উসমানিয়া সাম্রাজ্যের নারীদের জীবন যেন এক রহস্যময় পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল—পশ্চিমা কল্পনায় তাঁরা ছিলেন হেরেমে বন্দী, নিপীড়িত ও বিলাসী জীবনের প্রতীক। কিন্তু আসলি সানকারের বই অটোমান উইমেন: মিথ অ্যান্ড রিয়েলিটি এই মিথ ভেঙে বাস্তবতার আলোকে উসমানিয়া নারীদের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে।
ইস্তাম্বুলে বসবাসরত এই আমেরিকান লেখিকা ঐতিহাসিক দলিল, পশ্চিমা ভ্রমণকারীদের বিবরণী এবং শরিয়াহ আইনে বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, সেখানকার নারীরা ছিলেন স্বাধীন, সম্মানিত ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাঁরা হেরেমে শুধু গৃহস্থালি পরিচালনা করেননি, বরং আদালতে নিজেদের অধিকার রক্ষা করেছেন, দানশীল কাজে অংশ নিয়েছেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছেন।
এই বই আমাদের শেখায় নারীর শক্তি ও মর্যাদা যুগ যুগ ধরে অটুট থাকে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নারী ও পুরুষ একে অপরের সহায়ক।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৭১)
সে সময় মিসর থেকে নারীরা ইস্তাম্বুলে এসে সুলতানের কাছে ন্যায়বিচারের আবেদন করতেন, এমনকি তাঁদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও।হেরেমের মিথ ও বাস্তবতা
পশ্চিমা ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’ দৃষ্টিভঙ্গিতে হেরেমকে প্রায়ই যৌনতা ও বিলাসের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু সানকার ব্যাখ্যা করেন, হেরেম ছিল নারীদের জন্য একটি পবিত্র ও গার্হস্থ্য স্থান, যেখানে তাঁরা তাঁদের জীবন পরিচালনা করতেন। এটি কোনো কারাগার নয়, বরং নারীদের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক।
বইটির ছয়টি অধ্যায়ে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ, গৃহস্থ হেরেম, দাসী, ইম্পেরিয়েল হেরেম, আদালতের নথি এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ—সানকার এই মিথ ভেঙে নারীদের বহুমুখী ভূমিকা তুলে ধরেছেন। তিনি লেডি মেরি মন্টেগুর বিবরণের মতো পশ্চিমা ভ্রমণকারীদের চিঠি ও ডায়েরি এবং আদালতের নথি ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের নারীরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম ছিলেন। সে সময় মিসর থেকে নারীরা ইস্তাম্বুলে এসে সুলতানের কাছে ন্যায়বিচারের আবেদন করতেন, এমনকি তাঁদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও। (সানকার, অটোমান উইমেন, ২০০৭, পৃ.
উসমানিয়া নারীদের জীবন
বইটি উসমানিয়া নারীদের দৈনন্দিন জীবনের রঙিন চিত্র তুলে ধরেছে। গৃহস্থালির আসবাব, পোশাক, খাবার, হাম্মামে স্নান, বিবাহ ও সন্তান জন্মের রীতিনীতি—সবই বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাজকীয় সন্তান জন্মের সময় হেরেমের ঘরগুলো মুক্তা, রত্ন এবং সোনা-রুপার সুতায় সজ্জিত করা হতো। রাজকন্যার জন্মে পাঁচটি ও রাজপুত্রের জন্মে সাতটি কামানের গোলা নিক্ষেপ করে সারা সাম্রাজ্যে ঘোষণা করা হতো। (সানকার, ২০০৭, পৃ. ১২৪)
বইটির অলংকরণে রয়েছে অসংখ্য চিত্রকর্ম, যা উসমানীয় নারীদের বাগানে পিকনিক, বিবাহের শোভাযাত্রা এবং দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে। এই চিত্রগুলো পাঠকের মনে এক জীবন্ত উসমানিয়া সমাজের ছবি আঁকে।
হুররেম সুলতান
হুররেম সুলতান, যিনি পশ্চিমে রোক্সেলানা নামে পরিচিত, উসমানিয়া ইতিহাসের এক প্রভাবশালী নারী। পোলিশ পুরোহিতের কন্যা হিসেবে জন্ম নেওয়া হুররেম সুলতান সুলেমানের প্রিয়তমা (হাসেকি) ছিলেন এবং পরে তাঁর আইনি স্ত্রী হন, যা তৎকালীন রাজকীয় প্রথার বিপরীত ছিল। সুলতান সুলেমান তাঁর প্রতি এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে তিনি অন্য কোনো সঙ্গী গ্রহণ করেননি।
হুররেম পাঁচটি পুত্রের জননী হন। তিনি মক্কা, মদিনা, জেরুজালেম, ইস্তাম্বুল ও এদিরনে বড় বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে ছিল মসজিদ, ধর্মশালা, হাসপাতাল ও স্যুপ কিচেন। জেরুজালেমে তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৫৫টি কক্ষ ছিল হজযাত্রীদের জন্য এবং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে খাবার ও পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল। (সানকার, ২০০৭, পৃ. ১২২)
ইসলামি শরিয়াহ আইন উসমানিয়া নারীদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ ও বিচ্ছেদে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। আদালতের নথি থেকে জানা যায়, নারীরা প্রায়ই তাঁদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে মামলা করতেন এবং জয়ী হতেন।আরও পড়ুনইসলামী সভ্যতার পনেরোটি নগরের কাহিনী২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩আইনি ও সামাজিক অধিকার
ইসলামি শরিয়াহ আইন উসমানিয়া নারীদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ ও বিচ্ছেদে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। আদালতের নথি থেকে জানা যায়, নারীরা প্রায়ই তাঁদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে মামলা করতেন এবং জয়ী হতেন। সানকার উল্লেখ করেন, ‘উসমানিয়া নারীরা সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন এবং আর্থিক বিষয়ে প্রায়ই বিশেষ সুবিধা পেতেন।’ (সানকার, ২০০৭, পৃ. ১৩৭)
পশ্চিমা ভ্রমণকারী লেডি মন্টেগু, জুলিয়া পার্ডো ও লুসি গার্নেটের বিবরণীতে বলা হয়েছে, উসমানিয়া নারীরা ‘বিশ্বের সবচেয়ে স্বাধীন’ ছিলেন এবং তাঁদের প্রতি আচরণ অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ হওয়া উচিত। (সানকার, ২০০৭, পৃ. ৯)
উসমানিয়া নারীদের খোদার সঙ্গে গভীর সংযোগ ছিল, যা তাঁকে কখনো করুণা ও ভালোবাসা, কখনো মহিমা ও শক্তি প্রকাশ করতে প্রেরণা দিত।আধ্যাত্মিক দিক
সানকার বইয়ের একটি অনন্য দিক হলো উসমানীয় নারীদের আধ্যাত্মিক জীবনের ওপর আলোকপাত। তিনি লেখেন, ‘উসমানিয়া নারীদের খোদার সঙ্গে গভীর সংযোগ ছিল, যা তাঁকে কখনো করুণা ও ভালোবাসা, কখনো মহিমা ও শক্তি প্রকাশ করতে প্রেরণা দিত।’ (সানকার, ২০০৭, পৃ. ১৬৫)
এই আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে স্থিতিশীলতা এনেছিল। সানকার নিজে একজন মুসলিম এবং হিজাব পরেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর আমেরিকান খ্রিষ্টান পটভূমি এবং ইসলাম গ্রহণের যাত্রা তাঁকে পূর্ব ও পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
সূত্র: মুসলিম হেরিটেজ ডটকম
আরও পড়ুনকোরআনের কাব্যিক ইংরেজি অনুবাদ০৫ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উসম ন য় র জন য জ বন র র জ বন করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
এআইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা চালাচ্ছে হ্যাকাররা
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে ‘গোস্ট কল’ ও ‘গোস্ট হায়ার’ প্রচারণার মাধ্যমে সাইবার হামলা চালাচ্ছে ব্লু–নরফ নামের একদল হ্যাকার। ল্যাজারাস হ্যাকার দলের শাখা হিসেবে পরিচিত হ্যাকারদের দলটি ভারত, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ওয়েব৩ ও ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে এ ধরনের সাইবার হামলা চালাচ্ছে। আজ রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গোস্ট কল ও গোস্ট হায়ার প্রচারণা মূলত ম্যাকওএস ও উইন্ডোজ ব্যবহারকারী ব্লকচেইন ডেভেলপার ও প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়। এ ধরনের সাইবার হামলায় হ্যাকাররা টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্মে নিজেদের বিনিয়োগকারী পরিচয়ে ভুয়া সাইটে অনলাইন বৈঠকের আমন্ত্রণ জানায়। বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য কেউ ‘আপডেট’ অপশনে ক্লিক করলেই কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার প্রবেশ করে। এরপর হ্যাকাররা দূর থেকেই তথ্য চুরির পাশাপাশি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
ক্যাসপারস্কি জিআরইএটির নিরাপত্তা গবেষক সোজুন রিউ জানান, আক্রমণকারীরা আগের ভুক্তভোগীদের ভিডিও ভুয়া অনলাইন বৈঠকে চালিয়ে দেখায়, যেন ভিডিও কলটি বাস্তব মনে হয়। এভাবেই তারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করে। এই প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত তথ্য শুধু ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধেই নয়, পরবর্তী সময়ে সাপ্লাই চেইন আক্রমণেও ব্যবহার করা হয়। আক্রমণকারীরা এভাবে বিশ্বাসের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারীর সিস্টেমে প্রবেশাধিকার পাওয়ার চেষ্টা করে।
এ ধরনের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন সহযোগীদের তথ্য যাচাই, অপরিচিত বা যাচাইহীন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব সময় নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন ক্যাসপারস্কির গবেষকেরা। একই সঙ্গে সার্বক্ষণিক সুরক্ষা, ইডিআর ও এক্সডিআর সক্ষমতার জন্য ক্যাসপারস্কি নেক্সট ব্যবহারের সুপারিশ করেছেন তাঁরা।