যোগাযোগ ও সংযোগ শব্দ দুটোর মধ্যে আমি একটি বিভাজন করি। ইংরেজিতে যদি বলি, তাহলে আমার কাছে যোগাযাগ মানে ‘কানেকশন’; সংযোগ মানে ‘কানেক্টেডনেস’। আমি মনে করি, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ও সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারের কারণে বিশ্বায়নের কালে পৃথিবীতে নিশ্চিতভাবে যোগাযোগ বেড়েছে। একই সঙ্গে মানুষে মানুষে সংযোগ কমেছে। 

জানি, আমার এ মন্তব্যে অনেকেই ভ্রু কুঁচকাবেন। যে ত্বরান্বিত গতিতে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সামাজিক মাধ্যম ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে কী করে আমি বলি যে, পৃথিবী আগের চেয়ে আরও বেশি সংযুক্ত নয়? যুক্তি দেখানো হবে, বর্তমান বিশ্বে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৯০০ কোটি, পৃথিবীতে ৪০০ কোটিরও বেশি মানুষের চৌকস ফোন তথা ‘স্মার্টফোন’ আছে এবং ৫০০ কোটিরও বেশি মানুষ আন্তর্যোগ বা ‘ইন্টারনেট’ ব্যবহার করেন। 

মানব-ইতিহাসে মানুষে মানুষে কখনও কি এর চেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল? কথা সত্য। কিন্তু আবারও বলি, যোগাযোগ মানেই সংযোগ নয় এবং এ দুয়ের যে পার্থক্য, সেটা শুধু কথার কথা নয় 
অথবা বায়বীয় কিছু নয়। পার্থক্যটি একেবারেই বাস্তব। 

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান বিশ্বে মানুষে মানুষে যোগাযোগ অকল্পনীয় গতিতে বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির নানান পন্থা ব্যবহার করে এই গোলার্ধের এক প্রান্ত থেকে একজন মানুষ চোখের পলকে অন্য প্রান্তের আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। একজন আরেক জনকে লিখতে পারেন; একজন আরেক জনের সঙ্গে সংবাদ, তথ্য, ফটো, সচলচিত্র সব সহভাগ করে নিতে পারেন। তারা পরস্পর ব্যক্তিগত সংবাদ আদান-প্রদান করতে পারেন। এই যেমন তারা কী করছেন, বন্ধুবান্ধব কে কোথায় আছেন, আকর্ষণীয় কিছু ঘটছে কিনা সংস্কৃতি অঙ্গনে। কিছুক্ষণ অবয়বপত্র তথা ফেসবুক ঘুরে আসুন। বুঝতে পারবেন, আমি কী বলতে চাইছি। সবার জন্য উন্মুক্ত এমন একটা মাধ্যম নিশ্চিতভাবে মানব-যোগাযোগ বাড়িয়েছে।

সুতরাং মানব-যোগাযোগ অবশ্যই বেড়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানান বিষয়ের ওপরে মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করেন। আপনি এসব বিষয়ের ওপরে নানান মাধ্যমে কিছু লিখুন। দেখবেন, মিনিটের মধ্যে মানুষ সেখানে এসে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। হয় তারা আপনার সঙ্গে একমত হচ্ছেন অথবা ভিন্নমত পোষণ করছেন এবং এ প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন মত, দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে। এর ফলে উৎসাহব্যঞ্জক ও উদ্দীপক আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক ও মতবিনিময় শুরু হচ্ছে। 

একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, সামাজিক মাধ্যম মানুষকে একত্র করেছে; তাদের কণ্ঠস্বরকে জড়ো করেছে এবং সেই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন প্রসারিত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছর আগের ‘আরব বসন্ত’ বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। টুইটারে (বর্তমানে এক্স নামে পরিচিত) টুইট এবং পুনঃটুইটের মাধ্যমে আরও সংক্ষিপ্তভাবে মানুষে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এর ফলে বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ এক নতুন মাত্রিকতায় পৌঁছে গেছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগের পূরক প্রভাব অভাবনীয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ সব কিছু কি মানুষে মানুষে সংযোগের বিকল্প হতে পারে? আমি মনে করি, মানব-সংযোগ শুধু সামাজিক মাধ্যম বা তথ্যপ্রযুক্তির যোগাযোগ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। মানব যোগাযোগের ক্ষেত্রে কখনও কখনও মানুষ দূর থেকে যোগাযোগ রক্ষা করে। কখনও কখনও অজ্ঞাতনামা হয়ে থাকেন, কখনও পরস্পর চাক্ষুষ দেখাও হয় না। এ রকম যোগাযোগ কখনও কখনও অস্পষ্ট, যান্ত্রিক এবং দুঃখজনকভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। প্রায়ই মানুষে মানুষে যোগাযোগ করার এক পন্থা হয়ে দাঁড়ায় অর্থহীন এক ‘পছন্দ’ চিহ্ন, এবং কখনও কখনও অসংগত প্রতিক্রিয়া। যেমন– আমি দেখেছি যে, কারও প্রদত্ত পিতা-মাতার মৃত্যু সংবাদে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানান ‘পছন্দ’ চিহ্ন দিয়ে। এ যোগাযোগ সত্যিকার অর্থে কোনো যোগাযোগই নয় এবং এগুলো মানুষজনের অসংবেদনশীলতারই পরাকাষ্ঠা। 
মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ একদম অন্য জিনিস। সংযোগের জন্য প্রয়োজন সশরীরে উপস্থিত হওয়া; সামনাসামনি কথাবার্তা, চাক্ষুষ যোগাযোগ। মানুষকে স্পর্শ করার মতো ব্যাপার মানব-সংযোগের জন্য অপরিহার্য, যেমন প্রয়োজন সশরীরে উপস্থিতি। এসবের মাধ্যমে আমরা অন্যের হৃদয়কে স্পর্শ করি; একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করি ও সত্যিকারভাবে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হই। কোনো এক সহকর্মীকে একটি ই-বার্তা পাঠানো এক কথা; কিন্তু তাঁর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করা– তিনি আপনার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যাবেন কিনা, সে একেবারে অন্য কথা। এতে সময় বেশি লাগে? সম্ভবত। কিন্তু মানব-সংযোগের জন্য সময় এক অপরিহার্য উপকরণ। কারণ, চূড়ান্ত বিচারে আমরা একে অন্যের সময়টুকুই চাই এবং আমরাও একে অন্যকে সময়ই দিতে পারি। 

আধুনিক যুগে একই বাড়িতে এক ছাদের নিচে বসবাস করেও মানুষ বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, কিন্তু ঘরের মানুষের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে না। একটি বাড়িতে প্রায়ই দেখা যায়, সন্ধ্যার পরে বাবা টিভিতে খবর দেখছেন; যুক্ত তিনি বহির্বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে; মা পাশের বাড়ির মহিলার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। তিনিও যুক্ত বহির্জগতের একজনের সঙ্গে। বাড়ির ছেলেটি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কোনো খেলা খেলছে। যুক্ত সে একটি যন্ত্রের সঙ্গে এবং বাড়ির মেয়েটি অবয়বপত্রে বার্তা চালাচালি করছে তার বন্ধুদের সঙ্গে। সেও যুক্ত বন্ধুদের সঙ্গে। পরিবারের প্রত্যেকেরই বাইরের জগতের কারও না কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু বাড়ির কারও সঙ্গে কারও সংযুক্তি নেই। একসঙ্গে একই টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার রীতি আজকের দুনিয়ায় বড়ই বিরল।

চূড়ান্ত বিচারে মানব সংযোগের জন্য মানব-যোগাযোগ একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হতে পারে, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয় কোনোমতেই। যোগাযোগ সংযোগকে ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু যোগাযোগ সংযোগের বিকল্প নয়। সেই সঙ্গে ‘প্রয়োজনীয়’ এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ধারণার মধ্যেও ভেদরেখা টানা দরকার। যেমন– যোগাযোগ প্রয়োজনীয় কিন্তু সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ। একটা রূপক ব্যবহার করি। সংযোগ হচ্ছে একটি ‘ঘর’, যোগাযোগ হচ্ছে সেই ঘরের ‘দরজা’। দরজাকে ঘর ভাবলে বড় ভুল করা হবে এবং একইভাবে ভুল করা হবে যদি আমরা দরজাতেই থেমে যাই, ঘরে প্রবেশ না করি। 

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং 
দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্র
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স য গ র জন য কখনও কখনও কখনও ক

এছাড়াও পড়ুন:

তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া

পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান। শনিবার (১ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশন ঘোষিত চূড়ান্ত ফলে দেখা যায়, বুধবারের নির্বাচনে তিনি ৯৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। খবর বিবিসির। 

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব এবং ব্যাপক অস্থিরতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন ঘিরে দেশটিতে গত কয়েক দিনে সহিংসতায় কয়েক শ’ মানুষ নিহত ও বহু আহত হয়েছে। দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে নিহতের সঠিক সংখ্যা যাচাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকার সহিংসতার মাত্রা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অস্থিরতা দমনে দেশজুড়ে কারফিউও বাড়ানো হয়েছে।

ক্ষমতাসীন চামা চা মাপিন্দুজি (সিসিএম) দলের প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসানের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ভিন্নমত পোষণকারী ও বিরোধীদের ওপর কঠোর দমনপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। প্রধান দুই বিরোধী দলকেই নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়নি।

ফলে নির্বাচনের পরই বৃহত্তম নগরী দার-এস-সালাম ও অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবারও বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। অস্থিরতা বন্ধ করার জন্য সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা সামিয়ার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে এবং অসংখ্য গাড়ি, পেট্রোল স্টেশন এবং থানায় আগুন দেয়। 

বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বেশিরভাগ তরুণ বিক্ষোভকারীরা, যারা নির্বাচনকে অন্যায্য বলে সমালোচনা করেছেন। তাদের অভিযোগ, সরকার প্রধান বিরোধী নেতাদের দমন করে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করছে। প্রধান দুই বিরোধী নেতার মধ্যে একজন কারাগারে রয়েছেন এবং অন্যজনকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বিরোধী চাদেমা দলের একজন মুখপাত্র শুক্রবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে তানজানিয়ার একটি কূটনৈতিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, কমপক্ষে ৫০০ জন মারা যাওয়ার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ কম্বো থাবিত এই সহিংসতাকে ‘এখানে-সেখানে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত ও দৃঢ়তার সাথে কাজ করেছে।”

প্রধান দুই বিরোধী দলীয় নেতার মধ্যে চাদেমা দলের টুন্ডু লিসুকে নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগ আটক করা হয়, যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং এসিটি-ওয়াজালেনডো দলের নেতা লুহাগা এমপিনাকে আইনি কৌশল খাটিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।

১৬টি প্রান্তিক দল, যাদের কারোরই ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন ছিল না, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

সামিয়ার ক্ষমতাসীন দল সিসিএম, দেশটির রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে কখনও কোনো নির্বাচনে সিসিএম হারেনি।

নির্বাচনের আগে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিরোধী ব্যক্তিত্বদের জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের নিন্দা জানিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মৃত্যুর পর ২০২১ সালে তানজানিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামিয়া ক্ষমতায় আসেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারা বেশি কাঁদেন? 
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত