বিয়ের খবরে ক্ষুব্ধ, সাবেক প্রেমিকাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত ছাত্রলীগ নেতার
Published: 30th, May 2025 GMT
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। ছেলেটি ছাত্রলীগের নেতা, বর্তমানে আত্মগোপনে। মেয়েটি করেন শিক্ষকতা। এ অবস্থায় সাবেক প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে ছুটে এসে এলোপাতাড়ি ছুরি মেরেছে ছেলেটি। এরপর তিনি নিজের শরীরও ক্ষতবিক্ষত করেছেন।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। দুজনই সিলেটের দুটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মেয়েটির অবস্থা গুরুতর হওয়ায় গতকাল রাতেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুনপাড়া এলাকার বাসিন্দা সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ (২৮) সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তাঁর গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নৌকাখালী গ্রামে। সুনামগঞ্জের একটি উপজেলার বাসিন্দা মেয়েটিও (২৬) তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখানেই তাঁদের পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পড়াশোনা শেষে মেয়েটি এখন তাঁর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু মাঝখানে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। সঞ্জীবন গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যেই মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু মেয়ে ও তাঁর পরিবার তাতে রাজি হয়নি।
পারিবারিকভাবে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে আগামী রোববার মেয়েটির বিয়ের দিন ঠিক করা ছিল। এ জন্য মেয়েটি উপজেলা থেকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে তাঁর ভাইয়ের বাসায় আসেন। এখানেই বিয়ের আয়োজন চলছিল। গতকাল বিকেলে মেয়েটি তাঁর বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে শহরের হাসননগর এলাকার একটি পারলারে যান। পারলারে ঢোকার আগেই সঞ্জীবন সামনে এসে দাঁড়ান। মেয়েটিকে একটু আড়ালে নিয়েই এলোপাতাড়ি ছুরি মেরে চলে যান তিনি। পরে আশপাশের লোকজন মেয়েটিকে আহত অবস্থায় সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পরে রাতেই তাঁকে সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সঞ্জীবন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে চলে যান শহরের ধোপাখালী শশ্মানঘাট এলাকায়। সেখানে তিনি নিজের শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। তখন আশপাশের লোকজন তাঁকে ধরে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ তাঁকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মেয়েটির এক চাচাতো ভাই চিকিৎসক। তিনি জানান, তাঁর বোনের শরীরে ধারালো ছুরির ১০টি আঘাতের চিহ্ন আছে। এর মধ্যে ৯টিই গভীর ক্ষত। সুনামগঞ্জ থেকে প্রথমে তাঁকে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এনে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মেয়েটির পরিবারের আরেক সদস্য জানান, সঞ্জীবন তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিলন। তাঁর (সঞ্জীবন) পরিবারকে জানানোর পরও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিবুর রহমান জানান, ঘটনার পর সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে আটক করা হয়েছে। তিনি এখন পুলিশি হেফাজতে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ ন র পর পর ব র উপজ ল সরক র র একট অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’