ইয়াকুব ও রমজান। তারা আপন দুই ভাই। ইউনিয়নজুড়ে দৌরাত্ম্য তাদের, রয়েছে ৪০ জনের একটি বাহিনী। দুই ভাই অপরাধ সেরে নিরাপদে ঘুমানোর জন্য মাটির নিচে তৈরি করেছেন সুড়ঙ্গ। ইয়াকুব ও রমজান বারআউলিয়া এলাকার জহুরুল হকের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, দুই ভাই এলাকায় প্রকাশ্যে করেন ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বেচাকেনা। স্থানীয় শিল্পকারখানার হামলা চালিয়ে লুট করেন মালামাল। কথা না শুনলে মারধর করেন কারখানার কর্মকর্তাদের। ডাকাতি, অপহরণ ও ইয়াবার টাকায় গড়েছেন বহুতল ভবন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস করছেন দুই ভাই। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা আরও বেশি বেপরোয়া। 
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পূর্বে সোনাইছড়ি এলাকায় দুই ভাই তৈরি করেছেন ছয় তলা ভবন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই ছয় তলা ভবনে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। ছয় তলা ভবনের চারপাশে রয়েছে ত্রিপুরা বাসিন্দারা। তারা দুই ভাইয়ের ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন।   
তবে শেষ রক্ষা হয়নি রমজান ও ইয়াকুবের। গত বৃহস্পতিবার রাতে সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া এলাকা থেকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। তারা ওই এলাকার জহুরুল হকের ছেলে।
প্রথমে ইয়াকুবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ থেকে ছাড়িয়ে নিতে আসেন তার ভাই রমজান। এ সময় তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.

মজিবুর রহমান বলেন, ‘ইয়াকুব ও রমজান তারা দুই ভাই। ডাকাতি, মাদক, অপহরণসহ ইয়াকুবের বিরুদ্ধে ৭টি ও রমজানের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা রয়েছে থানায়।’ তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার দুই ভাই ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। তাদের রয়েছে এক ডাকাত বাহিনী। বাহিনীর সদস্যদের ধরতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ির মালামাল লুট ও স্থানীয় কারখানাগুলোয় চুরি-ডাকাতি করত তারা।’
মাটির নিচে সুড়ঙ্গ : এলাকার বাসিন্দা নুর উদ্দিন ও রাশেদ বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পূর্ব পাশে পাহাড়ের পাদদেশে ইয়াকুব আলী ও রমজানের বাড়ি। ছয় তলা ভবন থেকে কিছু দূরে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করেছেন তারা দুই ভাই। ডাকাতি ও ইয়াবা ব্যবসা শেষে সুড়ঙ্গ পথ পাড়ি দিয়ে অন্ধকার ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান দুই ভাই।’

যেভাবে পুলিশের জালে : সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এলাকায় একটি বৃহৎ ইস্পাত কারখানা থেকে চুরি করা স্ক্র্যাপ লোহা বারআউলিয়া থেকে ট্রাকে করে ডাকাতদল অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিল। এসময় কারখানার আনসার ও গার্ডরা ডাকাতদের বাধা দেয়। ডাকাত দলের সদস্যরা এসময় তাদের মারধর করে। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে পুলিশের সামনে থেকে ট্রাক ভর্তি লোহা নিয়ে প্রকাশ্যে চলে যায় তারা। এসময় পুলিশ নীরব দর্শনের ভূমিকায় ছিল। তবে পুলিশ এ বিষয়ে কিছু জানে না বলে জানায়। ওই কারখার আনসার ও কারখানার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বিষয়টি উর্ধতন কর্মকর্তাদের জানালে পুলিশ রাতে অভিযানে নামে, তাদের গ্রেপ্তার করে।
মাদক ব্যবসায়ীদের দুই দলে বিরোধ : সোনাইছড়ি ইউনিয়ন এলাকায়  মাদক ব্যবসা ও স্থানীয় শিল্প কারখানায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় ইন্না-রাজ্জাক ডাকাত গ্রুপের সঙ্গে ইয়াকুক-রমজান ডাকাত গ্রুপের বিরোধ চলছে। কয়েক দফা মারামারির ঘটনাও ঘটেছে দুই পক্ষের মধ্যে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে চলত তাদের এই ব্যবসা। সরকার পরিবর্তনের পর ডাকাত গ্রুপ বিএনপির কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে অব্যাহত রেখেছে তাদের অপরাধ।
স্থানীয় নাজমুল ও কফিল উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সোনাইছড়ি এলাকার বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ডাকাতি  করত ইয়াকুব ও রমজান। ডাকাত দলে ৪০ জন সদস্য রয়েছে। গত বুধবার ডাকাতির টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারি হয়।’


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর কর মকর ত এল ক র এল ক য় সরক র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

পদ্মাপাড়ের আহত জারুল ও পাখিরা

পদ্মাপাড়ের শক্তিশালী বাতাস সঞ্চয় করে ডানা ঝাপটানো পাখিরা হারিয়ে যায় দূরে। হয়তো সে সময়টা খুব ভোরে, যখন পারাবারের ফেরিকর্মী খসরু পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখিদের মতোই টুপ করে বারবার জলে ডুব দিয়ে গোসল করে তার সাবানের ফেনাসমেত শরীরটা নিয়ে। যে সাবানের সাদা ফেনা সরিয়ে ফেললে তার কালো কষ্টিপাথরের মতো শরীরটা বের হয়ে যায়, যার ভেজা চেকপ্রিন্টের লুঙ্গি নিতম্ব ঊরুতে লেপটে থাকলেও তা তার দেখা সিনেমার নায়িকাদের মতো যৌন কামনার বদলে উদ্রেক করে বিরক্তির, গা শিরশির করা ঘৃণার। এ সময় প্রতিদিন ভোরে ছন্দার মাকেও দেখা যায় এক পাশে এসে বাসনকোসন মেজে নিয়ে যেতে। খসরু যতবার ডুব দেয়, ঠিক সেই বরাবর ততবারই ছন্দার মা একদলা থুতু পানিতে ফেলে, যাতে তা খসরুর গোসলকে অসম্পূর্ণই রেখে দেয়। একই সঙ্গেই সাবানের ফেনা মেখে ফরসা হতে বাধা দেয়, নিতম্ব ঊরু সব সময় অবহেলিত হয়েই পড়ে থাকে। কোনো পাখি হয়তো নদীপাড়েরই উঁচু একটা ঢিবির ওপর রাখা বাঁশে গোসল শেষ করে উঠে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশেই কিছু উলঙ্গ শিশুও কাদা নিয়ে খেলা শেষে গোসল করতে ঝুপঝাপ লাপ দেয় পাড়ের অল্প পানিতে। কোনো পাখি হয়তো গভীর রাতে ফেরিঘাটের এই ব্যস্ততা, সারি সারি বাস, ট্রাক আর আলো-অন্ধকার ভেদ করে কালো গভীর পানিতে ছুটে চলা ফেরি চুপচাপ দেখে যায়; যেখানটায় ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’ নামফলক লেখা দেখা যায়, ঠিক সেখানটায় বসে।

ভরদুপুরে এমনই একটা পাখি আহত হয়ে পড়ে থাকে নদীপাড়ের উত্তপ্ত সাদা বালুতে। দলছুট হয়ে উড়তে না পারায় পাখি হতবিহ্বল হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বাকি পাখিরা উড়ে চলে পাল্লা দিয়ে ফেরির সাথে আর নিচে চাকায় ঘুরতে থাকা স্রোতের সাথে। সে সময় হয়তো বগুড়া থেকে বরিশালগামী নবীনবরণ বাসটাও ফেরিতে নদী পার হয়। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে ইসহাক ব্যাপারীকে নামতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে যে কেউ হয়তো বলবে ফেরির এক পাশে যে শৌচাগার আছে, ঠিকঠাক দরজার খিল দেওয়া ছাড়া, ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গন্ধময়, ব্যাপারীর হয়তো সেখানে যাওয়ার জন্যই এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু শৌচাগার ছাড়িয়েও সে সামনে এগোয় আশপাশে না তাকিয়ে। নাহ, শুধু একবার তাকায় যেখানে চানাচুর দিয়ে মসলা, তেল, পেঁয়াজ, ধনেপাতাকুচি মুড়িতে মেশানো হয় এক ইচ্ছাকৃত উচ্চ শব্দে, সর্বনিম্ন দশ টাকার এই মুড়ি মাখার ঘ্রাণ ব্যাপারীকে তাকাতে বাধ্য করে। মুড়িমাখাওয়ালা আর তার চারপাশের ভিড় সব অগ্রাহ্য করে একটা মাইক্রোবাস আর একটা ট্রাকের মাঝখানের অল্প ফাঁকের ভেতর দিয়ে শুকনো শরীরটা ঢুকিয়ে দেয় অল্পতেই পার হওয়ার জন্য। সে সবকিছু ফেলে প্রায় দৌড়ে হাটে। খাড়া লোহার সিঁড়ির হাতল ধরে পৌঁছে যায় তিনতলায়।

খসরু তিনতলায় ব্যস্ত সবাইকে খাবারদাবার ও ভাত দেওয়ায়। তিনতলায় এক পাশে তার চিপস, প্যাকেটের ভাজাপোড়া, চা–কফির দোকান। ফ্রিজটা আপাতত নষ্ট, নাহয় সেখানে আইসক্রিম থাকে। তারই আশপাশে দুটি টেবিল আর কিছু বেঞ্চ পেতে রাখা সবার ভাত খাওয়ার আর বসার জন্য। এক কোণে তার রান্না করার ছোট রুম। এখান থেকে বের হয়েই উঁচু বেঞ্চে সে গামলা ভরে ভাত, মাছ-মাংস, তরকারি, ডাল রাখে। সে একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে না পারায় এখান থেকে সবাই যে যার মতো নিয়ে খায়। মাঝেমধ্যে খসরু এসে তদারকি করে, কেউ তাকে ওতে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বিশেষত যেসব বাস–ট্রাকের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা নিয়মিত আসে। তার আজকের মেন্যু লালশাকভাজি, বেগুনভাজি, নদীর মাছ ভুনা আর পাতলা ডাল। ডাল সবার জন্য ফ্রি। শাপলা বাসের ড্রাইভার লালশাকের গামলা থেকে অর্ধেক শাক একাই খেয়ে ফেলে, আবার যাওয়ার সময় টাকা না দিয়েই মুহূর্তেই তিনতলা থেকে উধাও হয়ে যায়। খসরুর এখন সময় নেই তার পিছু নেওয়ার কিন্তু সে ধরবেই, এমনই সিদ্ধান্ত তার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে সে বাকিদের ডিমভাজি আর ডাল দেয়। এমন সময়-ই ব্যাপারী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ব্যাপারীকে খুব তাড়াহুড়ো করে বলতে শোনা যায়—“তত্তোরি দ্যাওসেন, দেরি হইয়্যা যাইতাসে তো।’ অল্পক্ষণ পরে মেলামাইনের জোড়া প্লেটের ওপর ভাত, ডাল, ডিমভাজি আর পাতলা শরীরটা নিয়ে ছুটতে দেখা যায় নিচে, বাসের ভেতরে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে সে ওপরে না খেয়ে এত ছোটাছুটির কারণ কী? কারণ সেখানে তার ছেলে আবদুর রহমান আর স্ত্রী অপেক্ষায়। ছেলেকে খাইয়ে সে আবার ছুটে চলে ফেরির তিনতলায় প্লেট-গ্লাস ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে একটা গ্লাসও চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে খসরুর কাছ থেকে; কারণ আবদুর রহমান গ্লাস ছাড়া শুধু বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে পারে না। 

২.

নদীর পাড়ে আহত পাখিটা সূর্যের উত্তাপে গরম হওয়া বালুতে ফুটতে থাকে। মনে হয় কে যেন শরীর থেকে একটা একটা করে নরম পালক টেনে খুলে ফেলছে। বিস্ফারিত কমলা কালো চোখের মণি নিয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকায়, সেখানের সূর্যের আলো তার চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করে। সূর্য আর তার মাঝখানে রংধনুর মতো একটা রাস্তা দেখা যায়। সব শক্তি সঞ্চয় করে সে ওড়ে। হায়, এক হাত সামনে যেতেই সে আবার বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসহাক ব্যাপারী এবার তিনতলা থেকে দ্রুত নেমে আসে দোতলায় নামাজ পড়ার জায়গায়। নামাজের ভেতর কণ্ঠনালি, জিহ্বায় জোর দিয়ে পড়া ‘ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন’ মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় নদীপাড়ের সুবিস্তৃত হাওয়ায়, সাদা চিকচিক বালুতে। তাতে বাইরের আর্দ্রতা কিছু না কমলেও ব্যাপারীর ভেতর পুরোটা দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে প্রস্তুতি নেয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু বলার, দীর্ঘ কোনো মোনাজাত ধরার।

৩.

আহত পাখির দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের আকন্দগাছের ঝোপের দিকে। তার চোখে ঝাপসা ধরা দেয় হালকা ময়লা বেগুনিরঙা আকন্দ ফুলের থোকাগুলো, মনে হয় এই দিনের আলোয়ও অসংখ্য তারা ফুটে আছে। যেভাবেই হোক ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে ছায়া মিলবে। পাখি তাকায় ঝোপের দিকে একবার, বিপরীত দিক থেকে রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসা লাল পিঁপড়ার সারির দিকে একবার আর আকাশের স্বচ্ছ কাচরঙা রোদের দিকে। সে দিগ্‌বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে গন্তব্য নিয়ে।  

ওদিকে নবীনবরণ বাসের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে। বাসের সুপারভাইজার মাথা গুনছে, সবাই ঠিকঠাক উঠল কি না। বাসের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফেরি থেকে ডাঙায় এপারে ওঠার জন্য তৈরি। ইসহাক ব্যাপারীর বউ আকলিমা পাশে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, নাক–মুখ বোরকায় ঢাকা আকলিমার ক্ষীণকণ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে বলছে—‘এই যে শুনছেননি ডেরাইভার সাব, আমাগো বাবুর আব্বা তো এক্ষনো আইসা পৌঁছায় নাই যে। হ্যায় নামাজ পড়বার গ্যাছে তো কইল। হে কই গ্যাছে, খুঁইজ্যা আনেন যে।’ সামনের সিটের দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরা বারো-তেরো বছর বয়সী ছেলেটাও এ মুহূর্তে হাতের শসা খাওয়া বন্ধ রেখে একবার আকলিমার দিকে আরেকবার দরজার দিকে, ড্রাইভারের দিকে তাকায়। বিটলবণসহ শসার রস বেয়ে তার পাঞ্জাবির দুই হাতা ভিজিয়ে ফেলে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এ মুহূর্তে না। ফেরির তৃতীয় তলায় সে সময় খসরু একটা বড় গামলায় ডাল, ডিমভাজি আর পোড়া শুকনা মরিচ নিয়ে ভাত খেতে বসে যায়। ঠিক দরজায় ঠাসা সুন্দর ঊরু বের করা লাস্যময়ী নায়িকার ছবির মুখোমুখি হয়ে। সারা দিনের এই একমুহূর্ত সময় পাওয়ার জন্য সে ছটফট করে। এ সময় সে ভাত খায় আর নায়িকার সঙ্গে একান্তে কথা বলে সুখ–দুঃখের, কোন কাস্টমার তার সঙ্গে কী ব্যবহার করল। সবশেষে প্রতিদিন এই আলাপ শেষ হয় এক কষ্ট নিয়ে। নায়িকাকে সে বলে—‘বুঝলানি আমি এই খসরু এত মাইনষেরে রান্না কইরা খাইওইলাম শুধু বাদ থাকলা আমার পেয়ারের লোক তুমি। আমার হাতের ইলিশ মাছ ভাজা শুকনা মরিচ পোড়া দিয়া আর কচি ডাঁটা চিংড়ির ঝোল খাইলে তুমি আমারে সারাডা জীবন মনে রাকতা গো, ভুলবার পারতা না, হ্যাভি টেস।’ সে গোগ্রাসে ভাত মুখে দিয়ে আবার বলতে থাকে—‘সারাডা দিন শুটিংয়ে থাহো, কী যে খাও, সবার রান্দন তো বালা না, কাছত থাকলে যত্ন–আত্তি কত্তামনি। তহন শুধু তুমার রান্দনই রানতাম গো নাইকা ।’ বলেই সে লজ্জা পেয়ে হাসে, আশপাশে কেউ দেখে ফেলল কি না খেয়াল করে। ফেরির দোতলায় সে সময় নামাজের মোনাজাতে ক্রন্দনরত ইসহাক বলছে বিড়বিড় করে—‘ইয়া আল্লাহ, আমার কথা শোনো গো আল্লাহ, কবুল কইর‌্যা লও সে, আমার পোলাডারে তুমি লইয়া যাইও না গো আল্লাহ। ও আল্লাহ, সারা জাহানের মালিক তুমি মায়ের কোলডা খালি কইরো না। আমি হ্যার মায়েরে কী দিয়া বুঝ দিমু গো আল্লাহ? হ্যায় তো জানে বড় হওনের লগে লগে পোলা ঠিক হইয়্যা যাইব। পোলাতো আরও রোগে পড়তাছে, হ্যার মা’য় তো সন্দেহ করতাসে আমারে। মায়ের মন তো!! আমি যেন হ্যার লগে মিছা কতা না কই। ও মাবুদ, আমি কেমনে কমু পোলার মায়েরে এই ডাউন সিনডোমের পোলার হায়াত আছে আর কয়ডা বছর মাত্র।’

৪.

আকাশে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে। কোত্থেকে মেঘের গর্জন শোনা যায়, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নদীপাড়ের অরিন গার্মেন্টস আরবিঅ্যান্ডবি ব্রিকফিল্ডের ছাইরঙা ধোঁয়া তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আহত পাখি তার ঠোঁট হাঁ করে, বৃষ্টির পানির স্বাদ নেয় তার পিপাসার্ত জিহ্বায়। তার চোখ, শরীর ভেজে, আহত ডানার রক্ত ধুয়ে যায়। খসরু সে সময় তিনতলায় হাঁড়ি–পাতিল ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, চুলায় তার রাতের ভাত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সে উদাস দৃষ্টিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে নাকি অন্য কিছু ভাবে, সেটা বলা মুশকিল। ইসহাক ব্যাপারীর এ মুহূর্তে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে। যা এতক্ষণ ধরে বহু চেষ্টায়ও কেন জানি আসেনি। সে বলতে থাকে—‘ইয়া মাবুদ, মাবুদ রে, রাহমানুর রাহিম তুমি তো তোমার বান্দারে খালি হাতে ফেরত দাও না। আমারেও দিয়ো না। প্রয়োজন হইলে আমারে লইয়্যা যাও গো আল্লাহ, তার বিনিময়ে আমার পোলাডার জীবনডা ভিক্ষা দাও, যেমন কইর‌্যা ফেরত দিসিলা বাদশার পোলারে (এ সময় সে বাসা থেকে মনে করে আসা বাদশাহ বাবর আর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের নাম বহুকষ্ট করেও মনে করতে পারে না )। ব্যাপারী আবার শুরু করে—‘আল্লাহ তুমি তো পানির ওপর থাকন অবস্থায় তোমার অসহায় বান্দার দোয়া কবুল করো। আমার চোখের সামনে আমার আবদুর রহমানরে নিয়ো না আল্লাহ।’ ব্যাপারীর সময়জ্ঞান লোপ পায়, তার হুঁশ থাকে না মোনাজাতে কতটা সময় পেরিয়ে যায়। নিচে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছায়। হঠাৎ করে নেমে আসা বৃষ্টিতে পুরো ফেরি পিচ্ছিল কাদাময় হয়ে যায়। যারা এতক্ষণ কোনো বাস ছাড়াই শুধু নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল, তারা তাদের বস্তা বেডিং, বাচ্চা ছেলের মেয়েদের হাত ধরে পার হয় গাড়িগুলো পাড়ে ওঠার আগেই। আশপাশের ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক ছোটে ধীরে ধীরে। পেছনে যাত্রীসহ নবীনবরণ বাসের ড্রাইভার গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে নেয় সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরি থেকে পাড়ে ওঠার। ব্যাপারীর বউয়ের চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের দু–একজন সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ব্যাপার কী জানতে। এ সময় ব্যাপারীর অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেরও ঠোঁটের দুপাশে লালা গড়িয়ে পড়ে, চোখের মণি বিস্ফারিত করে সর্বশক্তি দিয়ে সে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে—‘আব...বা...আআআ...আব...বা...আআআ।’

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ