ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ার লমি হাজারী বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। আছে ছাউনি। স্থানীয় কয়েকজন সেখানে গোসল করছিলেন। পাশের মাঠে একজন ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলেন। আরেকজন বিক্রি করছেন পেয়ারা ও জাম্বুরামাখা। এখানে এমন দৃশ্য ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে ছিল কল্পনাতীত।

যে পুকুরঘাটের কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল ফেনী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারীর ‘ঘাটলা’। এখানে বসে ঠিকাদারি কাজ বণ্টন, বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজির হিসাব, দলীয় ও স্থানীয় বিবাদ মীমাংসাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি–পেশার মানুষকে এই ঘাটলায় হাজিরা দিতে হতো। স্থানীয়ভাবে বলা হতো ‘ঘাটলার শাসন’।

পুকুরঘাটের পাশে সাততলা বাড়িটি নিজাম হাজারীর। এর একাংশ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেকের মতো নিজাম হাজারীও পালিয়ে যান। ওই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা এই বাড়িসহ কাছাকাছি নিজামের আরও দুটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাড়ির গ‍্যারেজে পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। এসব বাড়ি পেরিয়ে কিছু দূর এগোলে দেখা মেলে নিজাম হাজারীর আরেকটি বাড়ি। প্রাচীরঘেরা প্রায় সাড়ে চার একর জমির ওপর তৈরি তিনতলা বাড়িটি স্থাপত্যশৈলী, বিলাসবহুল সামগ্রী, লেক, বাগান ইত্যাদি কারণে ফেনীর মানুষের কাছে বেশ আলোচিত।

গত বছরের ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িটি এখন জনমানবশূন্য। অথচ এই বাড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ প্রভাবশালী অনেকের যাতায়াত ছিল।

আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ফেনীতে এককভাবে ‘রাজত্ব’ করেছেন নিজাম হাজারী। মাস্টারপাড়ার পুকুরের ‘ঘাটলা’ থেকে নিজাম হাজারী অবৈধ উপার্জনের যে খাতগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর মধ্যে বাস, ট্রাক, টেম্পোস্ট্যান্ড, সরকারি নানা দপ্তরের দরপত্র, বালুমহাল, সীমান্তকেন্দ্রিক কালোবাজারি, মামলা–বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য।

স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নিজাম হাজারী দলবল নিয়ে পালিয়েছেন। তাঁর সেই ঘাটলা এখন অনেকটা বিএনপির নেতাদের ঘরে ঘরে। এখানে বিএনপির কারও একক নিয়ন্ত্রণ নেই, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত দলটির নেতা–কর্মীরা। এর মধ্যে জেলাভিত্তিক মোটাদাগে চারটি গ্রুপ আলোচিত। তাঁদের ছায়ায় গড়ে উঠেছে কিছু উপদল। এর বাইরে উপজেলায় ছোট ছোট আরও গ্রুপ গড়ে উঠছে। জেলা বা কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ না কেউ এসব গ্রুপকে ‘মুরব্বি’ হিসেবে প্রশ্রয় দেন।

ফেনী জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি মাঈন উদ্দিন আহমেদ কামরান প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি, দখল–বাণিজ্য, হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না জনগণ। আগে আওয়ামী লীগের নেতারা করতেন, এখন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা করছেন।

কয়টি গ্রুপ, নেতা কারা

ফেনী জেলা বিএনপির শীর্ষ দুই পদে আছেন আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার ও সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন। দলীয় নেতা–কর্মী বা ক্যাডারদের ওপর তাঁদের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সব দিক রক্ষা করে চলেন।

তবে জেলা বিএনপির তিন যুগ্ম আহ্বায়কের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে প্রভাবশালী একটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিবুল্লাহ মানিক। এমন আরেকটি প্রভাবশালী গ্রুপের নেতা হচ্ছেন আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক এয়াকুব নবীও ছোট একটা গ্রুপ চালান।

আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মশিউর রহমান (বিপ্লব)। ফেনী পৌর বিএনপির সদস্যসচিব মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া ও সদর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আমান উদ্দিন কায়সার (সাব্বির) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী।

জেলা যুবদলের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন খন্দকার ও জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সালাহউদ্দিন মামুনের নেতৃত্বে দুটি উপ–গ্রুপ রয়েছে।

এর বাইরে প্রতিটি উপজেলাভিত্তিক গ্রুপ রয়েছে। যেমন পরশুরামে সীমান্তকেন্দ্রিক অবৈধ কারবার আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে সাজেল নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেসব কর্মকাণ্ড এখন বিএনপির নেতা আবদুল আলিম মাকসুদের নিয়ন্ত্রণে। মাকসুদ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু তালেবের অনুসারী। দাগনভূঞায় বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতা কাজী জামশেদুর রহমান ফটিক ও সোনাগাজীতে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম ভূঁইয়া এ রকম বিভিন্ন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানা গেছে।

কোন টার্মিনাল কার নিয়ন্ত্রণে

ফেনীর সবচেয়ে বড় বাস টার্মিনাল মহিপালে। এটি গড়ে উঠেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর। এটা ইজারা দিয়ে আসছে ফেনী পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ইজারাদার ছিলেন পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন। তবে বাস থেকে তোলা চাঁদার মূল নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজী (বর্তমানে পলাতক)। এখন এই বাস টার্মিনালের ইজারা নিয়েছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এয়াকুব নবী। এর মাধ্যমে টার্মিনালসহ মহিপালকেন্দ্রিক পরিবহন চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে।

মহিপালে মহাসড়কের দুই পাশেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বাস কোম্পানির কাউন্টার রয়েছে। এর বাইরে সড়কের পাশে বসানো হয়েছে ভাসমান কাউন্টার। এগুলো থেকে ফেনী-কুমিল্লা, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের বাস চলাচল করে। দিনে দেড় থেকে দুই হাজার বাস থামে সেখানে। শুধু স্লিপার ও এসি শ্রেণির কিছু বাস উড়ালসড়ক দিয়ে চলে যায়, মহিপাল থামে না। বাকি যেসব বাস মহিপালে থামে, প্রতিটি বাস থেকে ইজারা বাবদ নেওয়া হয় ৫০ টাকা। এর বাইরে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ ক্ষেত্রে এয়াকুব নবীর মূল সহযোগী হলেন ফেনী পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খুরশিদ আলম।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সূত্র বলছে, এই টার্মিনাল থেকে যে চাঁদা তোলা হয়, সেটার ভাগ ফেনী বিএনপির পদধারী ১৫-২০ জন নেতা পান। এর বাইরে জেলা বিএনপির অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিবুল্লাহ মানিকের বাড়ি মহিপাল বাস টার্মিনালের পাশে। সেখানে তাঁরও একটা প্রভাব রয়েছে।

দুই পাশে লেক। সামনে বিশাল বাগান। পেছনে খোলা মাঠ। ছাদে হেলিপ্যাড। বাড়িটি ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর। একসময় বাড়িটিতে আওয়ামী লীগ সরকারের বাঘা বাঘা মন্ত্রী-নেতার পদচারণ ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাড়িটি ভুতুড়ে অবস্থায় পড়ে আছে।.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ৫ আগস ট ব এনপ র ন ব এনপ উদ দ ন আওয় ম উপজ ল করত ন সদস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রায় প্রত্যাখ্যান আওয়ামী লীগের

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে দুই নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভিডিও বার্তায় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, “আজ যে রায় ঘোষণা করেছে এ রায় বাংলার জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। বাংলার জনগণ এ রায় মানে না, মানবে না।”

আরো পড়ুন:

রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বললেন শেখ হাসিনা

হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ‘অতীতের প্রতিশোধ নয়’: প্রধান কৌঁসুলি

তিনি বলেন, “অবৈধ আদালত যে মামলার রায় দিয়েছে সেটি ১৪ অগাস্ট শুরু করে ১৭ নভেম্বর মামলা শেষ করেছে। ৮৪ জন সাক্ষীকে সামনে রেখে ৫৪ জনকে হাজির করে ২০ দিনে মামলা শেষ করেছে। এই দুই মাসের মধ্যে মাত্র ২০ দিন আদালত চলেছে।”

“এর প্রধান বিচারক গত এক মাস অনুপস্থিত ছিলেন। তারপরেও প্রতিশোধের লক্ষ্য নিয়ে মানুষের প্রিয় নেত্রীর বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছে।”

জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, “অচিরেই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করব”।

এর আগে সোমবার (১৭ নভেম্বর) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ২ নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড আদেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া মামলার অন্য আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার পর ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা এটিই প্রথম মামলা, যার রায় ঘোষণা হলো আজ।

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ