পি চিদাম্বরম ছিলেন মনমোহন সিংয়ের অর্থমন্ত্রী। হিন্দুত্ববাদের কট্টর সমালোচক; কিন্তু চিদাম্বরমের ‘ডেভেলপমেন্ট’ (উন্নয়ন) ছিল হাসিনার উন্নয়ন দশকের মতো। একদিকে ভারতে বিএমডব্লিউ বাড়ছে, পাঁচতারা হোটেল বাড়ছে, আরেক দিকে কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে। জিডিপি বাড়ছে, আবার গরিব মানুষের ক্ষুধা আর বিপন্নতাও বাড়ছে। ঝাড়খন্ড আর ছত্তিশগড়ের হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি কেড়ে নিয়ে উপহার দেওয়া হলো বক্সাইট কোম্পানিগুলোকে। ২০১২ সালে অরুন্ধতী রায় লিখেছিলেন, ‘মিস্টার চিদাম্বরমস ওয়ার’। রায় বললেন, অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম ভারতের কৃষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। 

তত দিনে বিজেপির উত্থান ঘটেছে। ‘সেক্যুলার’ কংগ্রেসের অত্যাচারে কৃষক অতিষ্ঠ। বিজেপির সামনে সহজ টার্গেট। বিজেপি বলল, সেক্যুলার মানেই হিন্দুর শত্রু, গরিবের শত্রু। আর বিজেপি হলো ভারতের নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি। বিজেপির ভোট বাড়ল। 

১০ বছর পর পি চিদাম্বরম বই লিখলেন সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্র নিয়ে। মুসলমান নিধনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। কিন্তু কৃষক-মারা চিদাম্বরমের এই সেক্যুলারিজমের ওপর মানুষের ভক্তি উঠে গেছে। তত দিনে ভারতের ভুখানাঙা নিম্নবর্গের পরিচয়হীন মানুষকে পরিচয় দিয়েছে মোদির হিন্দুত্ববাদ। হাড়ভাঙা কোটি কোটি মানুষকে বোঝানো গেছে, হিন্দুর যুদ্ধটা আসলে মাফিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নয়, আদানি–আম্বানির রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখলের বিরুদ্ধে নয়, যুদ্ধটা আসলে ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে, সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে।

২.

 

২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সে এল ভারতীয় সিরিজ লেইলা। ২০৪৫ সালের হিন্দুত্ববাদী ভারতের এক শক্তিশালী নরক-কল্পকাহিনি। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র আর আর মাফিয়া টেক-কোম্পানিগুলো একসঙ্গে হয়েছে। আর সেকু৵লারদের ধরে ধরে পাঠানো হচ্ছে লেবার ক্যাম্পে। এক ধনী অভিজাত নারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে পাঠানো হয়েছে মন্ত্রীর বাড়িতে বুয়ার কাজ করতে। ঘটনাক্রমে মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। মন্ত্রীকে তিনি বলেন, তাঁর বাড়িতে সুইমিংপুল ছিল, মেয়ে দামি স্কুলে পড়ত। কী করে এমন হয়ে গেল।

মন্ত্রী উত্তর দিলেন, তোমরা যখন ‘আর্ট–কালচার’ করছিলে, ঠিক তখন সমাজের খুব গভীরে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে গেছে। তোমাদের আর্ট-কালচার, তোমাদের সেক্যুলার গ্যালারিগুলো জনগণের কাছ থেকে বহু দূরে ছিল। তোমরা কোটি কোটি মানুষের বিপণ্নতা দেখতে চাওনি।

৩. 

জুলাইয়ের প্যান্ডোরার বাক্স 

জুলাই–আগস্টজুড়ে বিচিত্র রকমের মানুষ রাস্তায় হেঁটেছেন, গুলি খেয়েছেন। জুলাইয়ের পথে পথে মেয়েরা ছিলেন, বৈষম্যবিরোধীরা ছিলেন, বাম-ডান-উত্তর-দক্ষিণ সবাই ছিলেন। কালো বোরকা ছিল, লাল টিপ ছিল। শাপলা ছিল, শাহবাগ ছিল। হিজাব ছিল, শাড়ি ছিল, জিনস ছিল, সাদা জোব্বা ছিল। মামা হালিমের দোকানি ছিলেন, চুল স্পাইক করা টিকটকার ছিলেন। গাজীপুরে ছিলেন কারখানার শ্রমিক, মিরপুরে ছিল যুবদল, যাত্রাবাড়ীতে শিবির কর্মী। মোহাম্মদপুর-বছিলার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন চাকরিজীবী, অটোওয়ালা আর শ্রমিক। রামপুরা-উত্তরায় ছিল আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। 

আর ছিল আমাদের আম্মুরা। কী ভীষণ মমতায় পথে পথে পানির বোতল নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। 

জুলাই সবার ছিল। ছররা গুলির সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কাউকে অপর করেনি। 

অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে গেল। ক্রোধ, বিদ্বেষ আর বিভক্তির দগদগে ক্ষত। জুলাইয়ের দলগুলো এখন ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চায় একে অপরকে। বহু প্রশ্ন, বহু তত্ত্ব, বহু মতবাদ। তত্ত্বের বিপরীতে তত্ত্ব, ক্রিটিক ও পাল্টা ক্রিটিক, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। 

এই দেশে কি উগ্র ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে? ভারতে যেটা হিন্দুত্ববাদ—মুসলমান ঘৃণা, সেটিই কি ডানপন্থা? ডানপন্থী কারা হন, কেন হন? সমাজ থেকে ছিটকে পড়া মানুষ কি ধর্মকে আঁকড়ে ধরে উগ্রবাদী হন? নাকি এটি রাজনীতির প্লট? নাকি এর পেছনে থাকে টাকার বান্ডিল, ভোটের রাজনীতি, ‘ডিপ স্টেট’?

মাহা মির্জা: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ ন দ ত বব দ চ দ ম বরম মন ত র

এছাড়াও পড়ুন:

অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা

‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ৫ আগস্ট সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেদিন ছিল সোমবার, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপের’ এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন। বিপুল জনস্রোতের লক্ষ্য ছিল গণভবন।

সেদিন সকালেও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন ঢাকার সব প্রধান সড়কেই নেমে আসেন লাখ লাখ মানুষ। উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, শাহবাগসহ বিভিন্ন দিক থেকে আসছিলেন ছাত্র–জনতা। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও কিছু স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাত্র–জনতার মিছিলের বাধা সরিয়ে নেন। দুপুরের আগেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার নড়বড়ে হয়ে গেছে।

ছাত্র–জনতার সবার গন্তব্য ছিল গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবন। একপর্যায়ে তাঁরা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংসদ ভবনের মধ্যে ঢুকে পড়েন।

জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বেলা আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, যিনি কয়েক দিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনো পালায় না।’

গণভবনের মাঠে হাত উঁচু করে উল্লাস করেন অনেকে। কেউ কেউ গণভবন ও সংসদে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বেরিয়ে যান। সংসদ ভবনে প্রবেশ করেও উল্লাস ও আনন্দ মিছিল করেন ছাত্র–জনতা। অনেকের হাতে ছিল লাল–সবুজের জাতীয় পতাকা। বিকেল থেকে ছাত্র–জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নেন। অনেকেই কার্যালয়ের ছাদে উঠে যান।

ছাত্র–জনতার অনেকে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন গণভবন-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংসদের দেয়াল এবং বিভিন্ন স্থাপনায় লিখে, ছবি এঁকে। দেয়ালে বিভিন্ন প্রতিবাদী লিখনে উঠে আসে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলের নানা অনিয়ম ও দুঃশাসনের কথা।

জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বেলা আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, যিনি কয়েক দিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনো পালায় না।’

সেনাপ্রধান বলেন, সব হত্যাকাণ্ড ও অন্যায়ের বিচার করা হবে। এ জন্য সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের জানমাল...এবং আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি যে আপনারা আশাহত হবেন না।’ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে মানুষের আনন্দ–উল্লাস। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে সংসদ ভবন এলাকায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ