জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০, নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তাঁরা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। নির্বাচন হবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে বা এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে না যায়, সে জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে বেশ কিছু সুপারিশ করবে এই কমিশন। পাশাপাশি বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতিতেও পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে শেষ মুহূর্তের কাজ করছে। আগামীকাল বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়াও নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনও আগামীকাল প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিশনগুলোর পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে অন্য দুটি—বিচারব্যবস্থা ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চলতি মাসের শেষে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে শেষ মুহূর্তের কাজ করছে। আগামীকাল বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সংস্কার কমিশনগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করবে। এ লক্ষ্যে তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ থাকবে, সেগুলো মূলত দুই ধরনের হবে। কিছু হবে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য, আর কিছু দীর্ঘমেয়াদি। তবে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখন সংসদ নেই। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংসদ গঠন না করা পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার করার সুযোগ নেই।

কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি মাসেই এ আলোচনা শুরু হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাব এবং এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য হলে সংলাপ থেকে একটি রূপরেখা আসতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

উচ্চকক্ষের বাকি ১০০টি আসনে নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে। দলগুলো নির্বাচনে সারা দেশে যত ভোট পাবে তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। দলগুলো উচ্চকক্ষে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে যাতে বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব রাখে, সেটাও উল্লেখ থাকবে।দ্বিকক্ষ সংসদ যেমন হবে

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের পার্লামেন্ট তথা জাতীয় সংসদ এক কক্ষের। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদে মোট আসন ৩৫০টি। ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সাধারণ নির্বাচনে পাওয়া আসনের অনুপাতে নারী আসনগুলো বণ্টন করা হয়।

সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের ৪০০টি আসনে নির্বাচন হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। আর উচ্চকক্ষে মোট ১০৫ আসনের ৫টি থাকবে রাষ্ট্রপতির হাতে। তিনি এই পাঁচ আসনে সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেবেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতির হাতে পাঁচটি আসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে।

উচ্চকক্ষের বাকি ১০০টি আসনে নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে। দলগুলো নির্বাচনে সারা দেশে যত ভোট পাবে তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। দলগুলো উচ্চকক্ষে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে যাতে বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব রাখে, সেটাও উল্লেখ থাকবে।

বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলে আসছে। বিএনপি লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে ৬২ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটিও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়েও অংশীজনদের অনেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব দেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও সংসদের নিম্নকক্ষে বিদ্যমান পদ্ধতিতে ও উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কমিশন আগামীকাল প্রতিবেদন জমা দেবে। এত দিন ক্ষমতা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল। তাঁরা এমনভাবে সুপারিশ করছেন, যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।একনায়কতন্ত্র ঠেকানো অন্যতম লক্ষ্য

সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তাদের যেসব সুপারিশ থাকবে, তার অন্যতম লক্ষ্য হবে গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করা এবং সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকানো। এ জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেওয়া হবে, যাতে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ না থাকে। এ লক্ষ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা; একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কয়টি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া; প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা যাতে না হন, এমন বিধান; নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান; প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা—এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন।

এ ছাড়া সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশও করা হচ্ছে। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’—এই তিনটিকে সংবিধানের মূলনীতি করার সুপারিশ করবে কমিশন। এই তিনটির পাশাপাশি আরও দুটি মূলনীতিও যোগ করা হতে পারে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কমিশন আগামীকাল প্রতিবেদন জমা দেবে। এত দিন ক্ষমতা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল। তাঁরা এমনভাবে সুপারিশ করছেন, যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ জন্য নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ—এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা লক্ষ্য

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, দীর্ঘ মেয়াদে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরি করছে কমিশন। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনেরও সুপারিশ করবে কমিশন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন, নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকে, সেগুলোর ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে বিধিমালায় কিছু পরিবর্তন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনে সংশোধন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো এবং নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার জায়গা তৈরি, আরপিওতে শাস্তি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করা, হলফনামার ছকে পরিবর্তন করে প্রার্থীর বিদেশে সম্পদ থাকলে তার বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করা, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সুপারিশ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কমিশন আগামীকাল প্রতিবেদন জমা দেবে। সেখানে কমিশনের সুচিন্তিত মতামত থাকবে। সুপারিশগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হবে। তিনি আশা করেন, এর মধ্য দিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে।

দুদকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি কাঠামোও প্রস্তাব করা হতে পারে। দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই–বাছাইয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও অনিয়ম দূর করতে এ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন।দুদককে স্বাধীন করার সুপারিশ

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের কমিশন আগামীকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক সংস্কার কমিশন দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ আইনে সংশোধন আনার প্রস্তাব দেবে। দলীয় প্রভাবমুক্ত, যোগ্য ব্যক্তিদের একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া যায়, তার একটি রূপরেখা সেখানে থাকবে। দুদককে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করা এবং মর্যাদা বাড়ানোর বিষয়ে সুপারিশ থাকবে। এখন দুদকে সচিব থেকে নিচের দিকে কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি ক্যাডারের প্রাধান্য রয়েছে। এখানে একটি ভারসাম্য আনার কিছু সুপারিশ থাকবে। জনবলের ন্যায্য সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাঁদের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণেও কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও প্রক্রিয়ার কথা থাকবে। দুদকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি কাঠামোও প্রস্তাব করা হতে পারে। দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই–বাছাইয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও অনিয়ম দূর করতে এ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন।

এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত বা শিক্ষার্থীদের বয়ানে যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, তা এমন কিছু নয় যে অতিক্রম করা যাবে না।রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ঘোষণা দেয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ছয়টি কমিশন পূর্ণাঙ্গভাবে গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা ছয়টি কমিশন। আগামী মাসের শেষের দিকে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে কতটা ঐকমত্য তৈরি করা যাবে, তা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করছেন। কারণ, নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গণে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ অবশ্য মনে করেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করা যাবে না, এমন নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত বা শিক্ষার্থীদের বয়ানে যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, তা এমন কিছু নয় যে অতিক্রম করা যাবে না।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়ার কাছে ট্রাম্পের পরমাণু সাবমেরিন মোতায়েনের ঝুঁকি আসলে কতটা

সাধারণ সময়ে এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, যুগ পরিবর্তনকারী ও ভয়জাগানিয়া বলে মনে হতো। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধকালেও কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে রাশিয়ার উপকূলের দিকে পরমাণু সাবমেরিন পাঠানোর এমন নির্দেশ দেননি।

এই ধরনের পরমাণু উত্তেজনার খেলায় আগে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নেতা জড়াননি।

সত্যি বলতে, ১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়ে বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ১৩ দিন ধরে পুরো পৃথিবী ভয় আর অনিশ্চয়তায় কাঁপছিল।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।

তবে তার অর্থ এই নয় যে ট্রাম্প যা করলেন, সেটি কোনো ঝুঁকিমুক্ত সিদ্ধান্ত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অবস্থান এমনভাবে বদলেছেন, যেটা তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই সাহস করেননি। এমনকি অনেকটা হালকাভাবেই তিনি পারমাণবিক উত্তেজনার সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেছেন।

এখন যদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাল্টা জবাব দিতে চান, তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন, পুতিন তেমন কিছু করবেন না। আসলে ট্রাম্প সম্ভবত এবার রাশিয়ার কৌশলই ব্যবহার করছেন।

পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন। এই কালিনিনগ্রাদ এলাকাটি ন্যাটোর সদস্যদেশ পোল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত।

২০২৩ সালে পুতিন বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেন। স্নায়ুযুদ্ধের পর এই প্রথম রাশিয়া নিজেদের দেশের বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করল। তিনি ইউক্রেনে বারবার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

আর গতকাল শুক্রবার পুতিন ঘোষণা দিলেন, রাশিয়া ওরেশনিক নামে একধরনের হাইপারসনিক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি শুরু করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ২০২৫ সালের মধ্যেই বেলারুশে মোতায়েন করা হবে। তিনি দাবি করেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানও ইতিমধ্যে বাছাই করে রাখা হয়েছে।

গত কয়েক দিনে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের নানা হুমকি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। মেদভেদেভ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করছেন। তিনি এর আগেও পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন।

পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন।

কিছুদিন আগেও পুতিনের ভক্ত হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছেন এবং তার মোকাবিলায় পাল্টা চাল দিচ্ছেন।

অন্যভাবে বললে, রাশিয়া যেটাকে ‘কেবল হুমকি’ হিসেবে দিচ্ছে, ট্রাম্প সেটাকে ‘আসল হুমকি’ হিসেবে নিচ্ছেন। এটা অনেকটাই উল্টো পরিস্থিতি। কারণ, ট্রাম্পের সমর্থকেরা সাধারণত বলে থাকেন, তাঁর কথাকে সরাসরি না নিয়ে রূপকভাবে বুঝতে হবে।

মেদভেদেভকে উদ্দেশ করে ট্রাম্প তাঁর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লেখেন, ‘শব্দের গুরুত্ব অনেক। আর সেগুলো অনেক সময় এমন পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যা কেউ চায় না।’

তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হুমকিকে অনেকটাই নাটকীয় ‘পারফরম্যান্স’ বলা যায়। হ্যাঁ, এটি উচ্চ ঝুঁকির, দায়িত্বহীন। তবে শেষমেশ এটি একধরনের ‘লোক দেখানো কার্যকলাপ’।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পেছনে অন্য উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আগামী কয়েক দিনে ট্রাম্পকে ব্যাখ্যা করতে হবে, ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। দিন দিন এটির গুরুত্ব আরও বাড়ছে। কারণ, গতকাল শুক্রবার কিয়েভে রাশিয়ার এক হামলায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন।

এ ছাড়া রাশিয়ার তেল-গ্যাস কেনা দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর দ্বিতীয় স্তরের নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিকল্পনাও ট্রাম্পের জন্য কূটনৈতিক চাপে পরিণত হয়েছে।

এ সবকিছুর মাঝখানে ট্রাম্প যদি পরবর্তী সময়ে তাঁর হুমকি থেকে সরে দাঁড়াতে চান, তাহলে তিনি দেখাতে পারবেন যে সাবমেরিন মোতায়েনের মাধ্যমে তিনি রাশিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি এমন একটি কৌশল নিয়েছেন, যার ঝুঁকি হয়তো বেশি, কিন্তু অর্থনৈতিক খরচ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে যেসব মিত্রদেশকে তিনি অন্য ক্ষেত্রে পাশে পেতে চান, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের চেয়ে এই মূল্য তুলনামূলক কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ