাপনার কাজ আলাদা করা। দক্ষতা বাড়ানো, স্বার্থের সংঘাত হ্রাস ও দেশের কর ভিত্তি প্রসারিত করাও এর লক্ষ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এনবিআর বিলুপ্ত করার লক্ষ্য সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে।
প্রেস উইং বলেছে, কর-জিডিপির অনুপাতের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির বাস্তবায়ন করবে—এ অবস্থান সাংঘর্ষিক। সেই সঙ্গে এটা ব্যবস্থা হিসেবে অদক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আহরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; ন্যায়বিচার, প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা উপেক্ষা করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের কিছু প্রধান সমস্যাপ্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে, একই প্রতিষ্ঠানের হাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকায় করনীতিতে পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়ম হয়েছে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কার্যকর জবাবদিহি ছাড়াই কর ফাঁকিদাতাদের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করার সুযোগ পান। এটা জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনেক সময় কর আদায়কারীরা ব্যক্তিস্বার্থে ফাঁকিদাতাদের সাহায্য করেন। এ ছাড়া কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের বস্তুসম্মত কাঠামো নেই। প্রণোদনা বা পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট সূচক নেই। কর কর্মকর্তারা নিজ কাজে কতটুকু নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন, তার মানদণ্ড নেই।
নীতি ও প্রশাসনের দ্বৈত দায়িত্বের কারণে এনবিআরের মনোযোগ নির্দিষ্ট কোনো দিকে থাকে না। ফলে করজাল সম্প্রসারিত হচ্ছে না এবং রাজস্ব আহরিত হচ্ছে সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম।
আইন প্রয়োগে অসামঞ্জস্য, বিনিয়োগ সহায়তার অভাব, সুশাসনের পদ্ধতিগত দুর্বলতা—এসব কারণে এনবিআরের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। এসব কারণে আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে।
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধানই এনবিআরের প্রধান। সে কারণে আছে অস্পষ্টতা; অদক্ষতাও সৃষ্টি হচ্ছে সে কারণে। ফলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে।
এই সংস্কার নিয়ে অভিজ্ঞ রাজস্ব ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাঁরা ভাবছেন, তাঁরা উপেক্ষিত বা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
সংস্কারের সম্ভাব্য সুফলপ্রেস উইং বলেছে, এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ গঠন করা হলে দীর্ঘদিনের এসব জটিল সমস্যা সমাধানে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রণয়ন করা যাবে।
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ ও আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্ব হবে, কর আদায়, নিরীক্ষা (অডিট) ও আইন মেনে চলার বিষয়গুলো তদারক করা। এই দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে, যাঁরা কর নির্ধারণ করবেন, তাঁরা কর আদায়ে যুক্ত থাকবেন না। ফলে গোপন সমঝোতা বা অনিয়মের আশঙ্কা কমবে।
প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্বে মনোনিবেশ করলে বিশেষায়িত দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে; কমবে স্বার্থের সংঘাত।
প্রেস উইং বলেছে, প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমানো যাবে এবং দক্ষ জনবলের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে। স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণী ইউনিট থাকলে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যের বদলে তথ্যনির্ভর, দূরদর্শী করনীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। নীতির স্বচ্ছতা, ধারাবাহিকতা ও পেশাদার প্রশাসন দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করবে। অভিযোগ কমবে বেসরকারি খাতের।
প্রেস উইং ব্যাখ্যায় আরও বলেছে, এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক ও দক্ষ করব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শক্তিশালী নীতি নির্ধারণ ও স্বচ্ছ প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে।
সোমবার (১২ মে) রাতে আলোচিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশে শুধু রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে এই অধ্যাদেশের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র র কর মকর ত র লক ষ য কর জ ড প প রণয়ন অন প ত সরক র করন ত
এছাড়াও পড়ুন:
রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন: প্রধান উপদেষ্টা
দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হলো তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সংকট নিরসনে সাত দফা পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
তিনি বলেন, “অর্থায়ন কমে আসছে। একমাত্র শান্তিপূর্ণ পথ হচ্ছে তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা।”
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি’ বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা এই প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, “গণহত্যা শুরুর আট বছর পরও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেই। আন্তর্জাতিক অর্থায়নও মারাত্মক ঘাটতিতে ভুগছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং সমাধানও সেখানেই নিহিত।”
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ এবং দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “এটাই সংকটের একমাত্র সমাধান। মিয়ানমারের সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় জিম্মি করে রাখা উচিত নয়।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখার তুলনায় প্রত্যাবাসনে অনেক কম সম্পদের প্রয়োজন হবে। রোহিঙ্গারা বরাবরই নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সাম্প্রতিক সংঘাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অবিলম্বে প্রত্যাবাসনের সুযোগ দিতে হবে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশ সংকটের শিকার। আমাদের সামাজিক, পরিবেশগত ও আর্থিকভাবে বিপুল চাপ সহ্য করতে হচ্ছে।”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলছে। আমাদের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ—যেমন বেকারত্ব ও দারিদ্র্য—বিবেচনায় দেশে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।”
টেকসই সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাত দফা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দেন—
প্রথমত, রাখাইন অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু।
তৃতীয়ত, রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সহায়তা জোগাড় এবং তা পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
চতুর্থত, রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় স্থায়ী অন্তর্ভুক্তির জন্য আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।
পঞ্চমত, যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় অর্থদাতাদের পূর্ণ সহায়তা নিশ্চিত করা।
ষষ্ঠত, জবাবদিহি ও পুনর্বাসনমূলক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
সপ্তম, মাদক অর্থনীতি ভেঙে দেওয়া এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন করা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিশ্ব আর রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য অপেক্ষায় রাখার সামর্থ্য রাখে না।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ আমাদের সংকট সমাধানে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।”
ঢাকা/ইভা