চীনকে বাগে আনতে ট্রাম্পকে যে পথে হাঁটতে হবে
Published: 28th, May 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপের যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছে এবং সেই সমালোচনার পেছনে যুক্তিও আছে। কিন্তু ট্রাম্প যেটি বলছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কলকারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটি একেবারে ভুল কিছু নয়।
সমস্যা হলো ট্রাম্পের ‘চিকিৎসা পদ্ধতি’। তিনি যেন অস্ত্রোপচার করতে চাচ্ছেন করাত দিয়ে, যা কিনা রোগীকেই মেরে ফেলতে পারে। অথচ দরকার ছিল আরও সূক্ষ্ম স্ক্যালপেল (অপারেশনের জন্য ব্যবহার্য ধারালো ছুরি)। সরলভাবে বললে, ট্রাম্প সমস্যার ধরন বুঝলেও তাঁর সমাধানের পথটা খুব রুক্ষ আর বিপজ্জনকভাবে বেছে নিয়েছেন।
বর্তমানে যেটা আমরা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নিয়মকানুন দেখি (যেমন বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্যের লেনদেন ও ডলারের গুরুত্ব), তার সবকিছু তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেটন উডস নামের একটি জায়গায় অনুষ্ঠিত এক বড় সম্মেলনে। তখন ইউরোপ ছিল যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি। ১৯৪৮ সালে ওই সম্মেলনের চার বছর পর দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি পণ্য একা যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করত।
তবে সেই সময় যে ‘নির্ধারিত বিনিময় হার’ (ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট) চালু করা হয়েছিল, মানে একেক দেশের মুদ্রার মান একভাবে বেঁধে দেওয়া হতো, তবে সেটি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হয়নি। এর ফলে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশিল্প দুর্বল হতে শুরু করে। ১৯৫৩ সালে বিশ্বে উৎপাদিত সব পণ্যের ৫৫ শতাংশ যেটি একা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করত, সেটি ১৯৭০ সালে ২৪ শতাংশে নেমে আসে।
এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে বড় একটি সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মার্কিন ডলারকে সোনার মানের সঙ্গে যুক্ত থাকার নিয়ম থেকে আলাদা করে দেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের অবস্থা কিছুটা স্থির হয়। পরবর্তী ৩০ বছর ধরে অবস্থা মোটামুটি একই রকম থাকে।
সরল করে বললে, যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় কারখানা ছিল দুনিয়ার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভুল নিয়মে তাদের উৎপাদন দুর্বল হয়। পরে কিছু বড় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা আবার নিজেদের অবস্থান কিছুটা ঠিক করে নেয়।
চীনের পরিবারগুলো যত কম খরচ করে, ততই চীনের ভেতরে (দেশের মধ্যে) জিনিসপত্র বিক্রি কম হয়। তাই তারা বাধ্য হয়ে অনেক পরিমাণে পণ্য তৈরি করে অন্য দেশে রপ্তানি করে। ২০২৩ সালে চীন প্রায় ১ দশমিক ৮৬ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা তাদের পুরো জিডিপির ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।ডলারকে সোনার মান থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক বড় প্রভাব হলো যুক্তরাষ্ট্র আগে যে আয় করত (অর্থাৎ রপ্তানি করে যা পেত), তার চেয়ে বেশি খরচ করা শুরু করে (অর্থাৎ আমদানি বেশি করে)। ফলে ধীরে ধীরে তারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঘাটতির দেশ হয়ে ওঠে। আর এই সুযোগে জাপান তাদের উৎপাদন খাত অনেক বড় করে তোলে।
এরপর ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর (জাপান, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) সঙ্গে এক চুক্তি করে, যার মাধ্যমে ডলারের মূল্য কমিয়ে দেয়। এতে কিছুদিনের জন্য আমদানি কমে যায় এবং বাণিজ্যঘাটতি কিছুটা কমে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে নাফটা নামে একটা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি চালু হয়, আর ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেয়। তখন ব্যাপক হারে সস্তা চীনা পণ্য মার্কিন বাজারে ঢুকতে থাকে।
২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দুটি বিষয় ঘটে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ও আমদানির অনুপাত ৬৫ শতাংশ থেকে কমে ৪৫ শতাংশে চলে আসে। মানে আমদানি বাড়ে, রপ্তানি কমে। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, তাদের উৎপাদনের পরিমাণ, যা একসময় দুনিয়ার ২৫ শতাংশ ছিল, তা নেমে ১৬ শতাংশে নেমে যায়।
আরও পড়ুনচীনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো হারাতে পারবে না আমেরিকা০৪ মে ২০২৫এই তথ্যগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে আর এর পেছনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি অনেকটা দায়ী। ট্রাম্প এই দুর্বলতার দিকটা ঠিকই ধরেছেন। তবে তিনি যে কৌশল নিচ্ছেন, যেমন সবার ওপর একসঙ্গে শুল্ক বসিয়ে দেওয়া, সেটি সমস্যা কমানোর বদলে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো চীন নিজেও তাদের অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন বা ওভারক্যাপাসিটি সমস্যার কারণে বেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। মানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চীনও সমস্যায় আছে।
শিশুরা অনেক কিছু ব্যবহার করে, যেমন খেলনা, জামা–কাপড়, খাবার, শিক্ষা, ইত্যাদি। তাই কোনো পরিবারে যত বেশি শিশু থাকে, তত বেশি খরচ হয়। কিন্তু চীনে অনেক দিন ধরে এক সন্তান নীতি চলায় এখন তাদের শিশুদের সংখ্যা অনেক কম। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবার ছোট হয়েছে, অন্যদিকে তাদের খরচও কমে গেছে। এই কারণেই চীনে মানুষের আয় কম এবং তারা বাজারে খুব বেশি জিনিসপত্র কেনে না।
চীনের পরিবারগুলো যত কম খরচ করে, ততই চীনের ভেতরে (দেশের মধ্যে) জিনিসপত্র বিক্রি কম হয়। তাই তারা বাধ্য হয়ে অনেক পরিমাণে পণ্য তৈরি করে অন্য দেশে রপ্তানি করে। ২০২৩ সালে চীন প্রায় ১ দশমিক ৮৬ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা তাদের পুরো জিডিপির ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই জায়গাতেই যুক্তরাষ্ট্র একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, মার্কিনরা অনেক জিনিস কেনেন ও ব্যবহার করেন। আবার ডলার হলো বিশ্বের প্রধান মুদ্রা, তাই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে অনেক পণ্য কিনতে পারে এবং সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি করতে চায়। চীনের অতিরিক্ত পণ্যের জন্য তাই যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এই দুই দেশের এমন সম্পর্ককে ইতিহাসবিদেরা বলছেন ‘চিমেরিকা’ (চীন আর আমেরিকা মিলিয়ে এই নাম)।
এই সম্পর্ক শুরুতে দুই দেশের জন্যই উপকারী মনে হলেও পরে সমস্যা তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের শিল্প ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়, কারণ, সস্তা চীনা পণ্য মার্কিন বাজারে ঢুকতে থাকে। আর চীনের ভেতরে নিজের মানুষের চাহিদা এত কম যে তারা সব সময় বাইরে পণ্য বিক্রি না করলে চলতে পারে না।
চীন এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। সেখানে এখন এক সন্তান নীতির পরিবর্তে এখন দুই সন্তান বা তিন সন্তান নিতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ পরিবার এত কম আয় করে যে তারা আর বেশি সন্তান নিতে চায় না।
চীন সরকার এখন ভাবছে, তাদের কাছে তো অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা তরুণ আছেন, তাই তাঁদের দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই তরুণেরা চাকরি খোঁজেন যেসব জায়গায়, সেখানে খুব কম চাকরি আছে। তাই দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, নতুন বিয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, যার মানে হচ্ছে জন্মহারও কমছে।
এসব সমস্যা সমাধানে যদি যুক্তরাষ্ট্র (বিশেষ করে ট্রাম্প) সব দেশের ওপর বড় বড় শুল্ক বসিয়ে দেয়, তাহলে শুধু চীন নয়, পুরো বিশ্ববাণিজ্যই বড় বিপদে পড়বে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল বাণিজ্যঘাটতি, তার সঙ্গে চীনের অতিরিক্ত রপ্তানি ভারসাম্য তৈরি করে।
ট্রাম্প যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চান, তাহলে সেটা চীন থেকেই করতে হবে। অর্থাৎ চীনের জন্মহার বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষের আয় বাড়ানোর ভেতরেই মূল সমস্যা নিহিত। কিন্তু এই কাজ শুল্ক বসিয়ে (ট্যারিফ দিয়ে) করা সম্ভব নয়। এটা করতে হলে চীনকে তার ভেতরের সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে বড় পরিকল্পনা করতে হবে।
ই ফুসিয়ান উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তিনি চীনের এক সন্তান নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র দ র বল র জন য অবস থ সবচ য় সমস য আমদ ন দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
আইএলডিটিএস পলিসি বহাল রাখার দাবি আইসিএক্স অপারেটরদের
আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার টেলিযোগাযোগ সেবা নীতিমালা (আইএলডিটিএস) বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) অপারেটররা। বিটিআরসির নতুন লাইসেন্সিং নীতিমালায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষতির মুখে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘খসড়া টেলিযোগাযোগ নীতিমালা–২০২৫: ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জের (আইসিএক্স) প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় আইসিএক্সের নেতারা এসব অভিযোগ করেন। কর্মশালাটি আয়োজন করে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি)।
কর্মশালায় আইসিক্স খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, খসড়া টেলিযোগাযোগ লাইসেন্সিং নীতিমালায় উল্লেখিত আইসিএক্স অপারেটররা টেলিযোগাযোগ ইকোসিস্টেমে কোনো মূল্য সংযোজন না করে খরচ বাড়াচ্ছে। সেবার গুণগত মান কমাচ্ছে এবং বাজারের গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে—এমন মন্তব্য বিভ্রান্তিমূলক। প্রকৃত চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো।
উল্লেখ্য, কথা বলার ক্ষেত্রে এক মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে অন্য অপারেটরের কল আদান-প্রদান হয় ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ বা আইসিএক্সের মাধ্যমে।
আরও পড়ুনকথা বলা ও ইন্টারনেট সেবায় মধ্যস্বত্বভোগী কমবে, গ্রাহকের লাভ কী২৩ এপ্রিল ২০২৫আইসিএক্স অপারেটররা না থাকলে সরকার বছরে ২৮০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাবে বলে কর্মশালায় দাবি করেন আইসিএক্স অপারেটররা। তাঁরা বলেন, এতে দেশের বাজারে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি তথা মোবাইল অপারেটরদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষতি এড়াতে আইএলডিটিএস নীতিমালা বহাল রাখার দাবি জানান তাঁরা।
কর্মশালায় বক্তব্য দেন টেলিকমিউনিকেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার অপারেটর অব বাংলাদেশের (টিআইওবি) সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশীদ আলম প্রমুখ।
টিআরএনবির সভাপতি সমীর কুমার দের সঞ্চালনায় কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। কর্মশালায় আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এআইওবি) সহসভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম, ভয়েসটেলের চিফ অপারেটিং অফিসার মুস্তাফা মাহমুদ হোসেন, বাংলা আইসিএক্সের পরিচালক হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক ফোনকল আনা: সালমানের ‘গড়া সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিটিআরসির১২ এপ্রিল ২০২৫