নেতানিয়াহুর গাজা দখলের পথে সামান্য বাধা
Published: 6th, October 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার যে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তার পুরো পটভূমি বিশ্লেষণ করা ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। সেখানে তাঁরা গাজায় গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের এক সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর এ ঘোষণা এসেছে। সেই সম্মেলনে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের উদ্যোগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। একই সময় ইসরায়েলকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও বর্জনের ঢেউও তীব্র হয়।
এতে ইসরায়েলের ভেতরেও যুদ্ধবিরোধী সমালোচনা বাড়তে শুরু করেছে। কারণ, তারা এখন শুধু সাংস্কৃতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় পাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাজায় গণহত্যার কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি স্থগিত করার কথা ভাবছে। এটি সেই ভয়কে আরও জোরদার করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রস্তাবটি নেতানিয়াহু বহু মাস আগেই গ্রহণ করতে পারতেন। তাতে হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নিহত হতো না, বরং আরও জীবিত বন্দী মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকত। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ, তাঁর লক্ষ্য সব সময় একটাই থেকেছে—গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা।এ অবস্থায় নেতানিয়াহু এখন বড় এক সংকটে আছেন। একদিকে তিনি একজন নিও–লিবারেল রাজনীতিক হিসেবে জানেন, ইসরায়েল পশ্চিমা শক্তি ও মুক্তবাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কতটা ক্ষতিকর, তা তিনি ভালোভাবেই বোঝেন।
অন্যদিকে নেতানিয়াহুর সামনে এসেছে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করার এক ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’। জায়নবাদী স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী সমাজের মধ্যে এখন এই ‘সুযোগ’ নেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক সমর্থন আছে।
ফলে নেতানিয়াহুর সামনে এখন কঠিন দ্বিধা। তিনি পশ্চিমের সঙ্গে সমঝোতা করে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা ধরে রাখবেন, নাকি দেশের ভেতরের শক্ত পৃষ্ঠপোষক-শিবিরকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেই উচ্ছেদমুখী নীতিকে এগিয়ে নেবেন? তিনি দুদিকেই সমানভাবে আগ্রহ ও চাপে আছেন। তাই তাঁকে খুব সাবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ট্রাম্পের ‘২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা’ বাস্তবে নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের লক্ষ্য, অর্থাৎ গাজাকে ফিলিস্তিনিশূন্য করার পথে খুব বড় কোনো বাধা হবে না।
নেতানিয়াহু জানেন, তাঁর দক্ষিণপন্থী সরকারের স্বপ্ন হলো গাজার সব ফিলিস্তিনিকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে পশ্চিম তীর থেকেও তাদের উচ্ছেদের নজির তৈরি করা। একই সঙ্গে তিনি বুঝতে পারেন, গাজার গণহত্যা নিয়ে ট্রাম্প দেশ-বিদেশে চাপের মুখে আছেন, তাই তাঁকেও কিছু ‘রাজনৈতিক ফলাফল’ দিতে হবে।
এই সপ্তাহে যে ‘২০ দফা পরিকল্পনা’ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে নতুন কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আলোচক ব্রেট ম্যাকগার্কের মতে, এটি মূলত গত জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপের অনুলিপি, যেটি মার্চে ইসরায়েল নিজেই ভেঙে দিয়েছিল।
পার্থক্য শুধু এই যে এবার সেটিকে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। কিন্তু আরবদের সেই সমর্থন ছিল শর্তসাপেক্ষ। অর্থাৎ শুধু তখনই তারা রাজি, যদি শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ট্রাম্প এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যে গাজা প্রশাসনের পরিকল্পনা দিয়েছেন, সেটি নাকি অস্থায়ী ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে গাজাকে ধীরে ধীরে পশ্চিম তীরের সঙ্গে একীভূত করার কথা বলা হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ট্রাম্প যে পরিকল্পনা সাধারণভাবে দেখিয়েছেন, সেটি আগেই আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে যে খসড়া আলোচনা করা হয়েছিল, তার সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ পরিকল্পনার প্রকৃত খসড়া এবং ট্রাম্প যা প্রদর্শন করেছেন, দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে এ তথ্য গোপন করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, গাজায় না হামাস, না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ—কেউই শাসন করতে পারবে না।
আগামী বছর ইসরায়েলে নির্বাচন। তাই নেতানিয়াহু এখন সময়কে নিজের অনুকূলে নিতেই ব্যস্ত। এ জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখার জন্য সবকিছু করতে রাজি। এমনকি গত মাসে দোহায় ইসরায়েলি হামলার পর ট্রাম্পের কথামতো তিনি কাতারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন, যদিও তাঁর ভোটাররা এটিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন।
নেতানিয়াহু বুঝতে পেরেছেন, এখন ইসরায়েলসহ বৈশ্বিক দক্ষিণপন্থীরা মূলধারার সংবাদমাধ্যম নয়, বরং বিকল্প প্ল্যাটফর্ম থেকে খবর নেয়। সেখানে তাঁর অযৌক্তিক বক্তব্যের প্রতিবাদ করার মতো সাংবাদিক কেউ থাকেন না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রস্তাবটি নেতানিয়াহু বহু মাস আগেই গ্রহণ করতে পারতেন। তাতে হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নিহত হতো না, বরং আরও জীবিত বন্দী মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকত। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ, তাঁর লক্ষ্য সব সময় একটাই থেকেছে—গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা।
আবেদ আবু শাহাদা ফিলিস্তিনি রাজনীতিক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী’
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরের কাছে হস্তান্তর–সংক্রান্ত সাম্প্রতিক দুটি চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছেন চট্টগ্রামের ১০ বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা বলেছেন, একটি অন্তর্বর্তী সরকার এমন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে না। দ্রুততার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন জাতির মনে গভীর সন্দেহ তৈরি করেছে। এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী।
আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় সম্পদ। তাই বন্দর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা জাতির সামনে খোলাসা করা উচিত। এর আগে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত জনরোষের মুখে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে ৩৩ বছরের চুক্তি সম্পন্ন হয়, যা আরও ১৫ বছর বাড়ানো যেতে পারে। একই দিনে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার জন্য সুইজারল্যান্ডের মেডলগ এসএর সঙ্গে ২২ বছরের আরেকটি চুক্তিও করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) সরকারের পরামর্শক হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনালের কনসেশন চুক্তি তৈরি করছে।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, আইএফসির ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজরি প্রতিবেদনে প্রস্তাব জমা থেকে চুক্তি সম্পন্নের পুরো প্রক্রিয়ায় ৬২ দিনের সময়সীমা ধরা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘অস্বাভাবিক দ্রুততায়’ মাত্র দুই সপ্তাহে চুক্তি চূড়ান্ত করে। এতে জনমনে সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অসতর্ক চুক্তির কারণে দেশকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ক্ষতির ভার বহন করতে হয়েছে। আফ্রিকার জিবুতির উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেন, দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় ২০০৪ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি জিবুতি সরকার বাতিল করেছিল। তবে ডিপি ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়। তাতে উল্টো জিবুতি সরকারের বিরুদ্ধে সুদসহ ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ এবং স্বত্ব বাবদ আরও ১৪৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের নির্দেশ আদায়ে তারা সক্ষম হয়। এ ধরনের চুক্তির ফলে বিশ্বের বহু দেশের একই রকম খেসারত দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
চুক্তির টার্মিনেশন, ক্ষতিপূরণসহ আর্থিক শর্ত গোপন রাখা হলো কেন, এ প্রশ্ন তোলেন ১০ বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। নিউমুরিং টার্মিনালটি দেশীয় জনবল দিয়ে লাভজনকভাবেই পুরোদমে চালু আছে। বর্তমানে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করছে। প্রশ্ন হলো লাভজনকভাবে চালু টার্মিনালটি কেন আমরা বিদেশিদের দেব, যেখানে কোনো নতুন বিনিয়োগের সুযোগ নেই।’
চালু টার্মিনালগুলো যেভাবে বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই দাঁড়াতে পারবে না বলে মনে করেন ১০ বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা বলেছেন, ‘বন্দর খাতে আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা তৈরির কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করা ছাড়া উপায় থাকে না। একই সঙ্গে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, মাশুল বাড়ানো বা এ ধরনের কোনো সংকটের সময় দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকলে তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যে সুযোগ থাকে তা-ও থাকবে না। পুরোটাই যদি বিদেশিদের হাতে চলে যায়, তখন সংকট থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আমাদের হাতে থাকবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে বিবৃতিদাতারা বলেন, বন্দর পরিচালনার মতো জাতীয় স্বার্থ জড়িত চুক্তি শুধু নির্বাচিত সরকারই করতে পারে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকায় তার আগেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অযৌক্তিক।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, লেখক ফেরদৌস আরা আলীম, নাট্যজন শিশির দত্ত, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি ওমর কায়সার, কবি কামরুল হাসান বাদল, লেখক ও উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব কমল সেনগুপ্ত, ভাস্কর অলোক রায় ও আইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার।