দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে: হাফিজ উদ্দিন
Published: 9th, August 2025 GMT
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। কখনো সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা, কখনো সাধারণ মানুষকে হত্যা—দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে।’
শনিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের ব্যাংকোয়েট হলে ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শহীদ জিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথাগুলো বলেন। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা এ সভার আয়োজন করে।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘একমাত্র একজন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছাড়া কেউ গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। এদের অনেকেই শেখ হাসিনার দোসর ছিল। যে কারণে শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী একই আছে। মাঝখান থেকে সুযোগ নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল—যারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কীভাবে জানি না, তাদের প্রতিনিধি বসিয়ে দিয়েছে এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে যেসব সুযোগ পাওয়া যায়, সেটি দিব্যি ব্যবহার করছে। আর আমরা বিএনপির কর্মীরা শুধু যুদ্ধ করে গেলাম, জীবন দিয়ে গেলাম, কতবার জেলে গিয়েছি তার হিসাব নাই।’
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘একাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যও সেটিই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবে—এ কথা তারা তখন চিন্তাই করেনি। স্বাধীনতার পর তারা কল্পকাহিনি শুরু করল যে অনেক আগে থেকেই তারা স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল। বাংলাদেশের ছাত্র, জনতা, যুবক, শ্রমিকদের বীরত্বের কাহিনি আওয়ামী লীগের আমলে জনগণকে জানতে দেওয়া হয়নি।’
একাত্তরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এ জাতি চিনল না—এটা দুঃখের বিষয়। অধিকাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন লুঙ্গি পরা, খালি পায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখলাম ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মহানগরের ছেলেরা সব মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় রাজনৈতিক দলগুলো আলোতে আসার সুযোগ দেয়নি।’
জামায়াতের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া নিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘তারা নির্বাচন চায় না। তারা তো অলরেডি ক্ষমতা ভোগ করছে। নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তারা বলে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন। এই দেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে ভোট দিয়ে আসছে একজন প্রতিনিধিকে—এলাকার মানুষের আপদ-বিপদে যাঁকে পাওয়া যায়। যিনি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, এমন মানুষকেই ভোট দেয়। কিন্তু তারা মনে করে আগামী দিনে তো আমরা ক্ষমতায় যেতে পারব না, বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। সুতরাং বিএনপি যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে, এ জন্যই তারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। বাংলাদেশের জনগণ পিআর সিস্টেম বোঝে না, তারা পছন্দের ব্যক্তিকে দেখতে চায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে।’
আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইসতিয়াক আজিজ উলফাত। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ধ নত ব এনপ র ক ষমত য
এছাড়াও পড়ুন:
ন্যায়বিচার নেই, কারণ কাঠামোটাই বৈষম্যমূলক
নয়া উদারনৈতিক দুনিয়ায় আদর্শ রাষ্ট্র বা ন্যায্য শাসনব্যবস্থার প্রধান কয়েকটি বুলি হচ্ছে ‘আইনের শাসন’, ‘মানবাধিকার’ ও ‘গণতন্ত্র’। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ত্রাণসহায়তা ও বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত আইনের শাসন। এমনকি রাশিয়া, চীন প্রভৃতি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দেশগুলোও আইনের শাসনের পক্ষে কথা বলে। বস্তুত যেকোনো সরকারের বৈধতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি আইনের শাসন।
কিন্তু আইনের শাসন আসলে কী? সহজভাবে বললে ব্যাপারটা এই যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন বা আইনের অধীন। শাসনকার্য পরিচালিত হবে শুধু আইনমাফিক, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, আইনের অনুমোদন ছাড়া কারও অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না, সবাই আইনের সমান সুরক্ষা পাবে ইত্যাদি।
এখানে আইনের শাসন প্রধানত কিছু পদ্ধতি নির্দেশ করে। আইন কীভাবে তৈরি হবে (গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে), তার উপাদানগুলো কী হবে (মৌলিক অধিকার, ন্যায্যতা, সমতা, ন্যায়বিচার থাকবে কি না)—এসব বিষয়ে কিছু বলে না। এই ধারণায় চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারও দাবি করতে পারে যে সে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে; কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে সে স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকেও আইনসিদ্ধ করে নিতে পারে।
আইনের শাসনের সবচেয়ে সমাদৃত ধারণায় বলা হয়, আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামোর পাশাপাশি আইন প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় জনগণের সম্মতি বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এখানে আইনসিদ্ধতার পাশাপাশি বৈধতার ধারণা গুরুত্ব পায়। আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামো ছাড়া গণতন্ত্র বর্মহীন; কারণ, নির্বাহী বিভাগ আইনের পরিধি নিজের ইচ্ছেমতো কমাতে-বাড়াতে পারে। একইভাবে গণতন্ত্র ছাড়াও আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামো বৈধতার সংকটে পড়ে। এখানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেবল প্রত্যক্ষ আইনের উপাদান নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার বৃহত্তর পটভূমি হিসেবে বিবেচিত হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও তার জুডিশিয়াল রিভিউর ক্ষমতা হবে ভারসাম্যের কেন্দ্র। প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগকে এখানে সালিসকার হিসেবে কাজ করার কর্তৃত্ব দেওয়া থাকে।
আইনের শাসনের এই ধারণার সারমর্ম দাঁড়ায়—আইনের শাসনে রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা আইন-নির্ধারিত আওতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মৌলিক অধিকার অনুযায়ী এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতের অধীন কাজ করবে। আইন প্রণীত হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী প্রক্রিয়ায়; মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোনো আইন প্রণীত হবে না। আইন প্রয়োগকারীদের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল রিভিউর সুরক্ষা থাকবে; ক্ষমতার পৃথক্করণ, মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নিরপেক্ষ আদালতে সহজ, দ্রুততর ও হয়রানিমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। সর্বোপরি নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশেও আইনের শাসনের এসব নীতিমালা গৃহীত হয়েছে, পাঁচ দশকের সব শাসকই মুখে মুখে তা প্রতিষ্ঠার কথা বলে এসেছেন। কিন্তু এই আইনের শাসন আসলে আমাদের জন্য কী বয়ে এনেছে আর কী আনতে যাচ্ছে?
২
বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন করা হয় জাতীয় সংসদে, জনগণের নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধি’দের মাধ্যমে। এটা আইন প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মাত্র। আসলে আমাদের আইন প্রণীত হয় সচিবালয়ে, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের প্রযোজনায়। আইনের খসড়া তৈরি করেন আমলারা। ফলে দণ্ডবিধিতে সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও প্রতিটি আইনে আমলাদের জন্য ‘সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের’ জন্য দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়। খসড়া তৈরিতে সাহায্য করেন ক্ষমতাসীন দলের অনুগত শিক্ষক-পরামর্শক-বুদ্ধিজীবীরা।
বিলের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে যায়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন মানেই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন। তারপর প্রধানত কারিগরি ত্রুটিবিচ্যুতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সংসদে যেতে পারে আইন হিসেবে পাস হওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা সংসদে পাস না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। সংসদের মোট সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ। ২০-৩০ মিনিটেই একটা বিল পাস হয়ে যায়। সেখানে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কেবলই ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত’ হয়।
জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকলে বা সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যেহেতু ক্ষমতাহীন, তাঁর নামে এই ক্ষমতাও চর্চা করেন প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের সংসদে তা অনুমোদিত হয়। সংসদে গৃহীত আইনের প্রায়োগিক নীতিমালার জন্য প্রণীত হয় বিধি বা প্রবিধিমালা। এগুলো পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক প্রযোজনা। অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়, জনপরিসরে বিভিন্ন তর্কবিতর্ক ওঠে, কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় সেসবের কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।
মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে রায়প্রত্যাশী অনেকে হয়রানির শিকার হন