সন্দেহ আর অবিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন তিনি। দেশ থেকে বহু দূরে মস্কোতে গুলি করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এর ১৯ বছর পর ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক আদালত সেই বিচারকে ভুল বলে ঘোষণা করে তাঁকে দিয়েছিলেন মরণোত্তর স্বীকৃতি। তিনি বাংলাদেশেরই এক বিপ্লবী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভুল বিচারের শিকার গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর জীবন ও সংগ্রাম যেন রোমাঞ্চ কাহিনিকেও হার মানায়। সিরাজগঞ্জে ১৮৯২ সালের ২ ডিসেম্বরে জন্ম লুহানীর। তিনি ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন করেন এবং ১৯১৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সোভিয়েত বিপ্লবে প্রভাবিত হন। প্যারিস, বার্লিন, জেনেভা ও মস্কোতে ভারতের মুক্তির জন্য কাজ করেন। স্তালিনের শাসনামলে তিনি মস্কোতে কাজ করছিলেন। সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বহু ঘটনা রয়েছে বিপ্লবী লুহানীর জীবনে। সেই কাহিনি তুলে আনার ঘটনাপ্রবাহও সত্যানুসন্ধানী গোয়েন্দা কাহিনির চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। দীর্ঘ ৪২ বছরের অভিনিবেশ ও নিষ্ঠায় এ অনুসন্ধান করেছেন মতিউর রহমান। সংগত কারণেই বহুজনের বহু রকমের সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে। সেসব নিয়ে ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী, এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি।
মতিউর রহমানেরই আরেকটি বই লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গঠন সংগ্রাম ১৯৪৭-১৯৭১। এই দুটি বই নিয়ে আজ শনিবার এক মনোজ্ঞ আলোচনার আয়োজন ছিল ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে।
‘আলাপে বিস্তারে’ নামে এই আলাপচারিতার সূচনা করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী জানালেন ২০১৭ সাল থেকে তাঁরা বিভিন্ন প্রকাশনীর বিশেষ বিশেষ বই নিয়ে লেখক, বিদগ্ধ আলোচক ও গ্রন্থানুরাগীদের নিয়ে এই আলাপের আয়োজন শুরু করেন। এবার মতিউর রহমানের দুটি বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
মতিউর রহমান দেশের শীর্ষ বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবেই সমধিক পরিচিত হলেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। তবে সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে পড়ে গেছে তাঁর লেখক পরিচয়। এই বই দুটি তাঁর লেখক সত্তা ও নিষ্ঠা বিশেষভাবে তুলে ধরবে।
বই দুটি প্রসঙ্গে মতিউর রহমান বলেন, লাল সালাম বইটিতে তিনটি পর্ব আছে। শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম যুগের ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে আছে পার্টির প্রামাণ্য নথিপত্র। বিশেষত তৃতীয় পর্বে যেসব প্রামাণিক নিদর্শন তিনি সংগ্রহ ও সংযুক্ত করেছেন, তা অনেকের কাছেই নেই। সে কারণে পরবর্তী সময়ে গবেষক ও অনুসন্ধানী পার্টি কর্মীদের এই বইটি প্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে।
বিপ্লবী লুহানীর কাহিনি খুবই আকর্ষণীয়। লুহানী সম্পর্কে তিনি প্রথম জানতে পারেন ১৯৮১ সালে দিল্লি সফরের সময় বিজ্ঞানী ও ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গাধর অধিকারীর কাছে। তখন থেকেই অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন মতিউর রহমান। ঘর ভরা শ্রোতাদের তিনি সেই অনুসন্ধানের কাহিনি শুনিয়েছেন। সেসব কথার সঙ্গে বলেছেন নিজের ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ততার কথা। ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার প্রকাশনা, একুশের সংকলনের কাজের মাধ্যমে দেশের সব সেরা শিল্পী সাহিত্যিক, অভিনেতা, সংগীতজ্ঞের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বহু টুকরো টুকরো স্মৃতির ছবি ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তুলে এনেছেন উনসত্তরের অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ অবধি বহুবিধ বিষয়।
বই নিয়ে আলোচনায় প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রধানত দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন বিপ্লবী লুহানীর প্রতি। তিনি বলেন, ‘এই বইটির অনেক মাত্রা আছে। তখন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে। সফল হয়েছে সোভিয়েত বিপ্লব। এমন পরিবেশে আমাদের দেশের বিপ্লবীদের মনে অনেক স্বপ্ন ছিল। দেশকে উপনিবেশ মুক্ত করার জন্য তাঁরা অনেকে অনেক রকম কাজ করেছেন। সেসবের অনেক কিছুই আমরা জানি না। আমরা আসলে খুবই কম জানি। এ ধরনের অনুসন্ধানী বই আমাদের জানার পরিধি বিস্তৃত করে।’
মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টের সভাপতি শেখর দত্ত বলেন, বই দুটি দীর্ঘদিনের সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিতভাবে লিখিত এবং যত্নের সঙ্গে প্রকাশিত। দুটি বইয়ের একটি অন্যটির পরিপূরক। একটি কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস আর অন্যটি একজন বিপ্লবীর কঠিন জীবন ও করুণ আত্মদানের ঘটনা। বই দুটি পাঠককে ভাবিত করবে।
বই দুটি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা। বেঙ্গল শিল্পালয়, ধানমন্ডি, ঢাকা। ২০ সেপ্টেম্বর.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন সন ধ ন বই ন য় বই দ ট প রক শ প রথম র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
অ্যান্টার্কটিকায় সাগরের তলদেশে মাছের ভিন্ন আবাসস্থলের খোঁজ
অ্যান্টার্কটিকার পশ্চিম ওয়েডেল সাগরে ১ হাজারের বেশি মাছের আবাসস্থল খুঁজে পেয়েছে একটি ডুবো রোবট। সমুদ্রের তলদেশে থাকা আবাসস্থলটি বিক্ষিপ্ত অবস্থার বদলে সুস্পষ্ট নকশায় সজ্জিত। অ্যান্টার্কটিকার লারসেন সি আইস শেলফ বা বরফের স্তর থেকে বিশাল আইসবার্গ ভেঙে যাওয়ার পর উন্মোচিত হওয়া আবাসস্থলটি বহু দশক ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সুসংগঠিত প্রজননক্ষেত্রের দিকে ইঙ্গিত করছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা ২৭ ঘণ্টার সমুদ্র তলদেশের ভিডিও বিশ্লেষণ করে মাছের আবাসস্থলের মানচিত্র তৈরি করেছেন। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের বিজ্ঞানী রাসেল বি কনেলি বলেন, এই অভিযানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে ছয়টি স্বতন্ত্র জ্যামিতিক বাসার নকশার খোঁজ। রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেলের মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিক মাছের বাসার খোঁজ পাওয়া গেছে। রোবটের চোখে বক্ররেখা, রেখা, গুচ্ছ, ডিম্বাকৃতি, ইউ আকৃতি ও বিচ্ছিন্ন এককভাবে গোষ্ঠীভুক্ত বাসার অবস্থার চিত্র ধারণ করা হয়েছে। অ্যান্টার্কটিকার সাগরে এমন বাসার বিন্যাস মাছের সেলফিশ হার্ড বা স্বার্থপরভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায়। এই ধারণা অনুসারে শিকারি প্রাণীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে প্রাণীরা তাদের প্রতিবেশী প্রাণীদের নিজেদের ও শিকারিদের মাঝে রাখে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে এ৬৭ আইসবার্গ লারসেন সি থেকে ভেঙে যায়। তখন বরফ ঢাকা এলাকায় গবেষণা শুরু হয়। বরফের খণ্ডটি প্রায় ২২৪০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিল। বরফখণ্ড ভেসে যাওয়ার পরে সমুদ্রের তলদেশের বাসস্থানের তথ্য জানা যায়। ২০১৯ সালের ওয়েডেল সাগর অভিযানের সময় প্রকৌশলীরা এসএ আগুলহাস ২ জাহাজ থেকে রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল পরিচালনা করে। রোবটে একটি ক্যামেরা ও লেজার আছে। রোবটের মাধ্যমে দেখা যায়, খোঁজ পাওয়া বাসা আসলে ইয়েলোফিন নোটি প্রজাতির। এই ছোট মাছ মেরু অঞ্চলের পানিতে পাওয়া যায়।
কমিশন ফর দ্য কনজারভেশন অব অ্যান্টার্কটিক মেরিন লিভিং রিসোর্সেস ওয়েডেল সি এমপিএ বা মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছে। পুরো গবেষণার ফলাফল ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেরিন সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
সূত্র: আর্থ