Prothomalo:
2025-10-02@22:36:34 GMT

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প

Published: 1st, October 2025 GMT

আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন একবার বাইজান্টাইন সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে তোমাদের লাইব্রেরি থেকে যত বই চাও পাঠাও, আমি তাদের স্বর্ণের ওজন দিয়ে পুরস্কৃত করব।’ এই উক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বৌদ্ধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রতি গভীর অনুরাগের প্রকাশ। আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্ঞানকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

বায়তুল হিকমা কেবল একটি গ্রন্থাগার ছিল না; ছিল অনুবাদ, গবেষণা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাণকেন্দ্রও। গ্রিক, পারসি, সিরীয় ও ভারতীয় ভাষা থেকে জ্ঞান আহরণ করে আরবিতে অনুবাদ করার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল এখানে। হুনাইন ইবনে ইসহাক, আল-খওয়ারিজমি, আল-কিন্দির মতো পণ্ডিতেরা শুধু অনুবাদেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তাতে যুক্ত করেছেন নতুন আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ।

আরবিতে অনূদিত এই জ্ঞানের স্রোত পরে আন্দালুসিয়া ও সিসিলির মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসের মতো প্রতিষ্ঠান আরবিতে সংরক্ষিত গ্রিক জ্ঞানকে লাতিনে রূপান্তর করে ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতে ফিরিয়ে আনে। এই ধারার ফলেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি মজবুত হয়।

আরবিতে অনূদিত এই জ্ঞানের স্রোত পরে আন্দালুসিয়া ও সিসিলির মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসের মতো প্রতিষ্ঠান আরবিতে সংরক্ষিত গ্রিক জ্ঞানকে লাতিনে রূপান্তর করে ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতে ফিরিয়ে আনে। এই ধারার ফলেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি মজবুত হয়। অ্যারিস্টটলের দর্শন, ইউক্লিডের জ্যামিতি, গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা পটোলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান—সবই মুসলিম অনুবাদ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ইউরোপে আবারও প্রবেশ করে। ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেবরা আধুনিক গণিতের ভিত রচনা করেছে। আল-বাতানির জ্যোতির্বিজ্ঞান কপার্নিকাসের চিন্তাকে প্রস্তুত করেছে, আর আল-জাজিরির যান্ত্রিক প্রকৌশল ইউরোপের প্রযুক্তি বিকাশে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল আক্রমণে বাগদাদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বায়তুল হিকমার অবসান হলেও তার উত্তরাধিকার টিকে গেছে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও রেনেসাঁ আন্দোলনের ভেতর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলন না হলে ইউরোপের রেনেসাঁ হয়তো অনেক দেরিতে কিংবা একেবারেই অন্যভাবে বিকশিত হতো।

এই অনুবাদ আন্দোলনের শুরু উমাইয়া খিলাফতের যুগে (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) দেখা যায়, যেখানে খলিফা মুআবিয়া প্রথম দামেস্কে গ্রিক বই সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তখন মৌলিক অনুবাদ হয়নি বললেই চলে। আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) শুরুতে, পারস্য সভ্যতার প্রভাবে সম্পদ ও জ্ঞানের প্রসার ঘটে। খলিফা আল-মানসুর (৭৫৪-৭৭৫) বাগদাদ প্রতিষ্ঠা করেন (৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং বায়তুল হিকমাকে একটি রাজকীয় লাইব্রেরি হিসেবে শুরু করেন। তার পুত্র হারুন আল-রশিদ (৭৬৩-৮০৯) এটিকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু আল-মামুনের আমলে (৮১৩-৮৩৩) এটি একটি ব্যাপক অনুবাদ ও গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হয়। আল-মামুন বাইজান্টাইন থেকে বই কিনে আনেন এবং বিদ্বানদের জন্য বিশাল তহবিল বরাদ্দ করেন। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন জ্ঞানকে ইসলামি চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন সৃষ্টি করা, যা দুই শতাব্দীর জন্য চলে। বায়তুল হিকমা আল-রুসাফায় অবস্থিত ছিল, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণালয় (যেমন মাউন্ট কাসিওন) যুক্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে অনুবাদ আন্দোলন শুরু হয়, যা গ্রিক, পারস্য, ভারতীয় ও সিরিয়াক ভাষা থেকে জ্ঞান স্থানান্তরিত করে। প্রকল্পটি শুধু অনুবাদ নয়, বরং জ্ঞানের প্রসার এবং সামাজিক উন্নয়নের একটি মাধ্যম ছিল, যা ইসলামি সমাজে সাক্ষরতা বাড়ায় এবং ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার মিলন ঘটায়।

ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেবরা আধুনিক গণিতের ভিত রচনা করেছে। আল-বাতানির জ্যোতির্বিজ্ঞান কপার্নিকাসের চিন্তাকে প্রস্তুত করেছে, আর আল-জাজিরির যান্ত্রিক প্রকৌশল ইউরোপের প্রযুক্তি বিকাশে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

অনুবাদ প্রকল্পটি একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া ছিল। প্রথমে বিদ্বানরা বিদেশ থেকে পাঠ্য সংগ্রহ করতেন, তারপর সেগুলো আরবিতে অনুবাদ, সংশোধন এবং লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করতেন। বায়তুল হিকমার সংগঠন ছিল বিভাগভিত্তিক: অনুবাদ বিভাগে হুনাইন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩) গ্যালেনের ১২৯টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন, যা সিরিয়াক থেকে আরবিতে স্থানান্তরিত হয়। ইউহান্না ইবনে মাসাওয়াইহ চিকিৎসা বিভাগের নেতৃত্ব দেন এবং আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩) দর্শনের অনুবাদ করেন। খ্রিষ্টান, ইহুদি ও সাবিয়ান বিদ্বানরা (যেমন ইয়াহিয়া ইবনে আবি মানসুর) অংশ নেন, যা একটি বৈচিত্র্যময় সহযোগিতার উদাহরণ। আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্বানদের স্বর্ণের ওজন দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো এবং বই কেনার জন্য দূত পাঠানো হতো। এই কার্যপ্রণালি বায়তুল হিকমাকে একটি আধুনিক গবেষণান্দ্রের মতো করে তোলে, যেখানে অনুবাদের পর নতুন গবেষণা হতো। প্রকল্পটি রাজপ্রাসাদের অংশ ছিল, যেখানে ‘আল-খাজিন’ (লাইব্রেরিয়ান) উচ্চপদস্থ বিদ্বান ছিলেন। লাইব্রেরির বিভাগগুলোতে বই সংরক্ষণ, ধার, প্রতিলিপি, মানচিত্র ও অনুবাদের কাজ হতো। অর্থায়নের জন্য আল-মামুন বার্ষিক দুই লাখ দিনার বরাদ্দ করতেন, যা বিদ্বানদের আকৃষ্ট করত। সংগঠনটি অন্যান্য লাইব্রেরি (যেমন আঘলাবিদ, আন্দালুসীয়) গড়ে তোলার মডেল হয়ে ওঠে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলনে স্থানীয় খ্রিষ্টান বিদ্বানদের অবদান ছিল একেবারেই অবিস্মরণীয়। বিশেষত সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা, যাঁরা গ্রিক জ্ঞান সংরক্ষণে প্রথাগতভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা গ্রন্থ অনুবাদের মূল সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই বিদ্বানরা প্রথমে গ্রিক গ্রন্থগুলো সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ করতেন, যা পরে আরবিতে স্থানান্তরিত হতো। হুনাইন ইবনে ইসহাকের মতো খ্রিষ্টান পণ্ডিতেরা কেবল অনুবাদই করেননি, তাঁরা মূল ভাবের যথাযথতা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সংশোধনের কাজেও নিপুণ ছিলেন। এ ছাড়া ইহুদি ও সার্বিয়ান বিদ্বানরাও চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ও দর্শনের গ্রন্থগুলোর আরবি অনুবাদে অংশ নিয়েছিলেন। এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে বায়তুল হিকমার জ্ঞানচর্চা বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে; মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি বিদ্বানরা একত্র হয়ে প্রাচীন জ্ঞানকে নতুন মাত্রা দেন, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁয় অবদান রাখতে সাহায্য করে।

বায়তুল হিকমায় অনুবাদিত প্রধান কাজগুলোর মধ্যে গ্রিক থেকে অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’ এবং ‘ফিজিকস’, ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’ (জ্যামিতি), গ্যালেনের ‘কম্পোজিশন অব ড্রাগস’ এবং পারস্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ্য রয়েছে। ভারতীয় থেকে আর্যভট্টের গণিত এবং সুশ্রুতের চিকিৎসা অনুবাদ হয়। এ কাজগুলো ইসলামি সভ্যতায় অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আল-খওয়ারিজমির ‘অন হিন্দু নাম্বার সিস্টেম’ (যা শূন্য ও ডেসিমাল সিস্টেম প্রচলন করে) এবং ইবনে সিনার চিকিৎসা গ্রন্থে হিউমোরালিজমের ধারণা বিকশিত হয়। প্রকল্পটি চিকিৎসা, গণিত ও দর্শনে বিপ্লব ঘটায়, যা আল-জাজিরির যান্ত্রিক যন্ত্রের মতো উদ্ভাবনের ভিত্তি তৈরি করে। এই অনুবাদগুলো শুধু সংরক্ষণ করেনি, বরং ইসলামি বিজ্ঞানীদের মৌলিক উদ্ভাবনের পথ দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালেনের গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত হিউমোরালিজম ইসলামি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যা পরবর্তীকালে ইউরোপে প্রভাব ফেলে। প্রকল্পটি ইসলামি সভ্যতায় একটি বৌদ্ধিক বুম ঘটায়, যা নবী মুহাম্মদ (সা.

)–এর জ্ঞান অর্জনের ওপর জোরের সঙ্গে মিলে যায়।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলনে স্থানীয় খ্রিষ্টান বিদ্বানদের অবদান ছিল একেবারেই অবিস্মরণীয়। বিশেষত সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা, যাঁরা গ্রিক জ্ঞান সংরক্ষণে প্রথাগতভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা গ্রন্থ অনুবাদের মূল সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই বিদ্বানরা প্রথমে গ্রিক গ্রন্থগুলো সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ করতেন, যা পরে আরবিতে স্থানান্তরিত হতো।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ গড়ে তোলে, যা আল-ফারাবি, আল-বিরুনি ও ইবনে রুশদের কাজে প্রতিফলিত হয়। বিশ্বে এর প্রভাব, বিশেষ করে ইউরোপের রেনেসাঁসে দৃশ্যমান। ১২৫৮ সালে মঙ্গোল আক্রমণে (হালাকু খানের নেতৃত্বে) বায়তুল হিকমা ধ্বংস হলেও, অনুবাদিত বইগুলো আন্দালুসিয়া (স্পেন) ও সিসিলি (ইতালি) হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসে (১২ শতাব্দী) আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ হয়, যা জেরার্ড অব ক্রেমোনার মতো বিদ্বানদের সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটলের গ্রন্থগুলো ইউরোপে হারিয়ে গেলেও আরবি সংস্করণ থেকে পুনরুদ্ধার হয় এবং থমাস অ্যাকুইনাসের দর্শনে প্রভাব ফেলে। গণিতে আল-খওয়ারিজমির কাজ ফিবোনাচির মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়, যা আধুনিক অ্যালগরিদমের ভিত্তি। চিকিৎসায় ইবনে সিনার গ্রন্থ ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত পড়ানো হতো। এভাবে বায়তুল হিকমা ইউরোপের অন্ধকার যুগ থেকে পুনর্জাগরণের সেতু হয়ে ওঠে, যা লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও কপার্নিকাসের কাজে প্রতিফলিত। প্রকল্পটি অন্যান্য লাইব্রেরি (যেমন আঘলাবিদ, আন্দালুসীয়, কায়রো) গড়ে তোলার মডেল হয়ে ওঠে এবং ইসলামি জ্ঞানের সঞ্চারে সাহায্য করে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইউরোপের রেনেসাঁর (১৪-১৭ শতাব্দী) জন্য একটি অপরিহার্য সেতু হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে ইউরোপে গ্রিক ও রোমান জ্ঞান হারিয়ে গেলেও বায়তুল হিকমায় অনুবাদিত পাঠ্যগুলো সংরক্ষিত থাকে এবং স্পেনের আন্দালুসিয়া ও ইতালির সিসিলি হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়। টলেডোতে (১২ শতাব্দী) খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলিম বিদ্বানদের সহযোগিতায় আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ হয়, যা রেনেসাঁর বৌদ্ধিক ভিত্তি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটলের দার্শনিক গ্রন্থগুলো ইউরোপে পুনরুদ্ধার হয়, যা সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাসের ‘সুম্মা থিওলজিকা’র মতো কাজে প্রভাব ফেলে। গণিতে আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেব্রা ফিবোনাচির ‘লিবার অ্যাবাসি’-এর মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়, যা আধুনিক অঙ্কনপদ্ধতির ভিত্তি। চিকিৎসায় ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন প্যারিস, বোলোনিয়া) পাঠ্যপুস্তক ছিল, যা হার্ভে ও ভেসালিয়াসের কাজে প্রভাব ফেলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আল-বাতানির কাজ কপার্নিকাসের ‘হেলিওসেন্ট্রিক মডেল’–এর ভিত্তি তৈরি করে। এই প্রভাব ছাড়া ইউরোপের অন্ধকার যুগ আরও দীর্ঘ হয়ে উঠত এবং রেনেসাঁর বৌদ্ধিক পুনর্জাগরণ কল্পনাতীত হয়ে যেত। বায়তুল হিকমার ধ্বংস সত্ত্বেও এর অনুবাদিত পাঠ্যগুলো ইউরোপে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।

অনুবাদ প্রকল্পে চ্যালেঞ্জ ছিল ভাষাগত জটিলতা। হুনাইন ইবনে ইসহাক গ্রিক থেকে সিরিয়াক এবং তারপর আরবিতে অনুবাদ করে অনুবাদের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করতেন। ধর্মীয় সংঘাতও ছিল। যেমন গ্রিক দর্শনকে ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে মেলানো। মঙ্গোল আক্রমণে (১২৫৮) লাইব্রেরির ধ্বংস একটি বড় ক্ষতি, যেখানে টাইগ্রিস নদীতে বই নিক্ষেপ করা হয় এবং কালি দিয়ে নদী কালো হয়ে যায় বলে কিংবদন্তি চালু আছে। কিছু পশ্চিমা বিদ্বান (যেমন দিমিত্রি গুটাস) বায়তুল হিকমাকে শুধু একটি রাজকীয় লাইব্রেরি বলে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন এটি সাসানিয়ান ‘খিজানাত আল-হিকমা’র অনুকরণ। কিন্তু গবেষণা (যেমন আল-নাদিমের ‘আল-ফিহ্‌রিস্ত’) দেখায়, এটি একটি বিস্তৃত বৌদ্ধিক কেন্দ্র ছিল, যা খ্রিষ্টান ও ইহুদি বিদ্বানদের অন্তর্ভুক্ত করে এবং সাসানিয়ান প্রভাব সত্ত্বেও ইসলামি উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইসলামি সভ্যতার একটি মাইলফলক, যা প্রাচীন জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে নতুন উদ্ভাবনের পথ দেখিয়েছে এবং বিশ্বের বৌদ্ধিক ইতিহাস পরিবর্তন করেছে। এটি দেখায় যে জ্ঞানের বিনিময় সভ্যতার সীমানা অতিক্রম করে। বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রকল্পের শিক্ষা হলো, কীভাবে অনুবাদ জ্ঞানের দরজা খুলে দিতে পারে। আজকের বিশ্বে এই উত্তরাধিকার আমাদের অনুপ্রাণিত করুক, যাতে আমরা নিজেদের জ্ঞান প্রকল্প গড়ে তুলতে পারি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স থ ন ন তর ত ব দ ব নদ র আল ম ম ন র গ রন থ য় অন ব দ অন ব দ র অন ব দ ত র স বর ণ ইউর প র র জন য শত ব দ আল ক ন স রক ষ ক ত কর করত ন আরব ত ন ইবন অবদ ন ইসল ম ইসহ ক প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প

আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন একবার বাইজান্টাইন সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে তোমাদের লাইব্রেরি থেকে যত বই চাও পাঠাও, আমি তাদের স্বর্ণের ওজন দিয়ে পুরস্কৃত করব।’ এই উক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বৌদ্ধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রতি গভীর অনুরাগের প্রকাশ। আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্ঞানকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

বায়তুল হিকমা কেবল একটি গ্রন্থাগার ছিল না; ছিল অনুবাদ, গবেষণা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাণকেন্দ্রও। গ্রিক, পারসি, সিরীয় ও ভারতীয় ভাষা থেকে জ্ঞান আহরণ করে আরবিতে অনুবাদ করার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল এখানে। হুনাইন ইবনে ইসহাক, আল-খওয়ারিজমি, আল-কিন্দির মতো পণ্ডিতেরা শুধু অনুবাদেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তাতে যুক্ত করেছেন নতুন আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ।

আরবিতে অনূদিত এই জ্ঞানের স্রোত পরে আন্দালুসিয়া ও সিসিলির মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসের মতো প্রতিষ্ঠান আরবিতে সংরক্ষিত গ্রিক জ্ঞানকে লাতিনে রূপান্তর করে ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতে ফিরিয়ে আনে। এই ধারার ফলেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি মজবুত হয়।

আরবিতে অনূদিত এই জ্ঞানের স্রোত পরে আন্দালুসিয়া ও সিসিলির মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসের মতো প্রতিষ্ঠান আরবিতে সংরক্ষিত গ্রিক জ্ঞানকে লাতিনে রূপান্তর করে ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতে ফিরিয়ে আনে। এই ধারার ফলেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি মজবুত হয়। অ্যারিস্টটলের দর্শন, ইউক্লিডের জ্যামিতি, গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা পটোলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান—সবই মুসলিম অনুবাদ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ইউরোপে আবারও প্রবেশ করে। ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেবরা আধুনিক গণিতের ভিত রচনা করেছে। আল-বাতানির জ্যোতির্বিজ্ঞান কপার্নিকাসের চিন্তাকে প্রস্তুত করেছে, আর আল-জাজিরির যান্ত্রিক প্রকৌশল ইউরোপের প্রযুক্তি বিকাশে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল আক্রমণে বাগদাদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বায়তুল হিকমার অবসান হলেও তার উত্তরাধিকার টিকে গেছে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও রেনেসাঁ আন্দোলনের ভেতর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলন না হলে ইউরোপের রেনেসাঁ হয়তো অনেক দেরিতে কিংবা একেবারেই অন্যভাবে বিকশিত হতো।

এই অনুবাদ আন্দোলনের শুরু উমাইয়া খিলাফতের যুগে (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) দেখা যায়, যেখানে খলিফা মুআবিয়া প্রথম দামেস্কে গ্রিক বই সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তখন মৌলিক অনুবাদ হয়নি বললেই চলে। আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) শুরুতে, পারস্য সভ্যতার প্রভাবে সম্পদ ও জ্ঞানের প্রসার ঘটে। খলিফা আল-মানসুর (৭৫৪-৭৭৫) বাগদাদ প্রতিষ্ঠা করেন (৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং বায়তুল হিকমাকে একটি রাজকীয় লাইব্রেরি হিসেবে শুরু করেন। তার পুত্র হারুন আল-রশিদ (৭৬৩-৮০৯) এটিকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু আল-মামুনের আমলে (৮১৩-৮৩৩) এটি একটি ব্যাপক অনুবাদ ও গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হয়। আল-মামুন বাইজান্টাইন থেকে বই কিনে আনেন এবং বিদ্বানদের জন্য বিশাল তহবিল বরাদ্দ করেন। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন জ্ঞানকে ইসলামি চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন সৃষ্টি করা, যা দুই শতাব্দীর জন্য চলে। বায়তুল হিকমা আল-রুসাফায় অবস্থিত ছিল, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণালয় (যেমন মাউন্ট কাসিওন) যুক্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে অনুবাদ আন্দোলন শুরু হয়, যা গ্রিক, পারস্য, ভারতীয় ও সিরিয়াক ভাষা থেকে জ্ঞান স্থানান্তরিত করে। প্রকল্পটি শুধু অনুবাদ নয়, বরং জ্ঞানের প্রসার এবং সামাজিক উন্নয়নের একটি মাধ্যম ছিল, যা ইসলামি সমাজে সাক্ষরতা বাড়ায় এবং ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার মিলন ঘটায়।

ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেবরা আধুনিক গণিতের ভিত রচনা করেছে। আল-বাতানির জ্যোতির্বিজ্ঞান কপার্নিকাসের চিন্তাকে প্রস্তুত করেছে, আর আল-জাজিরির যান্ত্রিক প্রকৌশল ইউরোপের প্রযুক্তি বিকাশে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

অনুবাদ প্রকল্পটি একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া ছিল। প্রথমে বিদ্বানরা বিদেশ থেকে পাঠ্য সংগ্রহ করতেন, তারপর সেগুলো আরবিতে অনুবাদ, সংশোধন এবং লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করতেন। বায়তুল হিকমার সংগঠন ছিল বিভাগভিত্তিক: অনুবাদ বিভাগে হুনাইন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩) গ্যালেনের ১২৯টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন, যা সিরিয়াক থেকে আরবিতে স্থানান্তরিত হয়। ইউহান্না ইবনে মাসাওয়াইহ চিকিৎসা বিভাগের নেতৃত্ব দেন এবং আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩) দর্শনের অনুবাদ করেন। খ্রিষ্টান, ইহুদি ও সাবিয়ান বিদ্বানরা (যেমন ইয়াহিয়া ইবনে আবি মানসুর) অংশ নেন, যা একটি বৈচিত্র্যময় সহযোগিতার উদাহরণ। আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্বানদের স্বর্ণের ওজন দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো এবং বই কেনার জন্য দূত পাঠানো হতো। এই কার্যপ্রণালি বায়তুল হিকমাকে একটি আধুনিক গবেষণান্দ্রের মতো করে তোলে, যেখানে অনুবাদের পর নতুন গবেষণা হতো। প্রকল্পটি রাজপ্রাসাদের অংশ ছিল, যেখানে ‘আল-খাজিন’ (লাইব্রেরিয়ান) উচ্চপদস্থ বিদ্বান ছিলেন। লাইব্রেরির বিভাগগুলোতে বই সংরক্ষণ, ধার, প্রতিলিপি, মানচিত্র ও অনুবাদের কাজ হতো। অর্থায়নের জন্য আল-মামুন বার্ষিক দুই লাখ দিনার বরাদ্দ করতেন, যা বিদ্বানদের আকৃষ্ট করত। সংগঠনটি অন্যান্য লাইব্রেরি (যেমন আঘলাবিদ, আন্দালুসীয়) গড়ে তোলার মডেল হয়ে ওঠে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলনে স্থানীয় খ্রিষ্টান বিদ্বানদের অবদান ছিল একেবারেই অবিস্মরণীয়। বিশেষত সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা, যাঁরা গ্রিক জ্ঞান সংরক্ষণে প্রথাগতভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা গ্রন্থ অনুবাদের মূল সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই বিদ্বানরা প্রথমে গ্রিক গ্রন্থগুলো সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ করতেন, যা পরে আরবিতে স্থানান্তরিত হতো। হুনাইন ইবনে ইসহাকের মতো খ্রিষ্টান পণ্ডিতেরা কেবল অনুবাদই করেননি, তাঁরা মূল ভাবের যথাযথতা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সংশোধনের কাজেও নিপুণ ছিলেন। এ ছাড়া ইহুদি ও সার্বিয়ান বিদ্বানরাও চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ও দর্শনের গ্রন্থগুলোর আরবি অনুবাদে অংশ নিয়েছিলেন। এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে বায়তুল হিকমার জ্ঞানচর্চা বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে; মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি বিদ্বানরা একত্র হয়ে প্রাচীন জ্ঞানকে নতুন মাত্রা দেন, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁয় অবদান রাখতে সাহায্য করে।

বায়তুল হিকমায় অনুবাদিত প্রধান কাজগুলোর মধ্যে গ্রিক থেকে অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’ এবং ‘ফিজিকস’, ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’ (জ্যামিতি), গ্যালেনের ‘কম্পোজিশন অব ড্রাগস’ এবং পারস্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ্য রয়েছে। ভারতীয় থেকে আর্যভট্টের গণিত এবং সুশ্রুতের চিকিৎসা অনুবাদ হয়। এ কাজগুলো ইসলামি সভ্যতায় অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আল-খওয়ারিজমির ‘অন হিন্দু নাম্বার সিস্টেম’ (যা শূন্য ও ডেসিমাল সিস্টেম প্রচলন করে) এবং ইবনে সিনার চিকিৎসা গ্রন্থে হিউমোরালিজমের ধারণা বিকশিত হয়। প্রকল্পটি চিকিৎসা, গণিত ও দর্শনে বিপ্লব ঘটায়, যা আল-জাজিরির যান্ত্রিক যন্ত্রের মতো উদ্ভাবনের ভিত্তি তৈরি করে। এই অনুবাদগুলো শুধু সংরক্ষণ করেনি, বরং ইসলামি বিজ্ঞানীদের মৌলিক উদ্ভাবনের পথ দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালেনের গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত হিউমোরালিজম ইসলামি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যা পরবর্তীকালে ইউরোপে প্রভাব ফেলে। প্রকল্পটি ইসলামি সভ্যতায় একটি বৌদ্ধিক বুম ঘটায়, যা নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর জ্ঞান অর্জনের ওপর জোরের সঙ্গে মিলে যায়।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ আন্দোলনে স্থানীয় খ্রিষ্টান বিদ্বানদের অবদান ছিল একেবারেই অবিস্মরণীয়। বিশেষত সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা, যাঁরা গ্রিক জ্ঞান সংরক্ষণে প্রথাগতভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা গ্রন্থ অনুবাদের মূল সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই বিদ্বানরা প্রথমে গ্রিক গ্রন্থগুলো সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ করতেন, যা পরে আরবিতে স্থানান্তরিত হতো।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ গড়ে তোলে, যা আল-ফারাবি, আল-বিরুনি ও ইবনে রুশদের কাজে প্রতিফলিত হয়। বিশ্বে এর প্রভাব, বিশেষ করে ইউরোপের রেনেসাঁসে দৃশ্যমান। ১২৫৮ সালে মঙ্গোল আক্রমণে (হালাকু খানের নেতৃত্বে) বায়তুল হিকমা ধ্বংস হলেও, অনুবাদিত বইগুলো আন্দালুসিয়া (স্পেন) ও সিসিলি (ইতালি) হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়। টলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেটরসে (১২ শতাব্দী) আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ হয়, যা জেরার্ড অব ক্রেমোনার মতো বিদ্বানদের সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটলের গ্রন্থগুলো ইউরোপে হারিয়ে গেলেও আরবি সংস্করণ থেকে পুনরুদ্ধার হয় এবং থমাস অ্যাকুইনাসের দর্শনে প্রভাব ফেলে। গণিতে আল-খওয়ারিজমির কাজ ফিবোনাচির মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়, যা আধুনিক অ্যালগরিদমের ভিত্তি। চিকিৎসায় ইবনে সিনার গ্রন্থ ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত পড়ানো হতো। এভাবে বায়তুল হিকমা ইউরোপের অন্ধকার যুগ থেকে পুনর্জাগরণের সেতু হয়ে ওঠে, যা লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও কপার্নিকাসের কাজে প্রতিফলিত। প্রকল্পটি অন্যান্য লাইব্রেরি (যেমন আঘলাবিদ, আন্দালুসীয়, কায়রো) গড়ে তোলার মডেল হয়ে ওঠে এবং ইসলামি জ্ঞানের সঞ্চারে সাহায্য করে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইউরোপের রেনেসাঁর (১৪-১৭ শতাব্দী) জন্য একটি অপরিহার্য সেতু হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে ইউরোপে গ্রিক ও রোমান জ্ঞান হারিয়ে গেলেও বায়তুল হিকমায় অনুবাদিত পাঠ্যগুলো সংরক্ষিত থাকে এবং স্পেনের আন্দালুসিয়া ও ইতালির সিসিলি হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়। টলেডোতে (১২ শতাব্দী) খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলিম বিদ্বানদের সহযোগিতায় আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ হয়, যা রেনেসাঁর বৌদ্ধিক ভিত্তি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটলের দার্শনিক গ্রন্থগুলো ইউরোপে পুনরুদ্ধার হয়, যা সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাসের ‘সুম্মা থিওলজিকা’র মতো কাজে প্রভাব ফেলে। গণিতে আল-খওয়ারিজমির অ্যালজেব্রা ফিবোনাচির ‘লিবার অ্যাবাসি’-এর মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়, যা আধুনিক অঙ্কনপদ্ধতির ভিত্তি। চিকিৎসায় ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিততিব্বি’ ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন প্যারিস, বোলোনিয়া) পাঠ্যপুস্তক ছিল, যা হার্ভে ও ভেসালিয়াসের কাজে প্রভাব ফেলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আল-বাতানির কাজ কপার্নিকাসের ‘হেলিওসেন্ট্রিক মডেল’–এর ভিত্তি তৈরি করে। এই প্রভাব ছাড়া ইউরোপের অন্ধকার যুগ আরও দীর্ঘ হয়ে উঠত এবং রেনেসাঁর বৌদ্ধিক পুনর্জাগরণ কল্পনাতীত হয়ে যেত। বায়তুল হিকমার ধ্বংস সত্ত্বেও এর অনুবাদিত পাঠ্যগুলো ইউরোপে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।

অনুবাদ প্রকল্পে চ্যালেঞ্জ ছিল ভাষাগত জটিলতা। হুনাইন ইবনে ইসহাক গ্রিক থেকে সিরিয়াক এবং তারপর আরবিতে অনুবাদ করে অনুবাদের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করতেন। ধর্মীয় সংঘাতও ছিল। যেমন গ্রিক দর্শনকে ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে মেলানো। মঙ্গোল আক্রমণে (১২৫৮) লাইব্রেরির ধ্বংস একটি বড় ক্ষতি, যেখানে টাইগ্রিস নদীতে বই নিক্ষেপ করা হয় এবং কালি দিয়ে নদী কালো হয়ে যায় বলে কিংবদন্তি চালু আছে। কিছু পশ্চিমা বিদ্বান (যেমন দিমিত্রি গুটাস) বায়তুল হিকমাকে শুধু একটি রাজকীয় লাইব্রেরি বলে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন এটি সাসানিয়ান ‘খিজানাত আল-হিকমা’র অনুকরণ। কিন্তু গবেষণা (যেমন আল-নাদিমের ‘আল-ফিহ্‌রিস্ত’) দেখায়, এটি একটি বিস্তৃত বৌদ্ধিক কেন্দ্র ছিল, যা খ্রিষ্টান ও ইহুদি বিদ্বানদের অন্তর্ভুক্ত করে এবং সাসানিয়ান প্রভাব সত্ত্বেও ইসলামি উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

বায়তুল হিকমার অনুবাদ প্রকল্প ইসলামি সভ্যতার একটি মাইলফলক, যা প্রাচীন জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে নতুন উদ্ভাবনের পথ দেখিয়েছে এবং বিশ্বের বৌদ্ধিক ইতিহাস পরিবর্তন করেছে। এটি দেখায় যে জ্ঞানের বিনিময় সভ্যতার সীমানা অতিক্রম করে। বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রকল্পের শিক্ষা হলো, কীভাবে অনুবাদ জ্ঞানের দরজা খুলে দিতে পারে। আজকের বিশ্বে এই উত্তরাধিকার আমাদের অনুপ্রাণিত করুক, যাতে আমরা নিজেদের জ্ঞান প্রকল্প গড়ে তুলতে পারি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ