বর্তমান বিশ্বে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত সব পক্ষের জন্যই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এ পরিস্থিতির প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নেই। স্বাভাবিকভাবেই তা বিশ্বরাজনীতি-অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সোমবার রাতেও দেশ দুটির মধ্যে ভয়াবহ পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করলেও এই কয়েক দিনের পরিস্থিতি, যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে এসেছে। একদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে একের পর এক মিসাইল নিক্ষেপ, অন্যদিকে ইরানের পাল্টা অবস্থান। তিনটি রাষ্ট্রই নিজেদের ভয়াবহ ও শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে কঠিন সংঘাতে জড়িয়েছে। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি বিভিন্ন টকশোতে বলেছি, ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিই একমাত্র বিকল্প।

আমার ধারণা সত্য প্রমাণ করে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকালে খুবই নাটকীয়ভাবে ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে একমত হয়েছে। নিশ্চয় এর নেপথ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর বহুমুখী চাপ থাকার কথা। প্রথমত, যুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন দেশের নাগরিকদের শক্ত অবস্থান, অন্যদিকে ট্রাম্পের ওপর সিনেটরদের চাপ প্রয়োগ। কেননা, তিনি ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে এভাবে জড়িয়ে পড়া নিয়ে কংগ্রেসের অনুমোদন নেননি। তাঁর এ ধরনের সিদ্ধান্ত বেআইনি। হয়তো মার্কিন প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধেও পাল্টা ব্যবস্থা নিত। দ্বিতীয়ত, ইরান যখন বাংলাদেশ সময় সোমবার রাতে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাল, সেটিও ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। কেননা, সবাই ধরে নিয়েছিল– ইরান মার্কিন কোনো ঘাঁটিতে আক্রমণ করবে না। তাতে মার্কিনিরা পাল্টা প্রতিশোধ নিতে পারে। কিন্তু ইরানের আক্রমণের ফলে পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল। কেননা, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে ধস নামতে পারে। কোনো বিদেশি পর্যটক সেখানে যেতে চাইবে না। সবকিছু এক রাতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তা ছাড়া সেখানে যে তেল সরবরাহ রয়েছে, সেটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারল, ইরান এই অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বঅর্থনীতি ভেঙে দিতে পারে। তা ছাড়া দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে ইসরায়েলের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটির পক্ষে বর্তমানের অর্থনৈতিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে সাত দিনের বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। 

এদিকে ইসরায়েলে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সামর্থ্যবান লোকজন ইসরায়েল ছেড়ে অন্যত্র জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। সুতরাং দেশটির জন্য এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
মঙ্গলবার আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়া সফর করেছেন। দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। সম্ভবত তারা ইরানকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালে দেশটির বিরূপ পরিস্থিতিতে ইরান আন্তরিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারা রাশিয়ায় অসংখ্য ড্রোন সরবরাহ করেছে। ফলে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার আগে থেকেই সুসম্পর্ক ছিল। 

এই ক’দিন আগেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, আমরা আমাদের হাইপারসনিক মিসাইল ইরানকে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ইরান এখনও নিতে রাজি হচ্ছে না। আমার ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান নিশ্চয়তা পেয়েছে। ইরান যদি হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করে তাহলে ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। কেননা, তাদের অভ্যন্তরীণ ইন্টারসেকশন ক্ষমতা কমে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ইরানের বহু লঞ্চার ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দাবি করেছে। সুতরাং দুই পক্ষের জন্য এ রকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কেননা, প্রতিটি মিসাইলের পেছনে ব্যয় কয়েক মিলিয়ন ডলার। হাইপারসনিক মিসাইলের দাম আরও বেশি। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য এগুলো লাভজনক। কিন্তু সরকারের জন্য অর্থনীতি উপেক্ষা করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন সিদ্ধান্ত। 


সুতরাং, উভয় পক্ষ যদি মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি মেনে না নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেত, তাহলে হয়তো এক সপ্তাহের বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। কারণ দুই দেশের অর্থনীতিতেই বড় ধরনের ধস নামত। তবে ইরান বিশাল দেশ হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে। সেই দেশে মৃত্যুবরণ করা মানে শহীদ হওয়া। ইসরায়েলে একটা মৃত্যু মানে জীবনহানি, যা তাদের পক্ষে সহ্য করা এখন কঠিন। সবকিছু মিলিয়ে যুদ্ধবিরতি অনিবার্য ছিল। যুদ্ধকালেও অনেকে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন, যা সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিভিন্নভাবে এসেছে। আমার ধারণা, এখনও কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে ট্রাম্প দুই পক্ষকে চাপ দেবেন, যাতে দেশ দুটি যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। 

এরই মধ্যে ইরানে কয়েকটি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরানিদের মধ্যে ব্যাপক পরিসরে একাত্মতা। তাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। এখন তাদের সেই মোহ ভেঙে গেছে। দেশটি ইসলামী শাসনাধীন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই– তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্য জাতিগুলোর মধ্যে একটি। তাদের নৈতিকতাবোধ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক উন্নত। তারা যেটা বলে, সেটি করতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ থাকে। সেদিক থেকে ইরানি জাতির মধ্যে একটি শক্তিশালী সংহতি গড়ে উঠেছে। তারপর ইরান এখন পারমাণবিক অস্ত্রায়নের দিকে এগোলে ইসরায়েল কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বাধা দিতে পারবে না। ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বৈধতা হারিয়েছে। আমার মনে হয় না, ইসরায়েল আর কখনও এ ব্যাপারে সাহস পাবে। 

মধ্যপ্রাচ্যের আগামী দিনের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগবে। আমরা আশা করি, যুদ্ধ অচিরেই পুরোপুরি থেমে যাবে। যদি তা না হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে যাবে। মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। আর বিশ্ববাসী এখন যুদ্ধ চায় না। সব পক্ষই ইসরায়েল-আমেরিকার ওপর চাপ দেবে। 
আমার মনে হয়, নেতানিয়াহুর শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘনিয়ে আসছে। শিগগিরই ইসরায়েলের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে নেতানিয়াহু অচিরেই ক্ষমতাও হারাতে পারেন।

 এম শাহীদুজ্জামান: নিরাপত্তা বিশ্লেষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক 
বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র ন ইসর য় ল পর স থ ত দ শট র র জন য ধরন র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা

রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় আজ হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে আকাশ থাকবে আংশিক মেঘলা। বাতাসের প্রবাহও থাকতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দিনের তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বুধবার সকাল ৭টা থেকে পরবর্তী ৬ ঘণ্টার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।

পূর্বাভাসে আরও জানানো হয়েছে, আজ সকাল ৬টায় রাজধানীর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর আর্দ্রতা ছিল ৮২ শতাংশ। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় সামান্য বৃষ্টিপাত (ট্রেস) রেকর্ড করা হয়েছে।

অন্যদিকে, আজ তিন বিভাগে মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারা দেশে বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ