অনেক স্থানে চুলা জ্বালাতে রাতের অপেক্ষা, গ্যাস নিয়ে সামনে আরও ভোগান্তি
Published: 13th, January 2025 GMT
রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের ব্যাপক সংকটে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। অনেক জায়গায় দিনের বেলায় গ্যাস থাকছে না। রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্পের গ্রাহকেরাও। ফলে রপ্তানিমুখী কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সাধারণত শীতের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়। এতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমে যায়। ফলে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবার গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন টানা কমছে। ফলে শীতেও গ্যাস–সংকট ভোগাচ্ছে গ্রাহকদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সামনে এটি আরও ভোগাবে।
দিনে এখন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হলে পরিস্থিতি সামলানো যায়। তবে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুট।
দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় গত আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোয় তেমন জোর দেওয়া হয়নি। ফলে উৎপাদন কমে এখন ১৯৩ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। গত বছরও এটি ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা এর জন্য দায়ী। সর্বোচ্চ মজুত থাকার পরও কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে তিতাস ও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। অথচ কম মজুত থাকা বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এখন তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। সর্বশেষ উন্মুক্ত দরপত্রে কোনো কোম্পানি সাড়া দেয়নি। এখন নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কারের সুযোগ নেই। স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে তেমন গতি নেই। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ চলছে ধীরগতিতে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি কূপ খননের কথা থাকলেও তিন বছরে হয়েছে মাত্র ১৬টি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাইলেই চট করে গ্যাসের সংকট সমাধান করা যাবে না। উৎপাদন কমছে, এলএনজি আমদানির সক্ষমতাও সীমিত; আবার এলএনজির দামও বাড়তির দিকে। দেশে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো সমাধান নেই। তাই অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে।
চুলা জ্বালাতে রাতের অপেক্ষা
রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস না পাওয়ার ফোন আসছে তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা লাইজু বেগম বলেন, রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। শুধু মোহাম্মদপুর নয়; ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার মানুষ গ্যাসের অভাবে রান্নার চুলা জ্বালাতে পারছেন না।
গাজীপুরেও গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছেন না আবাসিক গ্রাহকেরা। কোথাও কোথাও জ্বলছে না রান্নার চুলা, আবার কোথাও কোথাও আগুন থাকলেও তা কোনোরকমে মিটমিট করছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন গাজীপুর মহানগর, সদর ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ, দাতা সড়ক, কাশিপুর, বাবুরাইল, ভোলাইল, বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া, মদনপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের সংকটের খবর পাওয়া গেছে। দেওভোগ এলাকার গৃহিণী আফরোজা খানম বলেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টার পর থেকে গ্যাসের চাপ কমে যায়। বেলা একটার পর একটু চাপ বাড়ে। ইলেকট্রিক চুলায় রান্না করায় বাড়তি বিদ্যুৎ বিলে সংসার খরচ বাড়ছে। শহরের বাবুরাইল এলাকার গৃহিণী স্নেহা আক্তার বলেন, দিনের বেলায় গ্যাস মিলছে না। গভীর রাতে গ্যাস এলেও আবার ভোরে চলে যায়। গ্যাস না থাকায় বাড়তি খরচ করে এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে।
গ্যাস পাচ্ছে না শিল্প, দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ হয় শিল্পে। শীতে এমনিতেই গ্যাসের চাপজনিত সমস্যা থাকে। এবার সরবরাহ কম থাকায় এটি আরও ভয়াবহ হয়েছে। কোনো কোনো কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। এতে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। রপ্তানি শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিতি নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ধুঁকছে অধিকাংশ কারখানা।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত ফেয়ার অ্যাপারেলস ডাইং ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, যতটুকু গ্যাস পাচ্ছেন, তা দিয়ে ধীরে ধীরে বয়লার চলছে।
আইএফএস প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এস এম আজমল হুদা বলেন, মাঝেমধ্যেই গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। তখন সিএনজি ও ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
টোটাল ফ্যাশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস–সংকটে দুই বছর ধরে তাঁদের ডাইং প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
গাজীপুরেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমেছে। কোনাবাড়ী, মৌচাক, ভোগড়া, বাসন, পল্লী বিদ্যুৎ, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর শিল্প এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকার শিল্পকারখানায় তিন মাস ধরে তীব্র গ্যাস–সংকট চলছে। এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস নেই বললেই চলে। ভোগড়া, কোনাবাড়ী, মৌচাক, সফিপুর ও চন্দ্রা এলাকার সুতা তৈরির কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পে গ্যাস–সংকটে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাকশিল্প কারখানা।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপক (সরবরাহ এবং বিতরণ) মো.
গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর নামে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। এখন আবারও সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে দাম বাড়ানোর তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। নতুন শিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
মজুত ফুরাচ্ছে, উৎপাদন কমছে
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। তবে উৎপাদনের শীর্ষে থাকা বিবিয়ানার মজুত শেষের দিকে। এখানে উৎপাদন কমছে। দুই বছর আগে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটও উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৮ কোটি ঘনফুটে। আগামী দিনে আরও কমতে থাকবে। অন্য বড় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন হচ্ছে না।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত মোট মজুত আছে সাড়ে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। বছরে গড়ে পৌনে ১ টিসিএফ গ্যাস উৎপাদন করা হয়। এতে অবশিষ্ট মজুত দিয়ে ৮ বছর উৎপাদন ধরে রাখা যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুতে কত বছর চলবে, তা এভাবে বলা যাবে না। কেননা গ্যাসের মজুত কমতে থাকায় একই হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাবে না। এটি প্রতিবছর কমতে পারে। এর মধ্যে নতুন মজুতও আবিষ্কৃত হতে পারে।
আমদানিনির্ভরতা থেকেই বিপর্যয়
উৎপাদনের পাশাপাশি কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ করা হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকায় নিয়মিত গ্যাস–সংকটে ভুগছেন বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও আবাসিক খাতের গ্রাহকেরা। এর মধ্যে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য একটি টার্মিনাল শুক্রবার দুপুর থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে গ্যাস–সংকট আরও বেড়েছে। গত সপ্তাহেও এটি তিন দিন বন্ধ ছিল। এর আগে গত বছর টানা কয়েক মাস বন্ধ ছিল সামিটের টার্মিনাল। কোনো টার্মিনাল বন্ধ থাকলেই গ্যাসের সরবরাহ সংকট বেড়ে যায়।
দিনে চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে এলএনজি থেকে। বর্তমানে দিনে আমদানি সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। নতুন করে কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে না। তাই দেশে উৎপাদন কমলেও এলএনজি আমদানি খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। যদিও ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর একাধিক চুক্তি করে গেছে গত সরকার।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সরকারই গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয় না। আমদানিনির্ভরতা থেকেই এ খাতে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এলএনজিনির্ভরতা কোনো সমাধান নয়। বাজারে থাকলেও চড়া দামে এলএনজি কেনা কঠিন। গ্যাস সমস্যার সমাধান চাইলে অনুসন্ধানে জোর বাড়াতে হবে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোববার জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি (সমকাল অনলাইন, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
আলোচনাটি যে হঠাৎ এসে গেছে– এমন মনে করার কারণ নেই। গত বছর ১১ নভেম্বর আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই মানবিক করিডোরের বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছিল। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন। ওই সভাতেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব রাখেন।
দু’মাস পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই দিনের সফরে বাংলাদেশ আসেন। তখনই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর দুই দিনের সফর শেষে ১৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টই বলেছিলেন– ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। পরিস্থিতি অনুকূল হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন’ (সমকাল, ১৬ মার্চ ২০২৫)।
সর্বশেষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন রোববার এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আপাতত বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব (সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)।
বিধৃত পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষের জন্য বাংলাদেশকে মানবিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যুদ্ধরত অনেক দেশেই বেসামরিক লোকদের কাছে মানবিক সহায়তা প্রদানে মানবিক করিডোর স্থাপন ও ব্যবহার করা হয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃপ্রণোদিত আলোচনার মাধ্যমে, কোনো কোনোটি তৃতীয় পক্ষ বিশেষত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, ফল সবসময় খুব একটা ভালো হয়নি।
যেমন ১৯৮৯ সালে প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য লাচিন করিডোর স্থাপিত হয়েছিল। এটি নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিডোর বা ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও বছর দুয়েকের মাঝেই করিডোরটি আজারবাইজান বন্ধ করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছিল; যদিও আর্মেনিয়া ও তার মিত্র প্রজাতন্ত্রগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে আক্রমণের পর আজারবাইজানি বাহিনী পুরো নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে নাগোর্নো-কারাবাখের প্রায় সব আর্মেনীয় বাসিন্দা লাচিন করিডোর দিয়ে আর্মেনিয়ায় চলে যায়। এভাবেই একটি মানবিক করিডোরের অমানবিক মৃত্যু ঘটে।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মানবিক করিডোরের ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। সেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবিক করিডোর।
প্রথমে ১৯৯৩ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে স্রেব্রেনিকা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে একই বছরের ৬ মে নিরাপত্তা পরিষদের ৮২৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ৬টি মানবিক করিডোর ঘোষণা করা হয়। এগুলোকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ইউনিটের সুরক্ষাধীনে রাখা হয়। এটা জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের একটি বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত করা হবে, সেটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল না। ফলে প্রস্তাবটি পরে জটিল ও কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। কারণ এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক কারণে নিরাপদ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক ছিল না। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সাল নাগাদ জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং স্রেব্রেনিকা গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।
উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবে স্রেব্রেনিকাকে ‘বল প্রয়োগসহ সব প্রয়োজনীয় উপায় ব্যবহার করে সুরক্ষিত নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকার ওপর অব্যাহত আক্রমণের পাশাপাশি সারায়েভোর অব্যাহত অবরোধের ফলে শেষ পর্যন্ত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অপারেশন ডেলিবারেট ফোর্স নামে ন্যাটো হস্তক্ষেপের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের শেষ নাগাদ প্রতিটি নিরাপদ এলাকায় ‘রিপাবলিকা শ্রপস্কা আর্মি’ বা বসনিয়ান সার্ব সেনাবাহিনী আক্রমণ এবং স্রেব্রেনিকা ও জেপা দখল করে।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। সেখানেও জাতিসংঘের প্রস্তাবমতে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেশটির সমস্যা সমাধানে এই পদক্ষেপও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এমন মনে করার অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি।
২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন সময় নিরাপদ অঞ্চল, উত্তেজনা কমানোর অঞ্চল বা নো-ফ্লাই জোন প্রস্তাব বা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই তেমন কাজে লাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সিরিয়ার বর্তমান অবস্থাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বস্তুত বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে যেসব জায়গায় ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত শুধু মানবিক করিডোরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। অনিবার্যভাবেই সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে না– সে ব্যাপারে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। কারণ আরাকান রাজ্যে এ ধরনের করিডোর মিয়ানমার সহজভাবে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। ভূরাজনৈতিক কারণে এ অঞ্চলে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের স্বার্থ-সংঘাত সুবিদিত। সঙ্গে রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থও। সর্বোপরি রাখাইনে মানবিক সহায়তার করিডোরে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই।
আমরা জানি, আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্যান্য পথ বন্ধ করে রেখেছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। এখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘মানবিক সহায়তা’ তারা নিজেদের বদলে বেসামরিক নাগরিকদের হাতে তুলে দেবে? আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই জনগোষ্ঠীর আরও এক লাখ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
কথা হচ্ছে, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কঙ্গো কিংবা সিরিয়া– কোথাও মানবিক করিডোর সফল হয়নি। সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়াতেও জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখন সেটা বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ক্ষেত্রে কী ম্যাজিক দেখাতে পারে, বোধগম্য নয়। প্রস্তাব জাতিসংঘ বা যেখান থেকেই আসুক; সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
মোশতাক আহমেদ; কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ