‘ঢলন’ প্রথা বহাল, মণ হিসেবেই বিক্রি হচ্ছে আম
Published: 17th, June 2025 GMT
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারগুলোয় এখনও ‘ঢলন’ প্রথা বহাল রেখেই মণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে আম। কেজি হিসেব করে কমিশনের ভিত্তিতে আম কেনাবেচা করতে নারাজ চাষিরা। সেজন্য মণেই বিক্রি হচ্ছে আম। ফলে মাঠ পর্যায়ে বাস্তাবায়ন হচ্ছে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত।
এরআগে গত বুধবার (১১ জুন) রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে ‘ঢলন’ প্রথা বাতিল করে প্রতি কেজিতে দেড়টাকা কমিশনের ভিত্তিতে বাজারে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এদিকে, জেলার সচেতন নাগরিকরা মনে করেন- কেজির হিসেবে কমিশনে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। বাজারগুলোয় ঢলনের ওজন কমিয়ে আনতে পারলেই চাষিরা আম বেচে লাভবান হতেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বড় বাজারের নাম কানসাট। এখানে দীর্ঘদিন ধরে ৪০ কেজির পরিবর্তে অতিরিক্ত ওজনে আমের মণ নির্ধারিত হয়ে আসছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিমণ ছিল ৪৫ কেজিতে। ২০১৬ সালে ডিজিটাল মিটার চালুর পর তা বেড়ে হয় ৪৬ কেজিতে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৪৮-৫২ কেজিতে মণ ধরে বিক্রি হচ্ছে আম।
তবে জেলার রহনপুর ও ভোলাহাট বাজারে এই কেজির পরিমাণ আরও বেশি। ওইসব জায়গায় ৫৩-৫৪ কেজিতে মণ ধরেই বিক্রি হয় ফলটি। ফলে এ জেলার চাষিরা ঢলনের ফাঁদে পড়ে ঠকছেন।
এরপরেই বিভিন্ন দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ পাশের দুটি জেলার চাষিদের নিয়ে কয়েক দফায় বৈঠকে বসে রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসন। এতে অংশ নেয় বিভাগটির সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর চাষি ও আড়তদাররা।
প্রথম দফায় কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের পরেই আড়তদাররা কেজিপ্রতি তিন টাকা কমিশন চাইলে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়। এ জটিলতা নিরসনে গত বুধবার (১১ জুন) চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সমন্বয়ে বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ঢলন বাদ দিয়ে কেজিপ্রতি দেড় টাকা বা প্রতি মণে ৬০ টাকা কমিশনের আম বেচাকেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরেই মাঠ পর্যায়ের আম চাষিরা কমিশনে আম বিক্রিতে নারাজ। সেজন্য প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মাঠে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
কেজি-কমিশন পদ্ধতিতে আম কেনাবেচা প্রসঙ্গে কানসাট আম বাজারের আড়ৎদার আমিরুল ইসলাম জাকিরের সঙ্গে কথা বলে রাইজিংবিডি।
তিনি বলেন, “প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তো কেজি দরেই কমিশনের ভিত্তিতে আম কিনতে রাজি। কিন্তু চাষিরা নিজ থেকেই ৫১-৫২ কেজিতে মণ হিসেব করে আম দিচ্ছেন। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সবমিলিয়ে আড়ৎদাররা জানালেন তারা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আম কিনতে প্রস্তুত। কিন্তু চাষিরা সেই সিদ্ধান্ত মানছে না।”
আমচাষিদের ভাষ্য- কেজির হিসেবে আড়ৎদাররা আম কিনতে চাইছেন ঠিকই। কিন্তু তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো দাম নির্ধারণের পাশাপাশি কারচুপি করছেন। দামাদামি করেও খুব একটা পত্তা পড়ছে না। যার কারণেই তারা মণ হিসেবেই আম বিক্রি করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নশিপুরের আমচাষি আব্দুর রাকিব একটি হিসেব কষে জানালেন, একমণ খিরসাপাত আমের দাম দুই হাজার টাকা। মণেই বিক্রি করতে গেলে এরকমই দাম পাওয়া যাচ্ছে। তবে কেজি দরে বিক্রি করতে গেলে আড়ৎদাররা দুই হাজার টাকাকে ৫৪ দিয়ে ভাগ করে প্রতি কেজি আমের দাম ধরছে মাত্র ৩৭ টাকা। ৪০ কেজি আমের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৮০ টাকা। এখান থেকে ৬০ টাকা কমিশন কেটে চাষি পান ১ হাজার ৪২০ টাকা। ঘুরেফিরে আমাদেরই ক্ষতি।”
শিবগঞ্জের শাহবাজপুরের আম চাষি মোজাম্মেল হক বলেন, “যেই হিসেবেই আম বেচাকেনা করা হোক না কেন; সব দিক থেকেই আমরা ঠকছি। বর্তমান সময়ে আমের পরিচর্যা করতে যে পরিমাণ খরচ-খরচা হয় তা কখনই উঠে না। বাধ্য হয়ে আম বিক্রি করতে হয়। এছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আম গবেষক বলেন, ‘‘কথা যখন উঠেছে আমের ওজন নিয়ে, তাই বাজারগুলোয় ঢলনের ওজন কমিয়ে আনতে পারলেই চাষিরা আম বেচে লাভবান হতেন। আমের মণ ৫২ কেজি থেকে ৪৫ কেজিতে কীভাবে কমানো যায় সেটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারতো। আলাদা করে কেজি হিসেবে কমিশনের ভিত্তিতে আম কেনাবেচা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।’’
প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে জানতে চাইলে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজাহার আলী বলেন, “বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একটি বৈঠকে ৪০ কেজিতে মণ ও কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশনে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তে বাজারগুলোয় বিক্রি হবে আম। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।”
ঢাকা/শিয়াম/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম ক ন ব চ র স দ ধ ন ত প ইনব বগঞ জ ব জ রগ ল য় মণ হ স ব আম ব চ
এছাড়াও পড়ুন:
বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।
শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।
গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলামস্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।
আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’