সাত কলেজ বিতর্ক: ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’
Published: 28th, January 2025 GMT
গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ করে ভারত যাওয়ার পর অনেক অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা আমাদের সামনে উত্থাপিত হয়েছে। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালক, অটোচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাজপথে নেমে দাবি উত্থাপন করতে দেখা গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ছাত্রলীগের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও চোখে পড়েছে। ছাত্র সংগঠনটি এখন নিষিদ্ধ। তবে ২৬ জানুয়ারির (রোববার) দিবাগত রাতটি এ ক্ষেত্রে ভিন্নই বলতে হবে। কারণ তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘এলিটিজমের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সে সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তেজিত আচরণ করছেন; যা কোনোভাবেই শিক্ষকসুলভ বলার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণ বিগত সরকারের আমলে যে প্রশাসন ছিল, তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই অপ্রীতিকর ও উস্কানিমূলক আচরণের বিপরীতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মামুন আহমেদের দুঃখপ্রকাশসহ কয়েক দফা দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি তখন সেই সংঘর্ষ থামাতে দৌড়ে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। যদিও তাতে আন্দোলন থামেনি, সংঘর্ষও হয়েছে; কিন্তু হাসনাত যে এমন বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে সেখানে গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের, সে জন্য অবশ্যই তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। তিনি সে রাতের সংঘাত হয়তো থামাতে পারেননি; কিন্তু কিছুটা হলেও এর মাত্রা যে কমেছে তা বলাই বাহুল্য। সংঘর্ষে আহত হলেন সেই শিক্ষার্থীরা, যারা মাত্র কয়েক মাস আগে পতিত সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গুন্ডাদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন; আবার এ সংঘর্ষ হয়েছে তাদের সঙ্গে, যারা সে সময় ছিলেন রাজপথের সহযোদ্ধা।
এর পরদিন সোমবার জানা গেল, ২০২৪-২৫ সেশন থেকে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ভর্তি করা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। কিন্তু সংকট কতটা কেটেছে? শিক্ষাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে, এই সংকটের শুরু ওই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢোকানোর পর থেকেই। তিনি এই সংকটের মূলে হাত দেওয়ার কথা বলেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই একটা সংকট। এতগুলো কলেজ, যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী কোনোভাবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার কাঠামো দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। এ জন্য একটি নয়, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাগবে। এ ক্ষেত্রে কলেজগুলোকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাগ করতে হবে। এই সাতটি কলেজ নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে অথবা একটি বোর্ডের অধীনে আনা যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাঙা দরকার। মনে হচ্ছে এটি চলছে; কিন্তু আসলে এটি চলছে না। পড়াশোনার মান, পরীক্ষা, শিক্ষক– সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরেই এর সমাধান চিন্তা করতে হবে। এ জন্য নড়াচড়া করতে হবে। চুপচাপ বসে থেকে আলস্য দেখালে হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যথযথ সক্রিয় হওয়া দরকার। আগের সরকার বিষয়টি ফেলে রেখেছিল; এই অন্তর্বর্তী সরকারও এ বিষয়ে সমাধানের পথে সক্রিয় কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি।’
দুই.
এখন কেউ আর কলেজ থাকতে চায় না; সবাই বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায়। এই সাত কলেজ যদি বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে, তাহলে এমন আরও যেসব কলেজ আছে, সেগুলোও একই দাবি জানাতে পারে। সেই দাবি কি মেনে নেওয়া সম্ভব? এর পেছনে রয়েছে সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি। শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সেভাবে চোখে পড়ে না; যেমনটা আমাদের সমাজে দেখা যায় ‘কলেজ শিক্ষার্থী’র বদলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী’ তকমার দাম বেশি; আবার প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা বা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা অথবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার সার্টিফিকেটের তুলনা। অথচ কোনো শহরতলির কলেজে পড়া একজন শিক্ষার্থী সমাজে যে ভালো কিছু করতে পারেন, সেই বাস্তবতা আমরা তৈরি করতে পারিনি। এর পেছনে রয়েছে অর্থনীতির সঙ্গে কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষার আন্তঃসম্পর্ক তৈরি করতে না পারা।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পর উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার জায়গা। এখানে সবাই আগ্রহী নাও হতে পারে বা সবার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে এবং সমাজের বিভিন্ন দিকের তাগিদ অনুযায়ী গবেষণা করবে। শুধু ক্লাসরুমে পড়ানো আর সার্টিফিকেট দেওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হবে বিশ্বজ্ঞান এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। বাংলাদেশে ষাটের দশকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন, শিক্ষকরাও আন্দোলন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে। পরে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।
এখন ৫০টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; অথচ ওই চারটি বাদে আর কোনো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেটাও গত কয়েক দশকে ভেঙে পড়েছে। বিগত সরকারের আমল থেকে তা পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। তখন থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা হয়ে ওঠে সরকারের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের একটি সম্প্রসারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃষ্টির কি হবে না হবে, সেটা ঠিক করেছে সরকার ও তার আজ্ঞাবহ প্রশাসন। জ্ঞানচর্চার বেশি দরকার নেই, তার দরকার অনুগত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী; যারা সরকারকে সেবা করবে, সরকার যা বলবে সেটাকে সমর্থন করবে– এ ধরনের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন বদলে এখন যাদের নেওয়া হচ্ছে, তারাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন; কারণ এই শিক্ষকরাও দলবাজ। এর বাইরে লবিংমুক্ত নিয়োগ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার না হলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক দু’দিকেই আধিপত্যের দলবাজি রাজনীতি চলতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে এবং শিক্ষক যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান, তাদের পক্ষেও কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিন.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার মাধ্যমে সাত কলেজের সংকট শেষ হয়নি। কিন্তু কলেজগুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে এখনও তেমন কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা এখানে তুলে ধরা হলো–
১. কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে সমাধান আসবে না। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে দিয়ে কয়েকটি কলেজ নিয়ে একেকটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে।
২. ওই বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন তদারক করা হবে।
৩. প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
৪. শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা সীমিত করা যেতে পারে।
৫. ভর্তি পরীক্ষা এবং সেমিস্টার পরীক্ষায় মান নিয়ন্ত্রণ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে।
৬. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণে সম্ভাব্য বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের বিশেষায়িত কমিটি থাকবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের প্রশাসনিক ও পরিচালনা কমিটিতে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে।
৮. সব কলেজের সুযোগ-সুবিধা একরকম নয়। এ জন্য কলেজগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে।
৯. গবেষণার জন্য যৌক্তিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. পাঠদান বাদে সব কাজ অনলাইনে নিশ্চিত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অনলাইন তথ্য হস্তান্তর করা হবে। এ জন্য ডেটাবেজ আপডেটসহ শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহযোগিতায় বিশেষায়িত বিভাগ থাকতে হবে।
শাহেরীন আরাফাত: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
shaherin.arafat1@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ত কল জ স ত কল জ র শ ক ষ র থ ন শ চ ত কর ত সরক র র স ঘর ষ এ জন য দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতে কোনো বাংলাদেশি থাকলে উপযুক্ত চ্যানেলে পাঠাতে হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ভারতে থেকে থাকলে, তাঁদের উপযুক্ত চ্যানেলে পাঠাতে হবে।
ভারত থেকে কিছু মানুষকে বিভিন্ন জেলার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। আমাদের দেশের নাগরিক যদি ভারতে থাকেন, তাহলে উপযুক্ত চ্যানেলে পাঠালে আমরা নেব। কিন্তু তাঁদের জঙ্গলের ভেতর ও নদীতে ফেলে যাওয়া কোনো সভ্য দেশের আচরণ হওয়া উচিত নয়।’
আজ রোববার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে ঈদ–পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় ও আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা এ মন্তব্য করেন। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে মারধর করলে পুলিশকে খুব সচল বলে ভাবা হতো। কিন্তু বর্তমান সরকার এমন পুলিশ চাইছে না। আমরা মানবিক পুলিশ চাচ্ছি, যারা সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। এখনকার পুলিশ হচ্ছে মানবিক পুলিশ। তারা এখন ভালো ব্যবহার করে দেখেই সাধারণ জনগণ ভাবছে, পুলিশ সচল হয়নি। বর্তমান পুলিশ কিন্তু আগের চেয়ে আরও বেশি সক্রিয়।’
আরও পড়ুন২৪ দিনে ১১৪৩ জনকে ঠেলে পাঠাল বিএসএফ০১ জুন ২০২৫আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা প্রস্তুত এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যখন নির্বাচনের সময় ঘোষণা করবে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে অনুযায়ী প্রস্তুত রয়েছে।’
আরও পড়ুনভারত থেকে ‘পুশ ইন’ ঠেকানো সম্ভব নয়: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা০৩ জুন ২০২৫