চলতি বছর বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাই ৬১ হাজার, আরও হওয়ার আশঙ্কা
Published: 27th, May 2025 GMT
বিশ্বের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে ছাঁটাইয়ের ঢেউ অব্যাহত চলছে। ফলে কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে তীব্র অনিশ্চয়তা। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন ও ক্রাউডস্ট্রাইকের মতো কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে প্রযুক্তি খাতের বিশ্লেষকেরাও আশার আলো দেখাতে পারছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টার্টআপ সংস্থা লে অফস এফওয়াইআইয়ের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০টি কোম্পানির ৬১ হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন।
শুধু মাইক্রোসফট ১৩ মে এক ঘোষণায় ছয় হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা জানায়। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে ২০২৩ সালের পর এটিই সবচেয়ে বড় গণছাঁটাই। এই ছাঁটাইয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটে দুই হাজারের বেশি মানুষ এক দিনেই চাকরি হারান।
গুগল কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কর্মী ছাঁটাই করছে। চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি ২০০ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে। তাঁরা মূলত ছিলেন বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিভাগের কর্মী। এর আগে পিক্সেল, অ্যান্ড্রয়েড, ক্রোম ক্লাউড বিভাগ থেকেও কর্মী ছাঁটাই করা হয়। ২০২৩ সালে গুগল একসঙ্গে ১২ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছিল।
অ্যামাজন কয়েক বছর ছাঁটাই বন্ধ রাখলেও আবার সেই পথেই হাঁটছে। প্রতিষ্ঠানটি ডিভাইস ও পরিষেবা বিভাগে ১০০টি পদ বাতিল করেছে। ছাঁটাইয়ের তালিকায় আছে অ্যালেক্সা, কিন্ডল ও জুক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ক্রাউডস্ট্রাইক মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ৫ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইকোনমিক টাইমসের তথ্যানুসারে, এই ছাঁটাইয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যদিও প্রতিটি কোম্পানির পরিস্থিতি আলাদা, ২০২৫ সালের প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের পেছনে মূল তিনটি মূল কারণ নিম্নরূপ। এই কারণগুলোর মধ্যে আবার পারস্পরিক সম্পর্ক আছে—
১.বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, উচ্চ সুদের হার ও মূল্যস্ফীতির চাপ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে খরচ কমাতে এবং মুনাফার হার বাড়াতে বাধ্য করছে।
২. মহামারি-পরবর্তী প্রবৃদ্ধি সংশোধনকোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রযুক্তি খাত নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও বাড়তি চাহিদা সামলাতে দ্রুত কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এখন চাহিদা স্বাভাবিক হয়ে আসায় অনেক কোম্পানি তাদের কর্মিবাহিনীর আকার পুনর্নির্ধারণ করছে। লক্ষ্য, টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
২০২৫ সালে প্রযুক্তি খাতের এখন পর্যন্ত মূল খবর হলো কর্মী ছাঁটাই শুধু উদ্ভাবনের কারণে নয়, বরং শিল্পজুড়ে যে ব্যাপক পুনর্গঠন চলছে, সেটাই এই পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। তবে কোম্পানিগুলো ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কৌশলী হয়ে উঠেছে। তারা এখন এমনভাবে ছাঁটাইয়ের তথ্য প্রকাশ করে, যাতে প্রতিক্রিয়া কম হয় এবং তা যেন কোম্পানির বৃহত্তর লক্ষ্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকতে পারে। এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তদন্ত করে ভুয়া নাম বাদ দিন
সরকারি নথিপত্রে যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ভুল কিংবা মিথ্যা তথ্যের ইচ্ছাকৃত অন্তর্ভুক্তি সন্দেহাতীতভাবে ইতিহাস বিকৃতির সবচেয়ে খারাপ ধাপ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলোর প্রায় প্রত্যেকে এই গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি করা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রাজাকারদের, আর রাজাকারের তালিকায় সুবিদিত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের অন্তর্ভুক্তি দেখা গেছে। কিন্তু হাজারো তরুণের রক্তস্নাত জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে, তা অকল্পনীয় ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা দেখিয়েছে, আগের সেই রেশ থামেনি। দেখা যাচ্ছে, সরকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শহীদদের যে তালিকা করেছে, তাতে এমন অর্ধশতাধিক লোকের নাম এসেছে, যাঁরা জুলাই শহীদ নন।
জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন বিধিমালা, ২০২৫ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে: শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী অথবা আওয়ামী শাসক দলের লোকদের হাতে নিহত ব্যক্তিরাই জুলাই শহীদ বলে গণ্য হবেন। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, সরকারের তৈরি করা জুলাই শহীদদের তালিকায় কমপক্ষে ৫২ জনের নাম আছে, যাঁরা জমিসংক্রান্ত বিরোধ বা অন্য কারণে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন কিংবা নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এ ছাড়া তালিকায় তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন ছাত্রলীগ নেতা আছেন। এমনকি তালিকায় এমন একজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যিনি প্রতিবাদীদের ওপর হামলায় যুক্ত ছিলেন।
প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে এককালীন মোট ৩০ লাখ টাকা দেবে সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরে দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রত্যেক শহীদ পরিবার মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছে। ঢাকায় তাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
জনমানসের যৌক্তিক ধারণা, এই অর্থনৈতিক সুবিধার প্রলোভন তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা, শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং অপকৌশলের সুযোগ তৈরি করেছে। শুধু জালিয়াতি করে শহীদ দেখিয়ে শুধু সহায়তা নেওয়া নয়; সংশ্লিষ্ট নিহতের ঘটনায় মামলা করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার নজিরও মিলেছে।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, তালিকাভুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থ কাজ করে থাকতে পারে। ঘটনাটিকে দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তার মিলিত কৌশল এবং সুযোগসন্ধানীদের চক্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি সরকার আমলে নিয়েছে, এ জন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানাতে চাই।
বহু শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার এক মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। তাদের মনে রাখতে হবে, শহীদের মর্যাদাকে সরকারি পরিসরে আর্থিক প্রলোভন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা বা স্বার্থপর উদ্দেশ্যে বিকৃত করা হলে সেটি ইতিহাস, নৈতিকতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লঙ্ঘনের অমার্জনীয় অন্যায় হয়ে ওঠে।
এ অন্যায় থেকে বাঁচতে ও মানুষের আস্থা পুনঃস্থাপনে অবিলম্বে বিতর্কিত সব নামের সব সরকারি সুবিধা অবিলম্বে স্থগিত করতে হবে। স্বাধীন ও অরাজনৈতিক কমিটি গঠন করে প্রতিটি নামের পুনঃ যাচাই নিশ্চিত করা জরুরি। বাদ পড়া শহীদদের নামও তালিকায় যুক্ত করতে হবে। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে যাদের গাফিলতি বা দুর্নীতির কারণে এই অনিয়ম হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসে এক অমর মাইলফলক। এর শহীদদের তালিকায় নকল বা অপ্রাসঙ্গিক নাম সংযোজন করা হলে ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা’ সব ‘ধরার ধুলায় হবে হারা’। সরকারকে এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে।
আশার কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কোনো প্রকার ভুয়া প্রমাণিত হলে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে গেজেট প্রকাশ এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নে মন্ত্রণালয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কথা ও কাজের সম্মিলিত প্রয়াস আমরা দেখব, সেটিই কাম্য।