প্রতিদিন লুট হচ্ছে পাথর। সিলেটের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য পাথররাজ্য ‘সাদা পাথরে’ এখন আর তেমন পাথর নেই। সবার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এই অমূল্য উপহার। এক বছর আগেও যেখানে ছিল পাথরের স্তূপ, সেখানে এখন ধুধু বালুর মাঠ। দিন-রাত শত শত নৌকা দিয়ে প্রকাশ্যে পাথর লুট করা হলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। একাধিকবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

টাকার অঙ্কে নির্দিষ্ট করে লুটের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টদের অনুমান প্রতিদিন কোটি টাকার পাথর লুট হচ্ছে। অভিযোগ আছে, পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্পৃক্তায় দিন-রাত লুট হচ্ছে পাথর। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এ লুটপাট চলছে। এজন্য প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পাথর লুট শুরু হয়। এখনো পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটপাটের মচ্ছব চলছে। বাদ যাচ্ছে না ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও। সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালানো হয়েছে ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে। নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে রোপওয়ে।

ধলাই নদীর তলদেশেও আছে পাথরের বিপুল মজুদ। এ পাথর দিয়ে ৫০ বছর চালানো যাবে, এই হিসাব ধরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সোয়া ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব-স্টেশন। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনি, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ আছে। সেই থেকে অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়েছিল ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা। রোপওয়ের আয়তন প্রায় ১০০ একর।

একসময় ভোলাগঞ্জ এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো ছিল। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্ল্যান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদীর সাথে। 

২০১৭ সালে দেশজুড়ে পরিচিতি পায় পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর। ওই বছর পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদের উৎসমুখে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে পাথরের বিশাল স্তূপ জমা হয়, যা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর আরও কয়েক দফায় পাহাড়ি ঢল নেমে এখানে পাথরের একটি আস্তরণ পড়ে। সেই পাথরের বিছানার ওপর দিয়ে স্বচ্ছ পানির ছুটে চলার দৃশ্য পর্যটকদের নজর কাড়ে। সেই থেকে সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে সব মৌসুমে পর্যটকদের ভিড় লেগইে থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাদা পাথর নামের এই পর্যটন কেন্দ্রের জিরো লাইনে দিন-রাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল আর টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করছেন। হাজার হাজার বারকি নৌকায় সেসব পাথর বহন করে এনে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করছেন তারা। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান সেসব পাথর। 

দুই-তিন মাস আগের চিত্রের সঙ্গে কোনো মিল নেই বর্তমান সাদা পাথর এলাকার। বড় আকারের পাথর এরইমধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। এখন পর্যটন কেন্দ্রের মাটি খুড়তে শুরু করেছেন পাথরখেকোরা। এতে কিছু দিনের মধ্যে পাথরশূন্য হয়ে পড়বে এ স্থানটি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাথর লুটের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতারা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পুরো ‘পাথর রাজ্য’ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরাও এই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে বিজিবি ও পুলিশের চাঁদা তোলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। মাঝে-মধ্যে নামমাত্র অভিযান হলেও পরে থেমে যায়।

রফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আগে নৌকাপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হতো। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করা হতো আরো ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। পাথর উত্তোলনকারীরা প্রতি নৌকা পাথর বিক্রি করতেন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়। এখন সেই সিস্টেমে পরিবর্তন এসেছে। এখন পাথর যে কেউ তুলতে পারে, তবে বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। অন্যথায়, সেই পাথর কেউ কিনবে না। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেছেন, “প্রশাসনকে আমি সাদা পাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলব না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করত। সাদা পাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনো কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদা পাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ, এক বছর আগেও সাদা পাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।”

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ভূমি সন্তান বাংলাদেশ’-এর সংগঠক শুয়াইবুল ইসলাম জানিয়েছেন, জাফলং কিংবা সাদা পাথর, সবখানে সমানতালে লুটপাট করছে সংঘবদ্ধ চক্র। প্রশাসন কঠোর হলে এই লুটপাট ঠেকানো যেত। প্রকৃতিকে কীভাবে গিলে খাচ্ছে অসাধু চক্র, তা দেখতে চাইলে সাদা পাথর ঘুরে আসা যায়। আমরা মনে করি, প্রশাসন কঠোর না হলে যতই চিল্লাচিল্লি করি, কোনো কাজে আসবে না।

সাদ পাথর লুটপাটের বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেছেন, “আমরা ডিসি অফিসে কথা বলেছি। আশা করছি, খুব দ্রুত, হয়তো এ সপ্তাহের মধ্যে আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান হবে। আগেরবার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।”  

এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান বলেছেন, “পাথর উত্তোলনের খবর পেলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্পেশাল টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। পুলিশ তাতে সহযোগিতা করে। পুলিশের পক্ষে একা এটি ঠেকানো সম্ভব নয়।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক মো.

ফেরদৌস আনোয়ার বলেছেন, ‘সাদা পাথর ইসিএ-ভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবু, আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।”

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, “সাদা পাথর রক্ষার্থে আমরা তো নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু, কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।” 

আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না, প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেন যে, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।”

ঢাকা/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রকল প ল টপ ট পর ব শ বল ছ ন করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের রপ্তানিতে তেমন প্রভাব পড়বে না: শেখ বশিরউদ্দীন

ভারত আরও চারটি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশের রপ্তানিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি।

শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, এমন কোনো বিষয়ে ছাড় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়নি। দুই দেশের মধ্যে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি মেটানো হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে দর–কষাকষি চালিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে ১৫ শতাংশের ব্যাপারে আশাবাদী বাংলাদেশ।

আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা থাকলেও এতটা অস্থিতিশীল নয় যে ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। তাই রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে তাতে সমস্যা হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের নতুন বিধিনিষেধের আওতায় সে দেশের ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশ থেকে চার ধরনের পাটের পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করতে পারবেন না। শুধু দেশটির মুম্বাইয়ের নভসেবা বন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ আছে। এমন বিধিনিষেধ দিয়ে গতকাল সোমবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য মহাপরিচালকের কার্যালয় (ডিজিএফটি) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে গত কয়েক মাসে কয়েক দফায় অশুল্ক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দেয় দেশটি। তার আগে ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করে দেশটি।

এদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করার এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করেছে। এর আগে বেনাপোল, ভোমরা, সোনা মসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ ছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ