খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দারের অপসারণের দাবিকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা একাধিক নেতা প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যেই এক পক্ষ কেএমপি সদর দপ্তর ঘেরাও করে টানা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য পক্ষ বলছে, আন্দোলনের উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ায় তারা সরে এসেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার বিকেল চারটার দিকে কেএমপির সদর দপ্তরের সামনে সড়কে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তাঁরা রাস্তার দুই পাশ বন্ধ করে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তাঁরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের নেতা–কর্মী, ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মীরা।

বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন, ‘পুলিশ কমিশনারের চামড়া, তুলে নেব আমরা’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘পুলিশ কমিশনার জুলফিকার, আস্ত একটা স্বৈরাচার’, ‘জুলফিকারের চামড়া তুলে নেব আমরা’, ‘পুলিশ কমিশনার জুলফিকার, এই মুহূর্তে খুলনা ছাড়’, ‘পুলিশ লীগের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি।

বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দারসহ কয়েকজন কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই সুকান্তকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁরা খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক হওয়ার পেছনে দায় এবং অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়ায় অভিযোগ তুলছেন পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে।

গত বুধবার শুরু হয়ে টানা দুই দিনের বিক্ষোভ শেষে বৃহস্পতিবার রাতে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন আন্দোলনকারীরা। আলটিমেটামের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর শনিবার থেকেই আন্দোলনকারীরা আবার কেএমপি সদর দপ্তরের সামনে অবস্থান নেন। তাঁরা রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দেন। ওই দিন সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের খুলনা প্রেসক্লাবে আসার খবর পেয়ে কেএমপির সদর দপ্তরের সামনে কর্মসূচিতে থাকা আন্দোলনকারীরা প্রেসক্লাবের প্রধান ফটক আটকে অবস্থান নেন। পরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রেস সচিব। এরপর রাতে পুলিশ কমিশনারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ না করা হলে আটটি থানা, উত্তর–দক্ষিণের উপকমিশনারের কার্যালয় ও সদর দপ্তর ঘেরাও করে খুলনা অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনের নেতারা।

আজ বিক্ষোভ চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে আমরা রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছি। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন খুলনার আপামর জনতার আন্দোলন। খুলনার মানুষ নিরাপত্তাহীনতা থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। এখানে কোনো ব্যক্তির ডাকে আন্দোলন হয়নি।’

আরও পড়ুনকেএমপি কমিশনারকে না সরালে খুলনা অচলের হুঁশিয়ারি২৮ জুন ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্য পক্ষের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা পুলিশ কমিশনারের দালালি করছে, তাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে দিতে চাই, আপনার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্তিগত জায়গায় রাখুন। খুলনার মানুষের দাবি উপেক্ষা করলে তার পরিণাম ভালো হবে না। আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাইলে জনগণ দাঁত ভাঙা জবাব দেবে। ঢাকায় বসে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, মিটিং করবেন, আঁতাত করবেন, কত টাকার বিনিময়ে এখানে রাখবেন, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন খুলনায় হবে না।’

এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নেতারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই আন্দোলন হচ্ছে না। তারপরও সংগঠনের জেলা আহ্বায়ক, সদস্যসচিব, যুগ্ম সংগঠক, মহানগরের সদস্যসচিব, মুখপাত্র ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক—সবাই একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে আছেন। কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্তে এই আন্দোলনের কোনো পরিবর্তন হবে না।

এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সমমনা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন, জুলাই আন্দোলনের গুটিকয়েক সহযোদ্ধাকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ মহল আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে। আজ দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে এ অভিযোগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বা নামানোর জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করিনি। এসআই সুকান্তকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় আমরা আন্দোলন থেকে সরে আসি। তবে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এখনো আমাদের গুটিকয়েক সহযোদ্ধাকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ মহল উক্ত আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে যার দায়ভার কোনোভাবেই জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরা গ্রহণ করবেন না।’

জুলাই মাস উপলক্ষে ৩৬ দিনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর আহ্বায়ক আল শাহরিয়ার, জেলা কমিটির মুখপাত্র মিরাজুল ইসলাম, জাস্টিস ফর জুলাইর বিভাগীয় প্রতিনিধি সাইফ নেওয়াজ, জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্সের জাহিদুল ইসলাম, আপ বাংলাদেশ-এর ফয়জুল্লাহ ইকবাল, ইনকিলাব মঞ্চ, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের (পুসাব) প্রতিনিধিসহ আরও অনেকে।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর আহ্বায়ক আল শাহরিয়ার বলেন, অভ্যুত্থানে যে অবিচার হয়েছে, আইনি মাধ্যমে তার বিচার হবে। কোনোভাবে মব তৈরি করে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্পর্ক নেই। কেউ ব্যক্তিগতভাবে করলে তার দায় তাঁকেই নিতে হবে।

আরও পড়ুনকেএমপি কমিশনারকে সরাতে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা, খুলনা অচলের হুঁশিয়ারি২৬ জুন ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: করব ন ক এমপ

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পুতিনকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে না

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০২৩ সালের মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সে সময় পুতিনকে একজন ‘যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ন্যায়সংগত। তবে যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য কোনো দেশ নয়।

২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, ওই সংবিধির আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কখনো ওই চুক্তিকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করার জন্য অনুসমর্থনের জন্য পদক্ষেপ নেয়নি।

বিল ক্লিনটন রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরের দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের সম্পৃক্ততার অবসান ঘটান। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।

সে কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কার্যকারিতা আমেরিকার মাটিতে নেই।

এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে আইসিসির প্রতি বৈরিতা করছে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত এই আদালতের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, এমন অভিযোগের তদন্ত করায় আইসিসির ওই সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেয় ট্রাম্প প্রশাসন।

আইসিসির এখতিয়ারের এই ঘাটতিই পুতিনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আজকের বৈঠকের স্থান হিসেবে আলাস্কাকে বেছে নেওয়ার একটি কারণ হতে পারে।

অবশ্য আইসিসির স্বাক্ষরকারী দেশ মঙ্গোলিয়ায় ২০২৩ সালের আগস্টে সফর করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সে সময় তাঁকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের অনুরোধ করা হলেও তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল দেশটি। সে জন্য মঙ্গোলিয়াকে কোনো পরিণতি ভোগ করতে হয়নি।

শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইন কেবল ততটাই কার্যকর হয়, যতটা দেশগুলোর সরকার এবং তাদের নেতারা কার্যকর করতে চান। আর এই ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং এই সাক্ষাৎ তাঁর পছন্দ মতো করতে তাঁকে আটকানোর মতো কিছুই নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ