ছবি: সংগৃহীত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেই সমাধান

অভিশাপে তলিয়ে যাচ্ছে এক শহর। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হওয়া পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রতি সৃষ্টিকর্তা যেন দু’হাত খুলে দিয়েছেন। অথচ সেই সৌন্দর্যের বুকেই এখন দাঁড়িয়ে আছে এক বীভৎস দৈত্যাকার পাহাড়– আনন্দবাজার ল্যান্ডফিল, যার উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুট। এই বর্জ্যের পাহাড় নগরীর দীর্ঘমেয়াদি অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। এমন আরও একটি ল্যান্ডফিল রয়েছে নগরীর বায়েজিদ এলাকায়।
প্রাণবন্ত শহরটিতে আজ স্তরে স্তরে জমেছে প্লাস্টিক বর্জ্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দুই থেকে সাত মিটার পর্যন্ত জমেছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তর। গলিঘুঁজি থেকে নদীর তলদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ এই দূষণ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কেজিতে– তিন গুণ!
তবুও আশার আলো দেখছে চট্টগ্রাম। এই শহর এখন আর শুধু সমস্যার দিকে তাকিয়ে নেই; বরং সমাধান খুঁজছে। ‘বর্জ্য নয়, ব্যবস্থাপনাই সমাধান’– এই উপলব্ধি থেকে গড়ে উঠছে সচেতনতা, নতুন নতুন উদ্যোগ এবং পরিবর্তনের ঢেউ। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছে নবযাত্রা– বর্জ্যকে সমস্যা নয়, সম্ভাবনা হিসেবে দেখার।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-চসিক ও ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল অ্যাকশন-ইপসার সঙ্গে অংশীদারিত্বে ইউনিলিভার বাংলাদেশ কাজ করছে প্লাস্টিকদূষণ রোধে একটি টেকসই ও কার্যকর মডেল গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তারা শুধু প্লাস্টিক সংগ্রহই করছে না, বরং মানুষের চিন্তাভাবনাতেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে।
এই ‘প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগ’-এর আওতায় গড়ে তোলা হয়েছে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ মডেল। স্থানীয়দের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিক আলাদা করে ফেলতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে, এমনকি বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়েও আয়োজন করা হচ্ছে পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম। ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই উদ্যোগের আওতায় চট্টগ্রামে প্রায় ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যার ৭০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিন হাজারের বেশি বর্জ্য সংগ্রহকর্মীকে প্রশিক্ষণ ও জীবিকা সহায়তা দিয়েছে এবং ১ হাজার ৮২৭ জন অনানুষ্ঠানিক কর্মীকে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় এনেছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দারা এ উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেন হাতেনাতে। আগে যেখানে দুই দিন বৃষ্টি হলেই ড্রেন উপচে পড়ত, এখন তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। স্থানীয় এক বাসিন্দার ভাষায়, ‘আগে দুই দিন বৃষ্টি হলেই ড্রেন উপচে পড়ত। এখন সেটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমরা নিজেরাও এখন প্লাস্টিক আলাদা করি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মডেল গোটা বাংলাদেশের জন্য হতে পারে অনুকরণীয়।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ সংগ্রহযোগ্য হলেও রিসাইক্লিংয়ে যায় তার অর্ধেকেরও কম। এই সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন উদ্ভাবনী চিন্তা ও অংশগ্রহণমূলক কর্মপরিকল্পনা– যা ইউনিলিভার, চসিক ও ইপসা একত্রে দেখিয়ে দিয়েছে। প্লাস্টিক নিজে কোনো দানব নয়; সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবই একে অভিশাপে পরিণত করেছে। চট্টগ্রাম আজ সেই সত্য উপলব্ধি করতে শিখেছে এবং এক নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। v

সম্পর্কিত নিবন্ধ