‘একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে’-এর ভিত্তিতে রাজনীতি গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়
Published: 8th, August 2025 GMT
চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা ও একটি নতুন প্রজন্ম আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমরা একাত্তরকে অতিক্রম করেছি এবং চব্বিশে পৌঁছেছি। ‘একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে’- এই বাইনারির (দুই ধারার) ওপর ভিত্তি করে তৈরি রাজনীতিকে গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়। যারা এখনো এই পুরোনো রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা দেশকে একটি অচল রাজনৈতিক কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে চায়।
আজ শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন। ‘‘’৭১ এবং ’২৪’’ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় পোস্টটি লিখেছেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতা নাহিদ ইসলাম।
পোস্টে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ লিখেছেন, ‘আমরা আগেও বলেছি—চব্বিশ হচ্ছে একাত্তরের ধারাবাহিকতা। একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার—এগুলোই চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পুনরায় ঘোষিত হয়েছে। যেখানে মুজিববাদ একাত্তরকে একটি ভারতীয় বয়ানের মধ্যে ঢুকিয়ে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে বিপন্ন করেছিল, চব্বিশ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পুনরুদ্ধার করেছে। এটা ছিল কর্তৃত্ববাদ, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ লড়াই, যা একটি গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক বাংলাদেশের প্রত্যাশায় পরিচালিত হয়েছিল।’
চব্বিশের পর নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা ও একটি নতুন প্রজন্ম আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করে নাহিদ লেখেন, ‘যাঁরা চব্বিশের লড়াইয়ে অংশ নিয়ে সেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আমরা একাত্তরকে অতিক্রম করেছি এবং চব্বিশে পৌঁছেছি। যারা এখনো ‘‘একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে” এই পুরোনো রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা দেশকে একটি অচল রাজনৈতিক কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমরা চব্বিশ থেকে একটি নতুন সূচনা চেয়েছি, যা চব্বিশের অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে।’
নাহিদ লিখেছেন, ‘রাষ্ট্র ও সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক করার জন্য মুজিববাদ এবং সব ধরনের কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করাই আমাদের দায়িত্ব। এই প্রজন্ম ইতিমধ্যেই একাত্তরকে অতিক্রম করে এসেছে। ‘‘একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে’’—এই বাইনারির ওপর ভিত্তি করে তৈরি রাজনীতিকে গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়। একাত্তর ইতিহাসে থাকবে—রাষ্ট্রের একটি ভিত্তি, সম্মানজনক একটি নীতি হিসেবে—কিন্তু সেটি আর রাজনৈতিক বৈধতার ওপর আধিপত্য করবে না। সাতচল্লিশকেও একইভাবে ঐতিহাসিক মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা হবে, কিন্তু এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কোনো হাতিয়ার হবে না। এর মানে এই নয় যে আমরা এই ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করবো না—বরং এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা আমাদের ঐতিহাসিক প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে পারি।’
‘এখন রাজনীতি হতে হবে চব্বিশের ভিত্তিতে’এখন রাজনীতি হতে হবে চব্বিশের মূল্যবোধের ভিত্তিতে—এই মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘যারা আবার একাত্তরে ফিরতে চায়, তারা চব্বিশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে। চব্বিশের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ অনেক রাজনৈতিক শক্তির জন্য ছিল একধরনের প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু সেই প্রায়শ্চিত্তের অর্থই হারিয়ে যাবে যদি তারা বা আমরা আবার পুরোনো মতাদর্শিক রাজনীতিতে ফিরে যাই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই পুরোনো বাইনারি কাঠামোর পুনরুত্থান রোধ করা আমাদের দায়িত্ব।’
চব্বিশ কখনোই প্রতিশোধের জন্য ছিল না– এমন মন্তব্য করে নাহিদ লিখেছেন, ‘যারা চব্বিশকে প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তারা এর অন্তর্নিহিত মর্মকে ভুলভাবে অনুধাবন করেছে। চব্বিশ হলো জাতীয় ঐক্য ও রিকন্সিলিয়েশনের (পুনর্মিলন) একটি ক্ষেত্র। এর চেতনা এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণে নিহিত, যা ঐকমত্য, সহমর্মিতা ও যৌথ দায়িত্বের মাধ্যমে গড়ে উঠতে হবে, প্রতিশোধের চক্রের মাধ্যমে নয়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম ন র জন ত আম দ র এই প র গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
একাত্তর না চব্বিশ—এই বিতর্ক অনাহূত
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে চব্বিশের জুলাইয়ের আন্দোলনের বিরোধ নেই। তবে অনেক মূল্য দিয়ে অর্জিত চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পর মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব বিষয়ে সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল, তা করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘লাল জুলাইয়ের কবিতা’ শিরোনামে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব মন্তব্য উঠে আসে। সাধারণ সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পীসমাজের সদস্যরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এ আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘চব্বিশ একাত্তর বাহান্ন, হারতে দেব না কখনো’।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দীন। তিনি বলেন, এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ যে আশা নিয়ে আন্দোলন করেছিল, এক বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়েছে কি? এই সরকার বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থার কোনো সংস্কারই আনতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেকার সৃষ্টির কারখানা।
এ সময় তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে জুলাই ঘোষণাপত্র কার্যকর নিয়ে সংশয়ের কথা। জুলাই আন্দোলনে মুখের অবয়ব হারানো খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে গঠিত এই সরকার। আহতদের সুচিকিৎসার ও পুনর্বাসন ছিল তাদের দায়িত্ব; কিন্তু তা হচ্ছে না। এখনই যদি আমাদের অবস্থা এমন হয়, তাহলে পরবর্তী সরকারের কাছে আমরা কী প্রত্যাশা করব।’
অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, একশ্রেণির মানুষ একাত্তর আর চব্বিশের মধ্যে বিতর্ক তৈরি করছে। এটি সম্পূর্ণ অনাহূত ও অশ্রদ্ধার প্রদর্শন। তিনি বলেন, এই সংগ্রামকে ধারণ করতে গিয়ে বিগত সংগ্রামকে ভুলে গেলে ভবিষ্যতের সংগ্রাম ২৪–এর সংগ্রামকে ভুলে যাবে। অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় আগের বক্তাদের ক্ষোভের সূত্র ধরে বলেন, ‘এক বছর পর এমন হতাশার কথা শুনতে হবে, তা ভাবিনি।’ গত এক বছরে পুলিশ কোনো গায়েবি মামলা করেনি বা গুমের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন তিনি।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান বলেন, শেখ হাসিনার আমলের ১৬ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও পরিণত হয়েছিল ক্যাডারদের সংগঠনে। তাঁরা দখলের রাজনীতি করেছেন। দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছেন। সেই সব সংস্কৃতিকর্মীই জুলাই আন্দোলনের সময় হতাহত মানুষের পক্ষ না নিয়ে সরকারকে সমর্থন করে গেছেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল সমবেত আবৃত্তি। শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন ‘লাল জুলাইয়ের কবিতা’র তিন উদ্যোক্তা আঞ্জুমান লায়না নওশিন, ফাহমিদা সূচনা ও অনন্যা মাহমুদ। গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো লাল জুলাইয়ের কবিতা মঞ্চস্থ করার সময়ের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন তাঁরা।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুক্রবার এই আয়োজন শুরু হয়। এরপর মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।